অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। সময় হয় না-র থেকেও বলা ভালো লেখায় পায় না। কিন্তু সন্ধ্যে থেকে হঠাৎ কেমন লিখি লিখি মন করছিলো, তাই ভাবলাম একটু বকবকানো যাক্। আমি আমার দস্যিপিসির কথা কখনো বলেছি আপনাদের? না বোধহয়। আজ বিকেল চারটেয় যখন ঘন অন্ধকার হয়ে গেলো, হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে হলো, আচ্ছা দস্যিপিসি কি এখনও লেখে? তারপর আর কি, ভাবতে ভাবতে চলে গেলাম দস্যিপিসির কাছে। কোলে মাথা রেখে গল্পটা সবে শুরু করবো, ব্যাস মেল অ্যালার্ট। সব গেলো থেমে। কিন্তু দস্যিপিসি তো দমবার পাত্রী নয়, মাথায় চড়ে বসলো। তাই তার কথা এখন লিখতে বসলাম।
দস্যিপিসি আমার পাড়ায় থাকতো। দস্যিপিসির আসল নাম চাঁপা। কিন্তু ছোট থেকে তার দুরন্তপনা আর অত্যাচারে কে যে কবে তাকে দস্যিমেয়ে বলেছিলো, আর তা সবার এতো মনে ধরে গেছিল যে সেই থেকে সে দস্যি নামেই সাড়া দিতো। ছোট থেকেই দেখেছি সে হাতে বড় লম্বা কাগজের রোল নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। কাজ কর্ম যাই করতো কাগজটা হাত ছাড়া করতো না। দুষ্টুতো আমি কম ছিলাম না। দস্যিপিসি বাড়িতে এলে ভালো মেয়ের মতন পাশে বসে গল্প করতাম, কিন্তু রাস্তায় দেখা হলে কাগজটা টানতাম। আর সাথে সঙ্গীসাথী থাকলে তো কথাই নেই, সেদিন আর অন্য কোন হাসি মজার খোরাক লাগতো না। ছোট থেকে আমার যে জিনিসে “না” তাতেই প্রবল ইন্টারেস্ট। “না” টা কেন “না” সেটা জানা না অবধি আমার শান্তি হতো না। তো দস্যিপিসির ওই কাগজের ওপর আমার স্বাভাবিক ভাবেই প্রবল নজর ছিল। একদিন বাড়িতে একা, হঠাৎ দেখি দস্যিপিসি আমদের বাড়িতে আসছে। উহ্! কি যে আনন্দ হলো। প্রথমে কিছুক্ষন ভালো মেয়ের মতন গল্প করলাম। তারপর কথার ফাঁকে সময় বুঝে দিলাম টান ওই কাগজে। অন্যমনস্কতাবশতঃ আটকাতে পারেনি দস্যিপিসি। কাগজটা পেয়ে তো আমার আনন্দ আর ধরে না। হাতে নিতে পেরে এতো খুশি হয়েছি যে কাগজটা খুলে দেখতেও ইচ্ছে করছে না, উল্লাসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি। হঠাৎ দস্যিপিসির দিকে তাকিয়ে দেখি তার দু’চোখ ভরা জল, একটা অসহায় দৃষ্টিতে সর্বহারার মতন আমার দিকে তাকিয়ে। আমার অতো উচ্ছাস এক মুহূর্তে চলে গেলো, আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি এর জন্য কাঁদছো! আমি কি নিয়ে নেবো নাকি! এই নাও ধরো। বাচ্চাদের মতন কাগজটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে গেলো। চোখের জল মুছে একগাল হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো। আমি আরও অবাক হলাম। ভাবলাম পরে মা ফিরলে জানতে চাইবো যে কি আছে ওই কাগজটায় এমন। কিন্তু এই অন্যায় কাজটা করেছি বললে বকাতো খাবোই, দু চারটে কিলচড়ও জুটতে পারে। তাই আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু মনে হালকা ভয় রয়ে গেল, দস্যিপিসি না বলে দেয়। পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি আমাদের বাড়িতে দস্যিপিসি বসে আছে। দূর থেকে চটি দেখতে পেয়েই আমি ভাবছি যাবো, নাকি একটু পাড়ায় চক্কর কেটে আসবো। সবে ভাবতে ভাবতে ঘুরতে যাবো অমনি শুনি পাশের বাড়ির কাকিমা বলছে, ওমা কোথায় চললি? ব্যাস আর কি! বাড়িতে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি পরিবেশ শান্ত, কোন পরিবর্তন নেই। দস্যিপিসি আদর করে ডেকে পাশে বসালো, স্কুলে কি হলো জানতে চাইলো। আমি আড়চোখে দেখলাম কাগজটা আছে কিনা। দেখি সেটা দিব্যি হাতে ধরা, তবে আমি দেখছি দেখেও অতি সাবধানে আগলালো না। দস্যিপিসির ব্যবহারে মনেই হলো না যে কাল অতো বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়েছি। আমি আরও অবাক হলাম।পরে এই নিয়ে কখনো কিছু বলেনি আমি আর!
