Sometimes sense hides behind walls. You must find a window … – Katherine Catmull
।। ১ ।।
‘কটনপোলিস’ খেতাবটা তখনও জোটে নি ম্যানচেস্টার শহরের। তারও বহু আগে থেকেই বস্ত্রশিল্পে নিজেদের আসনটা মজবুত করে ফেলেছিল ডাচেরা। হল্যান্ডের আমস্টারডাম ও রটারডাম বন্দর থেকে সুতো, সিল্ক, রঞ্জক বোঝাই জাহাজ পাড়ি দিত নানান দেশের উদ্দেশ্যে। এমনকি খোদ লন্ডনের উদ্দেশ্যেও। ১৬৬৫ সাল, বছরের শুরুর দিকে লন্ডনের এক বন্দরে ভেড়ে এমনই এক ডাচ জাহাজ। একদিকে লন্ডন শহরে যেমন রাজা, উজির, ধনী সম্প্রদায়ের কৌলীন্য আর জাঁকজমকের দাপট, অপরদিকে তেমনই এই শহরেই বাস করেন অগণিত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষজন। সাধারণত লন্ডনের স্টেপনি, সেন্ট জাইলস-ইন-দ্য-ফিল্ড, শোরডিচ, ক্লার্কেনওয়েল, ক্রিপলগেট, ওয়েস্টমিনিস্টার প্রভৃতি অঞ্চলে বাস করতেন তুলনায় গরিব নাগরিকরা। ঘন বসতিপূর্ণ সেই সব অঞ্চলে তখনও উপযুক্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না উপযুক্ত পয়ঃপ্রণালীও। সরু রাস্তা, উন্মুক্ত নর্দমা, মাছি ভনভন উপচানো ডাস্টবিন, মরা প্রাণীদেহ, বাড়ির উচ্ছিষ্ট, দুর্গন্ধময় পরিবেশ ছিল এখানকার নিত্য দিনের ছবি। তার সাথে পাল্লা দিয়েই যেন ছিল ইঁদুর, পথ কুকুর, বেড়ালের উৎপাত। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টিবি, বসন্ত, হুপিং কাশি ইত্যাদি যেন লেগেই থাকতো এই সব অঞ্চলের বাসিন্দাদের।
পশ্চিম লন্ডনের সেন্ট জাইলস-ইন-দ্য-ফিল্ড অঞ্চলের অধিবাসীদের একটা বড় অংশই বন্দর কর্মী ও খালাসির কাজে নিযুক্ত ছিলেন সেই সময়ে। সেদিনও ডাচ জাহাজের মাল খালাস করতে বন্দরে হাজির হয়েছিলেন সেন্ট জাইলস-ইন-দ্য-ফিল্ড অঞ্চলের কর্মীরা। তখনও তাঁরা ভাবতেই পারেন নি যে কি ভয়ঙ্কর এক দুঃসময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। সুতো, কাপড়ের সাথে ভয়ানক প্লেগ রোগের জীবাণু বহন করে এনেছিলেন সেই ডাচ জাহাজের কর্মীরা। ১৬৬৩ সাল থেকে হল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে প্লেগ রোগ ছড়াতে থাকে। দ্রুতই সেখানে মহামারীতে পরিণত হয় প্লেগ। বাণিজ্য সূত্রে অন্য দেশ থেকে হল্যান্ডে আমদানি হয়েছিল সেই রোগ। এখন সেই বাণিজ্য সূত্রেই হল্যান্ড থেকে লন্ডনে ছড়ালো প্লেগ রোগ।
১৬৬৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে ধীরে ধীরে লন্ডন শহরে ছড়াতে শুরু করে প্লেগ রোগ। সেন্ট জাইলস-ইন-দ্য-ফিল্ড অঞ্চলে প্রথমে মারা যান দু’এক জন রোগী। তখনও বিষয়টার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারেন নি প্রশাসন। মে মাসে লন্ডন শহরে ৪৩ জন মারা যান প্লেগ রোগে। জুন মাসে মহামারী আকার নিতে শুরু করে প্লেগ। জুন মাসে লন্ডন শহরে মারা যান ৬১৩৭ জন। জুলাই মাসে মৃত্যু সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৭,০৩৬ জনে। পড়ি কি মরি করে শহর ছাড়তে শুরু করেন লন্ডনবাসীরা। জুলাই মাসেই লন্ডন ছাড়লেন স্বয়ং রাজা দ্বিতীয় চার্লস ও তাঁর পাত্রমিত্ররা। লন্ডন ছেড়ে অক্সফোর্ড শহরে আশ্রয় নিলেন তাঁরা। লন্ডন শহর তখন খাঁ খাঁ করছে। কিছু সঙ্গতিহীন গরিব মানুষ পড়ে আছেন তখন লন্ডনে। আর পড়ে আছেন লন্ডন শহরের মেয়র জন লরেন্স ও অল্ডারম্যানরা (কাউন্সিলর)। রাজার নির্দেশে প্রশাসনিক দিক সামালাতে শহরেই রয়ে গেছেন তাঁরা।
