স্টিফেন জে গুল্ড ছিলেন বির্বতনীয় জীববিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও অসাধারণ বিজ্ঞান লেখক। তাঁর এক প্রবন্ধের নাম ছিল ‘ডায়েট অফ ওয়ার্মস’। (টীকা ১) শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালবাসতেন জে গুল্ড। এখানে ডায়েট মানে পথ্য নয়, ওয়ার্ম মানে ক্রিমি নয়। মার্টিন লুথারকে পোপ ধর্মচ্যুত ঘোষণা করার পরে তার বিচারসভা (Diet) ওয়ার্মস নামক শহরে অনুষ্ঠিত হয়। (টীকা ২) ‘ডায়েট অফ ওয়ার্মস’-এর অর্থ ওয়ার্মস শহরে (মার্টিন লুথারের) বিচারসভা।
কিন্তু ‘ডায়েট অফ ওয়ার্মস’ শুনলে আমাদের মার্টিন লুথারের বিচারের কথা মনে হয় না, মনে হয় ক্রিমি খাবার কথা। আর আমি গুল্ড নই, আমি শব্দ দিয়ে কিমা বানাচ্ছি না। ‘ডায়েট অফ ওয়ার্মস’ দিয়ে আমি সত্যিকারের ক্রিমি খাবার কথা বলছি। ম্যাগোঃ!
.
২০১৬ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় বলেছিল, (তথ্যসূত্র ১)
“মানুষের অন্ত্রে লুকিয়ে থাকা পরজীবী ক্রিমি দেখলে বীভৎস লাগে, তবে তারা ক্রোন’স ডিজিজ ও অন্যান্য ধরণের অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ প্রতিরোধ করে বলে মনে হয়।”
ক্রিমি সর্বরোগহর গোমূত্র নয়, ফলে বিজ্ঞানের প্রমাণ ছাড়া ক্রিমি খেতে কেউ রাজি হবেন না। সেই প্রমাণ পাবার কাজ চলছে। (তথ্যসূত্র ২) কিন্তু এর পেছনকার তত্ত্বটি বেশ দ্যোতক। (তথ্যসূত্র ৩) তত্ত্বুপ্রস্তাবটির নাম ‘হাইজিন হাইপোথিসিস’ বা ‘স্বাস্থ্যবিধি তত্ত্বপ্রস্তাব’। কথাটা শুনে মনে হয় এটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোগ দূর করার তত্ত্ব। আসলে কিন্তু ‘স্বাস্থ্যবিধি তত্ত্বপ্রস্তাব’ হল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ফলে রোগ হবার তত্ত্ব।
.
কথাটা আরেকবার বলি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে রোগ হবে না, তাই তাকে বলি স্বাস্থ্যবিধি। হাত না ধুয়ে খেতে বসলে আমরা বলি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাত ধোও, নইলে কিন্তু পেটের রোগ হবে। কথাটা সত্যি। কিন্তু আমরা তো আর আকাশ থেকে পড়িনি, বিগত দু-তিন লক্ষ বছর ধরে আমরা বনেজঙ্গলে বাস করে, শিকার করে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে খেয়ে বেঁচেছি। তখন ‘হাত ধুয়ে খেতে বস’ ফরমান জারি করলে চলত না। আমরা হাত না ধুয়ে খেয়েছি, ফলে পেটে ক্রিমি হয়েছে। ক্রিমি মারার ওষুধ ছিল না, আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্রিমির সঙ্গে লড়াই করেছে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, সে জানে তাকে ক্রিমির সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। কিন্তু আমরা বিংশ শতকে এসে তাকে বলছি, “অন্ত্রখাঁজ হ’তে ক্রিমি মেরে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস।” (নজরুল স্বয়ং আমার কৈফিয়ৎ দিয়েছেন)। সে কি আর কথা শোনে!
.
