গতকাল (৩০.৬.২০২০), পশ্চিমবাঙ্গলার একটি গ্রামীণ হাসপাতালে নাইট ডিউটি দিচ্ছি, সন্ধ্যা ৫.৫৫ নাগাদ, এমন সময় ১বছর ৪/৫মাসের এক বাচ্চাকে তার বাবা-মা এমারজেন্সিতে নিয়ে এল। কি,না বাচ্চাটি একটি বিষে’র কনটেইনার নিয়ে খেলা করছিল। বাচ্চাটির বাবা-মায়ের বয়স ও শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করারই মতো।
তা যাই হোক, ওরা বাচ্চাটিকে কিছুতেই ভর্তি করবে না, কারণ সে সময় বাচ্চাটি একদম সুস্থ ছিল। তার শরীর বা মুখ থেকে বিষের কোনো গন্ধও পাচ্ছিলাম না। এবং বাচ্চাটি নিশ্চিন্তে breastfeed করছিল (মায়ের দুধ খাচ্ছিল)। তাই তাদের দাবী তারা check-up করে নিয়ে যাবে। কিছু হলে ৩ কিলোমিটার দূরে বাড়ি, সহজেই চলে আসবে। বাচ্চাটি সেইসময় clinically সম্পূর্ণ সুস্থ, স্বাভাবিক ছিল। এমনকি তার পিউপিল ( চোখের তারা) ও ঠিকই ছিল।
তবুও আমি একরকম জোর করেই ভর্তি করলাম। মাঝে একবার বাচ্চাটিকে দেখেও এসেছিলাম। এদিকে এমারজেন্সিতে নিয়মমাফিক রোগীর ভিড় লেগেই আছে। যথাসাধ্য পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। রাত প্রায় ৯.৫০ নাগাদ আমি অন্য একরোগী দেখছি। এমন সময় বাচ্চাটির দাদু বাচ্চাটিকে আমার কাছে নিয়ে আসে প্রায় gasping condition-এ (নাভিশ্বাস উঠেছে)। আমি চমকে উঠি। pupil pinpoint (চোখের তারা খুব ছোট)। সঙ্গে সঙ্গে আমি channel (শিরায় ঔষধ দেওয়ার ব্যবস্থা) করে প্রয়োজনীয় সব ঔষধ দিই। এক থেকে দুই-মিনিটের মধ্যে পিউপিল ডাইলেট করে, pulse ও respiration normal (নাড়ির গতি ও শ্বাসকার্য) স্বাভাবিক হয়।
বাচ্চাটি আবার চনমনে হয়ে ওঠে এবং মায়ের দুধ খেতে শুরু করে। আমিও নিশ্চিন্ত হই। তবুও সাবধানতার জন্য আমি তাকে কিছু পরে শিশু ওয়ার্ডে রেফার করি।
এটা ভেবে শিউরে উঠছি যে বাচ্চাটিকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেলে কিংবা আরো দু-এক মিনিট দেরিতে নিয়ে আসলে কি হতো! আজ একটু আগেও তার খবর নিয়েছি। সে সুস্থ আছে, ভালো আছে। আগামী কাল হসপিটাল থেকে discharge (২রা জুলাই ছুটি হয়েছে) হতে পারে। প্রাক ডক্টরস’ ডে-তে, ডক্টরস’ ডে উপলক্ষ্যে একজন ডাক্তার হিসেবে এবং একজন বাবা হিসবে আমার কাছে এরচেয়ে ভালো gift আর কি হতে পারে!
পুনশ্চঃ আমার এই লেখা পড়েই আমার এক শিক্ষক জানিয়েছেন ;“এগুলি আমাদের সাংবাদিকদের কাছে কোন খবর নয়। বাচ্চাটি মারা গেলে মুখরোচক খবর হত। আমরা ফেসবুকে ‘খাপপঞ্চায়েৎ’ বসিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে শুরু করতাম।
গতকাল (১লা জুলাই, ২০২০) দুপুরে আমি একটি মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি থেকে একটি দু বছর বয়সের বাচ্চাকে, কেরোসিন খেয়ে আসায়, ভর্তি হতে বলে শিশু ওয়ার্ডে পাঠাই; পাঁচ মিনিট পরে নেমে এল। ইমার্জেন্সি টিকিটে বাড়ির লোক লিখে দিয়েছে,”বাচ্চাকে ভর্তি করতে রাজী নই”। বাড়িতে এই বাচ্চা খারাপ হলে, এরাই বলবে, “হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে”।
ধন্যবাদ রাজীব, চারিদিকের চুড়ান্ত অবক্ষয়িত সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে বসেও , তোমাদের মত কিছু চিকিৎসক এখনও সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছো দেখে ভালো লাগছে। আত্মঘাতী সমাজ তোমাদের অবদান বুঝলে আখেরে সমাজেরই উপকার।