সময় চলতে থাকলো, আরেকটু বড় হলাম, একটু বোধবুদ্ধি হয়েছে, দস্যিপিসির হাতে আর হামলে পড়তাম না। তবে খুব ইচ্ছে করতো জানতে যে কি আছে ওই কাগজে। বাড়িতে জিঞ্জেস করলে কেউ বলে না, বন্ধু মহলে কেউ জানে না। একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরছি, দেখি দস্যিপিসির বাড়ির দরজাটা খোলা। টিনের দরজা, ভেজানো থাকলে হালকা হাওয়ায় খুলে যায়। আমি ঢুকলাম, দেখলাম দস্যিপিসি অঘোরে ঘুমাচ্ছে আর পাশে সেই কাগজ। লোভ সামলাতে না পেরে হাতে নিয়ে ভাঁজ খুললাম। পড়ে বুঝলাম দলিল বা সম্পত্তি গোছের কিছু লেখা। এতো মন দিয়ে পড়ছিলাম যে দস্যিপিসি কখন উঠে পড়েছে খেয়াল করিনি। “এটা আমার নামে করা একটা উইল, আমায় একজন করে দিয়েছে, হাড়িয়ে ফেললে বিপদ। তাই সাথে নিয়ে ঘুরি।”- এতো লাজুক মুখে ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসি চেপে কথা বলতে আগে কখনো দেখিনি দস্যিপিসিকে। কি সুন্দর দেখাচ্ছিল! কিন্তু ভালো করে দেখবো কি, কথা শুনে আমি তো থ! কাগজটায় কোথাও চাঁপা বা দস্যির কোন নাম নেই। আমি পিসিকে বললাম তোমার নাম কই? বললো “আছে তো, ভালো করে পড়”। আমি আবার পড়লাম, খুঁজে পেলাম না। শুনেছি পিসি ক্লাস এইট পাশ, অক্ষরজ্ঞান আছে। আমি পিসির আঙ্গুল কাগজে রেখে একটা একটা করে শব্দ পড়ালাম, তখন বললো ও তাহলে ওই পাতাটা ট্রাঙ্কে রয়েছে। আমি বললাম তুমি বার করে রেখো, কাল এসে দেখবো। পরের দিন গেলাম, পিসি বললো ভুলে গেছে। এরকম কয়েকবার হওয়ার পর বুঝলাম পিসির কাছে আর কোন কাগজই নেই। পরে জানতে পেরেছিলাম, কোনো দিন কেউ পিসিকে এই কাগজটা দিয়ে বিশেষ কোন প্রতিশ্রুতি করেছিলো। তারপরটা কেউ জানে না। পিসি একাই থাকে, সাথী ওই কাগজ। আমিও আর কিছু বলতাম না, পিসিকে দেখলেই ভাবতাম পিসির যেন এই ঘোর কখনো না কাটে!