ক্রিমি রাক্ষস বধের পরে সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই, কেবল লঙ্কাকাণ্ড সমানে চলছে। ছোটবেলা থেকে টিপটাপ থাকার ফলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম অন্য শত্রুর অভাবে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে ব্যথা করেই চলেছে। আলসারেটিভ কোলাইটিস, ক্রোন’স ডিজিজ, ও নানা রকম অ্যালার্জিঘটিত অসুখ সম্ভবত আমাদের ইমিউন সিস্টেমের আত্মঘাতী যুদ্ধের ফল।
রোগ সৃষ্টিকারী পরজীবী ও জীবাণুর সঙ্গে ইমিউন সিস্টেমের মোকাবেলা হবে কিনা, সেটা নানা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ধনী ও বেশি শিক্ষিতদের মধ্যে পরজীবী ও জীবাণু সংক্রমণের হার কম, গরীব, পথবাসী বস্তিবাসীদের মধ্যে এই হার বেশি। যাদের বিছানায় একাধিক মানুষ শোয় বা যাদের কুকুর-বেড়াল ইত্যাদি পোষ্য আছে, তাদের ইমিউন সিস্টেমের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ক্রিমির লড়াই চলে। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠির মানুষের মধ্যে ইমিউন মেডিয়েটেড ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজের হারে ফারাক বেশ ইন্টারেস্টিং। ‘ইমিউন মেডিয়েটেড ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ’ শুনে ঘাবড়ে যাবেন না। আলসারেটিভ কোলাইটিস বা ক্রোন’স ডিজিজ-এর মত রোগ, যারা আমাদের নিজেদের প্রতিরোধ-ব্যবস্থার অতিক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত, এটা তাদের সাধারণ নাম।
.
মোটা দাগে বলা যায়, যাদের জীবনযাত্রার মান নীচের দিকে, তাদের ইমিউন মেডিয়েটেড ইনফ্ল্যামেটরি রোগ কম। আমরা জানি, জীবনযাত্রার মান খারাপ হলে স্থূলত্ব কম হয়, ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কম হয়। (টীকা ৩) গরীবরা রোগা হবে ও মোটাদের রোগে ভুগবে না, এটা সহজে বোঝা যায়। কিন্তু তারা অ্যালার্জি-জাতীয় রোগে ভুগবে না কেন?
.
মানুষ ও তার পরজীবীদের সহ-বিবর্তন ঘটে। আমাদের পেটের পরজীবীরা আমাদের ইমিউন সিস্টেম এড়ানোর জন্য খুব জটিল প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রতিরোধক্ষমতাকে আংশিকভাবে দমন করেছে। এর ফলে মানুষের অসুবিধা, তার প্রতিরোধ ক্ষমতা যায় কমে। কিন্তু মানুষ কি আর কম যায়! সেও এমন অবস্থায় আন্ত্রিক পরজীবীর উপস্থিতিতে আরেকটু বেশি ইমিউন ক্রিয়া দেখাতে শিখে গেছে।
.
এদিকে ১৯১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অন্ত্রের হুকওয়ার্ম ক্রিমির প্রাদুর্ভাব ছিল শতকরা ৬৫ ভাগ, আর ১৯৮০ সালে সেটা শতকরা ২ ভাগেরও নীচে চলে গেছে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষের অন্ত্রে ক্রিমিজাতীয় পরজীবীর সহাবস্থানের ফলে আমাদের ইমিউন ব্যবস্থা এমন উঁচু তারে বাঁধা হয়ে গেছে যে, পরজীবী দিয়ে খানিক অবদমিত না হলে, সেই ব্যবস্থা যেন বাড়াবাড়ি রকমের ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।
.