এদিকে কোনো চিকিৎসাও নেই প্লেগ রোগের। সেই সময়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হতো প্লেগাক্রান্তদের। প্লেগাক্রান্তদের বাড়ি চিহ্নিত করতে, সদর দরজায় লাল রং দিয়ে বড় করে ক্রুশ এঁকে দেওয়া হতো। তার তলায় লেখা হতো ‘ঈশ্বর আমাদের দয়া করুন’। প্লেগাক্রান্ত রোগী মারা গেলে, তাঁর মৃতদেহ সৎকার নিয়ে চরম বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হতো পরিজনদের। স্বাভাবিক ভাবেই মৃতদেহ ছুঁতে চায় না কেউই। মৃতের বাড়ির সামনে দাঁড় করানো হতো ঠেলাগাড়ি। ঠেলায় মৃতদেহ তুলে দিতেন পরিবারের সদস্যরা। লন্ডনের অল্ডগেট, সাউথওয়ার্ক, ফিনসবারি প্রভৃতি অঞ্চলে বিশাল বড় বড় গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। সেই গর্তে স্তুপাকৃতি করে ফেলা হতো মৃতদেহ। দুর্গন্ধের কারণে সেই সমস্ত অঞ্চলের ত্রিসীমা মাড়াতেন না কেউই। লন্ডন শহরের অপেক্ষাকৃত ঘিঞ্জি ও নোংরা বসতিপূর্ণ অঞ্চলে প্লেগের প্রকোপ বেশি দেখা গিয়েছিল। সেই থেকে লন্ডনবাসীর ধারণা হয়েছিল, দুর্গন্ধ থেকেই ছড়ায় প্লেগ রোগ। যে সমস্ত নাগরিকরা শেষ পর্যন্ত লন্ডন শহরেই থেকে গিয়েছিলেন, সব সময়েই তাই কিছু সুগন্ধি ফুল রাখতেন তাঁরা জামার পকেটে। ফুলের সুগন্ধে যাতে ঢাকা পড়ে যায় দুর্গন্ধ তথা প্লেগের জীবাণু। কোনো প্রয়োজনে কদাচিৎ যদি বাড়ির বাইরে বেড়তেন কেউ, নাকের কাছে একটা সুগন্ধি ফুল অবশ্যই ধরে রাখতেন তাঁরা। ১৬৬৫ সালের শেষের দিকে প্লেগের প্রকোপ কমতে থাকে লন্ডনে, সম্ভবত প্রবল শীতের কারণে। পরের বছর, ১৬৬৬ সালের ২রা সেপ্টেম্বর, রাত ১টায়, বিধ্বংসী আগুন লাগে লন্ডন শহরে। টানা তিন-চার দিন ধরে জ্বলতে থাকে লন্ডন শহর। লন্ডনের অধিকাংশ বাড়ি তখন কাঠের তৈরি ছিল বলে দ্রুত ছড়াতে থাকে সেই আগুন। প্রচুর ক্ষতি হয় লন্ডন শহরের ও লন্ডনবাসীর। তবে সেই আগুন আবার শাপে বর হয়েও দেখা দিল লন্ডনবাসীর জীবনে। বিধ্বংসী সেই আগুনে মারা পড়ে প্রচুর ইঁদুর। পড়ে জানা যায় এই ইঁদুর থেকেই ছড়িয়েছিল প্লেগ রোগের জীবাণু। ইঁদুরের সংখ্যা কমে যাওয়াতে, ১৬৬৬ সালের পর লন্ডন শহর থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্লেগ রোগ।
।। ২ ।।
১৮৮১ সালে লন্ডন শহর থেকে প্রকাশিত হয় ‘Mother Goose; or, The Old Nursery Rhymes’ নামের একটা ছড়ার বই। প্রাচীন ইংরাজি ছড়া তথা রাইম্সগুলো সংকলন করেন ইংরেজ চিত্রশিল্পী ও শিশু সাহিত্য লেখিকা কেট গ্রিনওয়ে (১৮৪৬-১৯০১)। গ্রিনওয়ের এই বইয়ের শেষ ছড়া ছিল ‘Ring-a-ring-a-roses’। গ্রিনওয়ে সংগৃহীত ছড়াটার জনপ্রিয় রূপটা হলো-
Ring-a-ring o’ roses,
A pocket full of posies,
A-tishoo! A-tishoo!
We all fall down.