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। পিসি কাজকম্ম করে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে কাগজের সাথে বেশ সংসার করছে। আমিও বাইরে চলে গেছি। মাঝে শুনেছিলাম পিসির জমিতে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। জমিটা পিসির ছিলো কিনা সে প্রশ্ন অবশ্য কখনো কাউকে করিনি। হয়তো সেই সদয় ব্যক্তি থাকতে দিয়েছিলো, আর পিসি তাতেই খুশি হয়ে ঘরকন্যা সামলাচ্ছিলো। এখন ফ্ল্যাটের তলায় একফালি একটা দোকান ঘর মতন পেয়েছে পিসি। বাড়িতে, পাড়ার বাকিদের কাছে খোঁজ নিতাম, পিসি নতুন ঘরে কেমন আছে। সবাই বলতো “দস্যি দস্যির মতোই আছে”। মানেটা ভালো বুঝতাম না।
এবারের ছুটিতে বাড়ি ফিরে পিসির সাথে দেখা করতে গেলাম। খুব খুশি আমায় দেখে। একটা ম্যাক্সি আর চাদর নিয়ে গেছিলাম পিসির জন্য। কিন্তু পিসি সে সব না দেখে আমাকে বললো “আমায় একটা পেন দিতে পারিস?”। দিলাম। হাসি মুখে পেনটা নিয়ে উল্টোদিকে ফিরে কি যেন লিখতে বসলো। আমি আসছি বলে চলে এলাম। পরের দিন সকালে দেখি দৌড়ে হাঁপিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকছে। আমি দেখতে পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বললাম এসো, ভিতরে এসো। পিসি বললো, “না রে, ঢুকবো না, অনেক কাজ। তুই আমায় একটা পেন দিবি?”। আমি বললাম, কাল যে দিলাম, চুপ করে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম হারিয়ে ফেলেছে, আরেকটা পেন দিলাম। পেনটা নিয়ে আসছি বলে চলে গেলো। আরও কয়েকদিন পরে, রাতে বাইরে থেকে ফেরার পথে দেখি, পিসি বাড়ির পাশের ল্যাম্পপোষ্টের তলায় বসে কি যেনো করছে। কাছে গিয়ে দেখি মন দিয়ে লিখছে। আমি বললাম, এই অন্ধকারে এখানে বসে লিখছো কেন? বাড়ি চলো। তাকিয়ে দেখি বাড়ি অন্ধকার। পাশ থেকে একজন বলে গেল ইলেকট্রিক সাপ্লাই কানেকশন কেটে দিয়েছে। আমি কিছুটা চুপ করে থেকে বললাম কি লিখছো দেখি। ভরসা করে দেখালো, লেখা থেকে কিছু বুঝলাম না। তবে মুখে বললো, হিসেব লিখছে। আমি বললাম কিসের হিসেব? বললো কাগজে তো নামটা বদলে গেছিলো, তাই অন্য লোক এসে এইখানে ফ্ল্যাট বানিয়েছে। তাদের কোন দোষ নেই, নামটা ভুলবশতঃ অন্য হয়ে গেছে। কাগজটা যে দিয়েছিলো তারও কোন দোষ নেই। পিসি শুধু হিসেবটা লিখে রাখছে। মনে মনে ভাবলাম এই হিসেব তো যে কটা দিন সংসার খেলায় কম পড়লো তার সুদ-আসলের হিসেব! কিছু বললাম না। পিসির মুখে সেই একই লাজুক হাসি, কোনো রাগ অভিমান কষ্ট ভয়, কিচ্ছু নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। গলাটা কিরকম শুকিয়ে এলো। তারপর কোনো কথা না বলে ফিরে এলাম।
সারারাত অন্ধকারে তাকিয়ে রইলাম, ভাবতে লাগলাম কে কাকে ঠকালো! পিসি তো নিজেই নিজেকে প্রতারণা করলো। পিসির এই অন্ধ বিশ্বাস, অদম্য উৎসাহ হিউম্যান বিহেভিয়ারের ভাষায় ঠিক কি? অবসেশন, ডিলিউশন, স্কিজোটিপাল, সাথে প্রচ্ছন্ন নারসিজিম? খুব আফশোস হলো! ছোট থেকে মনে এতো খটকা থাকতেও আগে কেন চিকিৎসা করালাম না! তারপর ভাবলাম, ভালো থাকাটাই যদি ক্লায়েন্ট সেন্টারড্ থেরাপির মূল হয়, তাহলে এরকম ডিসকানেকশন ফ্রম রিয়েলিটি যেন সবাই চাইলে অ্যাচিভ করতে পারে। ভাগ্গিস আমার পিসি দস্যি, তাই হাসি মুখে দাপিয়ে গেলো! এমন দস্যিপিসি ঘরে ঘরে জন্মাক!
ছবি ঋণ: দীপঙ্কর ঘোষ।