অতি-ক্রিয়াশীল ইমিউন সিস্টেম অনেকটা অতি-দেশভক্তের মত, দেশের শত্রু না পেলে দেশের লোককে দেশশত্রু বানিয়ে তাকে মেরে ফেলে তবে তার শান্তি। জীবাণু মারার কাজ করে অতি-ক্রিয়াশীল ইমিউন সিস্টেমের খাঁই মেটে না, সে অন্য কাউকে মারতে চায়। সে হাত-পা ছুঁড়ে মুখ খিঁচিয়ে যুদ্ধ করে, কিন্তু আশেপাশে জীবাণু নেই, আছে মানুষেরই অন্য সব কোষ। তারাই মারা পড়ে। তাকে বলে নিজেকে-আক্রমণ রোগ বা অটো-ইমিউন ডিজিজ। উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রচলন সেখানে ছোয়াঁচে নানা রোগ কমিয়েছে, কিন্তু সম্ভবত সেই কারণেই ছোঁয়াচে নয় এমন নানা রোগ বাড়ছে। এটাই হল সংক্ষপে হাইজিন হাইপোথেসিস বা স্বাস্থ্যবিধি (পালনের ফলে রোগ বাড়া) তত্ত্বপ্রস্তাব।
.
২০২২ সালে এসে দেখতে পাচ্ছি, এখনও বিজ্ঞানীরা সঠিক ক্রিমি-চিকিৎসা খুঁজে পাননি। তাঁরা বলছেন, ক্রিমি [হেলমিন্থ জাতীয় পরজীবী] থেকে প্রাপ্ত অণুগুলি দিয়ে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বদলে দেবার গবেষণা এখনও সীমিত। (তথ্যসূত্র ৪) তবুও সেই অণু দিয়ে ইমিউন মেডিয়েটেড ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজগুলোর চিকিত্সার দুর্দান্ত সম্ভাবনা রয়েছে।
কুচো-ক্রিমি খেয়ে না-হোক ক্রিমি কুচিয়ে খেয়ে বেশ অনেক রকমের রোগ সারবে বলে আশা করাই যায়। তবে কেমন করে ক্রিমি কুচোলে অর্থাৎ প্রক্রিয়াকরণ করলে সুফল বেশি, সে নিয়ে এখনও একমত হওয়া যায়নি।
.
ততদিন আমরা কি বুড়ো আঙ্গুল চুষব? না না, ওটা নেহাত আন-হাইজিনিক, কেননা ওতে পেটে ক্রিমি হতে পারে!!
.
টীকা
১) প্রবন্ধটির পুরো নাম “The Diet of Worms and the Defenestration of Prague”।
২) ডায়েট কথাটা এখনও আইনসভা অর্থে প্রচলিত, যেমন জাপানের পার্লামেন্টের ইংরাজি নাম হল ডায়েট।
৩) সেটা অবশ্য এখন আমেরিকার মত দেশে বদলে যাচ্ছে, কারণ সেখানে গরীবরা বেশি ক্যালোরিযুক্ত খারাপ খাদ্য বেশি খাচ্ছে। সেটা অন্য প্রশ্ন।
.
চিত্র পরিচিতি
১) Leonardo’s Mountain of Clams and the Diet of Worms. স্টিফেন জে গুল্ড
২) হুকওয়ার্ম, আমাদের রক্তচোষক ক্রিমি
৩) ইমিউন মেডিয়েটেড ইনফ্ল্যামেটরি রোগ বা অতি-ক্রিয়াশীল ইমিউন সিস্টেমজনিত রোগ
৪) কীভাবে যে ক্রিমি দিয়ে ডিনার করা যায়?
.
তথ্যসূত্র
১) Parasitic worms may prevent Crohn’s disease by altering bacterial balance. Nature News Biology 14 Apr 2016
২) Sipahi AM, Baptista DM. Helminths as an alternative therapy for intestinal diseases. World J Gastroenterol. 2017;23(33):6009-6015.
৩) Maruszewska-Cheruiyot M, Donskow-Łysoniewska K, Doligalska M. Helminth Therapy: Advances in the use of Parasitic Worms Against Inflammatory Bowel Diseases and its Challenges. Helminthologia. 2018;55(1):1-11.
৪) Shi W, Xu N, Wang X, Vallée I, Liu M, Liu X. Helminth Therapy for Immune-Mediated Inflammatory Diseases: Current and Future Perspectives. J Inflamm Res. 2022;15:475-491