সত্যি কথা বলতে কি, এইরকম একটা দিন যে পৃথিবীর কোথাও উদযাপিত হয় কিংবা সঠিকভাবে বলতে গেলে এই ধরণের কোনও দিনের যে আদৌ অস্তিত্ব রয়েছে, সেটাই আমার অজানা ছিল এতকাল। এক পরিচিতের হোয়াটস্যাপ মেসেজে জানতে পারলাম এই দিনের কথা।
‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’ —
নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমার নিজস্ব ক্যালেণ্ডারে ‘আনন্দ দিবসে’র কি কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে? নাকি হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী কিংবা কবি পঞ্চানন বর্মার আবির্ভাব দিবসের মতো (এগুলো কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারি দিনপঞ্জীতে লাল রঙে দাগানো) এই দিনটিও আমার কাছে তেমন কোনও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে না!
যখন আমার তরুণীবেলা, বাবা-মায়ের আমাকে বেড়াল পার করার মতো গোত্রান্তরিত করে অন্যগৃহে রোপণ করার ভয়ানক স্পৃহা জন্মেছিল। কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারছিলাম না যে তাদের কাছে থেকে, নিজের এবং তাদের সামান্য কিছু গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে নিতে পারলেই আমি সুখী।
একদিন এক এনআরআই পাত্রপক্ষকে ডেকে এনে পাত্রী দেখানোর আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে প্রবল অভিমানে আমার গলায় লোরেটো কনভেন্ট কথা বলে উঠেছিল, মনে পড়ে —
‘A good book to read, a good film on the tv and a decent square meal to eat under a roof, that describes my idea of happiness, don’t you dumb people understand?’
আনন্দ/সুখের সেই সংজ্ঞা, যা নিজের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছিলাম তিরিশ বত্রিশ বছর আগে, তা আজও বিশেষ বদলায়নি।
আজ সন্ধেবেলায় প্রায় চার দশকের পুরোনো কলেজি বন্ধুর সঙ্গে ফোনে গল্প হচ্ছিল।
সে বলল — ‘দ্যাখ, সেই অল্পবয়সে যখন আমরা কেরিয়ারের পিছনে দৌড়েছি, তখনো কিন্তু কেবল অর্থ উপার্জনেই মোক্ষ এমনটা ভাবিনি সকলে”।
হয়ত ঠিকই বলল। কিন্তু আমার মনে জেগে উঠল জিজ্ঞাসা — তাই যদি হবে, তবে এখনো পুনর্মিলন উৎসবগুলোয় কে কত ‘গ্র্যাঞ্জার’ দেখাতে পারে অর্থে, যশে, বাড়ি-গাড়ি, চেম্বার-ক্লিনিকের জনসমাগমে, তার চোরা তুলনা/রেষারেষি কেন চলে?
আমাদের মনের ভিতরে সুপ্ত রাক্ষসের মতো অতলস্পর্শী লোভ যদি না-ই থাকবে, তবে বাজার অর্থনীতি তার নিরঙ্কুশ, লাজলজ্জাহীন ভোগবাদের সোনার কাঠিটি ছুঁইয়ে এই অপরিমেয় কামনা-বাসনাকে জাগিয়ে তুলতে পারল কোন রন্ধ্রপথে?
আনন্দ মানে কারও কাছে ইন্দ্রিয়সুখের চূড়ান্ত, কারও কাছে অন্যের সঙ্গে দুনিয়াদারির লড়াইতে জিতে যাওয়া, আবার কারও কাছে অল্পেই সন্তুষ্টি।
আমার বাবা ছিল শেষ গোত্রের। তাই সারাজীবন তাকে ‘আন-অ্যাম্বিশাস’ বিশেষণে ভূষিত হতে হয়েছে — নিতান্ত আপনজনের কাছ থেকেই। বাবা সন্তুষ্টি নিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারেনি, জীবনে ‘কিছু করে দেখানোর যুদ্ধে’ নিজেকে প্রমাণ করতে না পারার গ্লানি নিয়ে চলে গিয়েছে।
সমাজ এবং তার নিয়ামকদের হাতে নিত্য ঘা খেতে খেতে আমার মায়ের কাছে আনন্দের সংজ্ঞা ছিল জিৎ। টেক্কা দেওয়া। মা বোঝেনি, এতে সাময়িক খুশি হয়ত পাওয়া যায়, কিন্তু এই পথ নির্বিকল্প নয়। তিমিকে গ্রাস করার জন্য তিমিঙ্গিল সব সমুদ্রেই ঘুরে বেড়ায়।
তাই, সর্বক্ষণ নিজের সাফল্য, সৌভাগ্য সমাজের কাছে প্রমাণ করার পর্বতপ্রমাণ দায় আর মানসিক চাপ নিতে নিতে সেও চলে গিয়েছে, এক বুক অতৃপ্তি নিয়ে।
পড়ে রইলাম আমি।
পরম আনন্দ আর চরম বিষাদ আমার কাছে আজ প্রায় একাঙ্গী। বিন্দুমাত্র আধ্যাত্মিক না হয়েও এই নির্লিপ্তি আমি অর্জন করতে পেরেছি, এইটুকুই আমার অলঙ্কার।
ঠিক এইখানেই আমি জিতিয়ে দিয়েছি আমার হাত ছাড়িয়ে অন্য লোকে পাড়ি দেওয়া বাবা-মাকে।
হয়ত কিচ্ছু পাইনি তেমন জীবনে — না আর্থিক, না পারমার্থিক — তবুও আমি অখুশি নই।
ঠোক্কর খেতে খেতে, বারবার পড়ে গিয়ে নিজের হাত ধরেই ফের উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমি একটা কথা খুব ভাল বুঝে গিয়েছি। The grass always looks greener on the other side….
তাই আধ গেলাস জলকে অর্ধেক খালি না ভেবে অর্ধেক ভর্তি ভাবাই ভাল।
আমার চেয়ে দুর্ভাগা, দুঃখী, পরাজিত বহু মানুষ লড়ে যাচ্ছে চারপাশে।
আমি তো তাদের চেয়ে ভাল আছি। যদি পারি, সীমিত সাধ্যে তাদের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। না পারলে, হাত জোড় করে তাদের জন্য প্রার্থনা করি। নীরবে, বিনা বিজ্ঞাপনে।
এতেই সুখ, এতেই আনন্দ, এতেই তৃপ্তি।
জীবনের তিন চতুর্থাংশ কাটিয়ে ফেলেছি। বাকিটুকুও যেন এই অল্পে তুষ্টির মনোভাব নিয়ে কাটিয়ে যেতে পারি।
No grudges, no bickerings, no regrets.
কিসি কি মুসকুরাহটোঁ পে হো নিসার,
কিসি কা দর্দ মিল সকে তো লে উধার
কিসিকে ওয়াস্তে হো তেরে দিল মে পেয়ার —
জীনা ইসি কা নাম হ্যায়।
সাত বছর আগের এক দোলপূর্ণিমার ছবি। আনন্দের দিন একটু হাস্যবিজড়িত হোক, এইটুকু চাওয়া। 😊