চৌত্রিশ বছরের বাম অপশাসন এবং নেহেরুর ভ্রান্ত নীতির ফলে, মাননীয়ার অনুপ্রেরণায়, গুরু গোলওয়ালকরের দেখানো পথে সাভারকারের বুলবুলি পাখির পিঠে চড়ে আমার শরীরটা দ্রুত গোল্লায় যাচ্ছে। গত হপ্তা দুয়েক ধরে সেটা বেশি করে টের পাচ্ছি কিন্তু বিশ্রাম পাচ্ছি না। অবশ্য পিঠের যন্ত্রণায় দাঁড়াতে বা নিচু হতে যতটা কষ্ট হচ্ছে, ইদানীং বসতে বা শুতেও তাই। রাতে ঘুমও ভাঙিয়ে দেয়, যদি আদৌ শোবার সুযোগ পাই। সুতরাং অকারণে বিশ্রামের নাটক না করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ঘোড়া প্রমাণ করাই ভালো। এই জন্তুটার কিছু ইজ্জত আছে।
ক্লেশ যত বাড়ছে, তত বেশি করে খুশি থাকার ভান করছি এবং হুলিয়ে খিল্লি করছি জল, মহাকাশ ইত্যাদি নিয়ে। এতে কিছু না হোক, মনের ক্লান্তি কমে। এই মুহূর্তে সুনীতা উইলিয়ামস আর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবির ক্রমাগত এন্টারটেইন করে চলেছেন। বিজেপি, তৃণমূল কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। বামেরা কনফিউজড সুনীতা মোদির আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় (যে খবর আবার বেরিয়েছে তৃণমূল কাগজে) খুশি হবেন না স্পিভাক মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানানোয় দুঃখ পাবেন? বিজ্ঞানবাদীরা মহাকাশ অভিযানকে হাতিয়ার করে কুম্ভমেলায় যাওয়া ভক্তদের হ্যাটা করতে গিয়ে টের পেলেন যে জন্মসূত্রে মার্কিন সুনীতা প্র্যাক্টিসিং হিন্দু, পুজো-আচ্চা করেন, গীতা, উপনিষদ, ‘ওঁ’ চিহ্ন নিয়ে স্পেস স্টেশনে যান! দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছেন। তাঁদের উত্তেজিত বার্তালাপ শুনে মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, সুনীতা উইলিয়ামস একটি মহাকাশযানে ওঠার চেষ্টা করছেন৷ আর একদল ভিরাট যুক্তিবীর তাঁর ঠ্যাং টেনে ধরেছে, কিছুতেই উঠতে দেবে না… মনে ভক্তি নিয়ে মহাকাশে গেলে স্পেস স্টেশন অপবিত্র হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে পুরো কমেডি সার্কাস। অথচ গীতা, উপনিষদ অবলম্বন করা বিজ্ঞান জানা আধুনিক সাহসী মানুষ গুজরাট দাঙ্গার বিরুদ্ধে কথা বলে কী শেখাচ্ছেন, সেটা নিয়ে কোনো শিবিরের আগ্রহ নেই। ধার্মিক, ধর্মান্ধ আর ধর্মব্যবসায়ীদের আলাদাভাবে বোঝার পরিশ্রম কে করে?
এত খিল্লির হট্টমেলাতেও তাই মন কিছুতেই চাঙ্গা থাকছে না। আমরা ধর্মচর্চা বলতে বুঝব কেবল অন্য ধর্মের মানুষের ওপর অত্যা/চার করা, বিজ্ঞানচর্চা বলতে বুঝব রাতদিন আস্তিকদের বিদ্রূপ করা, দেশ বলতে বুঝব সীমান্ত শুধু, দেশপ্রেম বলতে বুঝব রাজভক্তি, শত্রু বলতে বুঝব মানুষকে। আমরা সুখ বলতে বুঝব আরও কিছু জিনিস কিনে ফেলতে পারা, সাফল্য বলতে বুঝব ছলে-বলে-কৌশলে পাশের মানুষটিকে হারিয়ে দিতে পারা। আপনি যদি প্রবল দক্ষিণপন্থী হন, তাহলে প্রাণপণে বিশ্বাস করবেন যে ভারতে সংখ্যালঘু মুসল মান আর বাঙলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যা/চার করতে পারলেই সুদিন আসবে। আপনি যদি প্রবলতর বামপন্থী হন, তাহলে বিশ্বাস করবেন যে সুদিন আসবে শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত কিছু মানুষকে নিকেশ করতে পারলেই। আসলে এভাবে বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ক্ষমতার হাতবদল হয় মাত্র, গঠনমূলক উদ্যোগ ছাড়া সুদিন আসে না, একথা কোনো পক্ষই বলবেন না, এমনকি ভাববেনও না।
অতএব আচ্ছে দিন আসবে গাজার মানুষ অন্যত্র পালিয়ে (ভদ্র ভাষায় নাকি পুনর্বাসন) সেখানে ট্রাম্পের ট্রাম্পেট বাজিয়ে মহান রিয়াল এস্টেট বাণিজ্য হলে। সেই মহান উদ্দেশ্যে প্যালেস্তাইনের শিশুদেরও চূর্ণ করা চলে৷ অথচ স্বদেশহীন উদ্ভ্রান্ত জীবনের স্বাদ কেমন, সেকথা যদি ঐতিহাসিকভাবে কেউ বুঝতে পারে, তবে তা বোঝার কথা ই হু দিদের, ই জ্রা য়েলের। কী নিদারুণ আয়রনি! এই নারকীয় পরিস্থিতিতে সবচেয়ে নীরব সম্ভবত ই সলা মের রাজা সৌদি। আবার ইজ্রায়েলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের ইহুদি বিদ্বেষী কথা শুনলে মাঝেমাঝে বিগত শতাব্দীর অ্যান্টিসেমি টিক ভাষ্যের কথা মনে পড়ে যায়। আমেরিকায় দাবানলে বহু মানুষের ঘর পুড়লে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে বীমা কোম্পানি আর সাদা খৃষ্টানের সর্বনাশ হয়েছে বলে উল্লাসে ফেটে পড়ে প্যালেস্টাইনের দুঃখে কাতর বাঙলাদেশী মুসলমান। ওদিকে সিরিয়া, আফগানিস্তানে মুসলমানদের মারে মুসলমানেরাই। এসবের পরেও বলবেন যে এসব যুদ্ধ-হত্যা ধর্মের কারণে হয়? ক্ষমতা আর পয়সার লোভে নয়? যাঁরা এই অর্থনৈতিক কার্যকারণ বোঝেন, তাঁদের আবার থাকে তিয়েনআনমেন স্কোয়ার বা রুশ আগ্রাসনকে ডিফেন্ড করার দায়। বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও, বিদ্যা প্রভূত পরিমাণে অর্জন করা সত্ত্বেও মানুষ কত অসহায়! এমনকি অন্য মানুষের মৃত্যুতে কষ্ট পাওয়ার আগেও কত রাজনীতি ভাবতে হয়! অতএব গাজা, ইউক্রেন, লিবিয়া, বেলুচিস্তানে, চট্টগ্রামে শিশুসন্তানের দেহ কোলে বসে থাকবেন কোনো বাবা… বারবার তার বন্ধ চোখের পাতা টেনে দেখবেন তারাটা নড়ে উঠল কিনা। “অল্প লইয়া থাকি তাই, মোর যাহা যায়, তাহা যায়।” খুব সাধারণ জীবন কিনা আমাদের। খুব সাধারণ স্বপ্ন আর বাঁচা। ওইটুকু পাখির মতো প্রাণ কোল ছেড়ে উড়ে গেলে মিথ্যে হয়ে যায় পৃথিবী।
তারপরও অবশ্যই বৃহৎ স্বার্থের কথা বলতে পারেন। উন্নয়নের কথা, আচ্ছে দিনের কথা। ধর্ম, জাত, জাতীয়তা, শ্রেণী, লিঙ্গ, মতাদর্শ… কোনো একটা কিছুর ভিত্তিতে বহু মানুষকে মেরে ফেলার মাধ্যমে নিশ্চিত মানবমুক্তির মহান গল্প শোনাতে পারেন। পঞ্জিস্কিমে ঠকতে অভ্যস্ত আমরা আপনাদের কথা বিশ্বাস করতে থাকব। ঘৃণা আর ক্ষমতার রাজনীতিকে সোনালি রঙে উজ্জ্বল করে পেয়ে যেতেই পারেন শান্তির নোবেল বা লক্ষ লক্ষ মানুষের বাহবা। শুধু আমার মতো মূর্খ, রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ কিছু মানুষ তবু বিশ্বাস করবে, একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছুর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনীতি কোনোদিন মানবমুক্তির দিশা দেখাবে না৷
হেরে যাব, নিশ্চিত জানি। তবু এই বুড়ো বয়সে বিশ্বাসটাকে বদলে ফেলতে চেয়েও পারছি না। প্রতিদিন হেরে যাচ্ছি। তরুণ বয়সে চিকিৎসক হয়েছিলাম ভালোবাসার তাড়নাতেই। বহুদিন কেরিয়ার নিয়ে আদৌ ভাবিনি। শেষে একসময় ভাবতে বাধ্য হয়েছি৷ যা ভেবে এই পেশায় এসেছিলাম, তা আর থাকতে দিল না পরিপার্শ্ব। প্রফেশনটার চরিত্রই দিল বদলে। মানিয়ে নিলাম কিন্তু আগে কাজের মধ্যে যে আনন্দটুকু ছিল, সেটা চলে গেল। এখন ক্লান্ত লাগে। খুব ক্লান্ত লাগে আর খুশি থাকার ভান করে। চুটকি বলে লোক হাসাই।
আগে মনে হত, “আর কবে?” এখন মনে হয়, “আর কেন?” তারই মধ্যে রোজ সংবাদে দেখায় অজস্র আত্মহত্যার খবর। মনে হয়, “আর কেন?” কিন্তু আমি সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়ব না। শরীরের যন্ত্রণায় নয়, মনের যন্ত্রণাতেও নয়। এই লাফিয়ে না পড়াটাই শেষ যুদ্ধ। কারণ এই দুনিয়ার প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে মরলে মুক্তি আসবে না। ঘৃণায় মুক্তি আসে না, আসে একমাত্র ভালোবাসায়। অন্তিম প্রতিরোধটুকুও ভেঙে যাচ্ছে দেখলে নিজের মেয়েটার মুখের দিকে তাকাই। কারণ, “অল্প লইয়া থাকি”। কারণ একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া কোনোকিছুতে আর রাজনৈতিক আস্থা নেই।