ছড়াটা প্রচলিতই ছিল। তবুও, ছাপা হরফে প্রকাশের পর এক ভিন্ন মাত্রা যোগ হলো ছড়াটায়। ‘আরে, এতো প্লেগ রোগের বর্ণনা!’- বলে উঠলেন কিছু গবেষক। তাঁরা ব্যাখা করলেন, প্লেগ রোগে হাত পায়ের মাংস পিন্ড বড় বড় ফোস্কার মতো করে ফুলে উঠে। সংক্রমিত মাংস পিন্ডটা দেখতে হয় হালকা লাল রঙের। আর Ring-a-ring of roses মানে তো লাল গোলাপের মতো গোল গোল দাগ। of-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ‘o’ ব্যবহৃত হয়ে Ring-a-ring o’ roses হয়েছে। posies কথাটার অর্থ পুষ্পস্তবক বা ফুলের পাপড়ি। সেই যুগে তো জামার পকেটে সুগন্ধি ফুল নিয়ে ঘুরতেন লন্ডনবাসীরা। সেই জন্যই তো ছড়াকার লিখেছেন ‘A pocket full of posies’। A-tishoo A-tishoo মানে হাঁচির শব্দ। নিউমনিক প্লেগের সাধারণ লক্ষণই তো হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট। আর We all fall down বাক্যর অর্থ তো এক্কেবারে পরিস্কার- আমরা সবাই মারা পড়লাম। তার মানে এতোদিন যেটা অর্থহীন ছড়া (ননসেন্স রাইম্স) বলে জানতাম আসলে তা অর্থহীন নয়! এতো অর্থবহ!
আধুনিক ছড়া গবেষকরা বলেন, ছড়া আদৌ অর্থহীন (ননসেন্স) নয়। প্রায় প্রতিটি ছড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমকালীন সমাজের কোনো না কোনো একটা ছবি। তা সেই ছড়া বাংলায় লেখা হোক বা ইংরাজিতে। Ring-a-ring o’ roses ছড়াটা সেই কথাই প্রমাণ করছে। Ring-a-ring o’ roses ছড়াটাকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করা মাত্রই, চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় ছড়ার জগতে। তবে অতিমাত্রায় খুঁতখুঁতে গবেষকরা আবার এতো সরল সিধা যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁরা বলেন, ‘সব বখওয়াস, প্লেগের সাথে কোনো সম্পর্কই নেই ছড়াটার’। পাল্টা যুক্তি সাজিয়ে তাঁরা বলেন, ১৬৬৫ সালের পর উৎপত্তি হয় এই ছড়ার, আর ১৮৮১ সালে প্রথম ছাপা হয় ছড়াটা। দীর্ঘ ২০০ বছরের মধ্যে এই ছড়ার অনেকগুলো সংস্করণ তৈরি হওয়া উচিৎ ছিল। কেট গ্রিনওয়ের বইতেই ছাপা হয়েছিল ‘Ring-a-ring-a-roses’, অথচ এখন বলা হয় Ring-a-ring o’ roses । ১৮৮১ সাল থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে এমনই ৫-৬ খানা এমন সংস্করণ প্রচলিত হয়ে গেছে ছড়াটার। ভারতীয় সংস্করণেই তো ‘A-tishoo A-tishoo’ বদলে ‘Husha busha’ ব্যবহার করা হয়। জার্মান, নরওয়ে, আমেরিকায় ব্যবহার করা হচ্ছে পৃথক সংস্করণ। ৫০-৬০ বছরের মধ্যেই তৈরি হয়েছে এতোগুলো সংস্করণ। আর ছড়া প্রকাশের পূর্ববর্তী ২০০ বছর ধরে একটাই সংস্করণ চলে আসছে ছড়াটার? এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই ছড়া সাম্প্রতিক কালে লেখা। ১৬৬৫ সালের প্লেগের সাথে Ring-a-ring o’ roses কোনো সম্পর্ক নেই বলেই তাঁরা মনে করেন।
কেট গ্রিনওয়ের Mother Goose প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর পরই, ১৮৮৪ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয় উইলিয়াম ওয়েলস নিওয়েল (১৮৩৯-১৯০৭) সংকলিত ‘Games and songs of American children’। ইউএসএর লোকগাঁথা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নিওয়েল লিখেছেন, ১৭৯০ সালে ম্যাসাচুসেটস্ প্রদেশের বেডফোর্ড অঞ্চলে সুর সহযোগে প্রচলিত ছিল এই ছড়াটা। ইংলন্ড থেকেই যে আমেরিকায় এসেছে এই গানটা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ আমেরিকায় ইংরেজি ভাষাটাই আসে ইংরেজদের হাত ধরে। অর্থাৎ, ১৭৯০ সালের বহু আগেই, আনুমানিক প্রায় ১৭১০-২০ সাল নাগাদ ইংলন্ডে এই ছড়ার প্রচলন ছিল বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্লেগ মহামারী হয়েছিল ১৬৬৫ সালে, আর ছড়ার প্রথম হদিশ পাওয়া যায় ১৭১০-২০ সাল নাগাদ। মাঝে বছর পঞ্চাশের ফাঁক থাকছে। গান বা লোকগাথার প্রচারে সময়ের এই ব্যবধানটা কোনো সমস্যাই নয় বলে মনে করেন অনেকে। আর সংস্করণ বিতর্কে জলে ঢেলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণগুলো এসেছে ছাপা হরফে প্রকাশের পর। ছড়াটা যতদিন পর্যন্ত ছাপাই হয় নি, ততদিন পর্যন্ত সংস্করণের কোনো প্রশ্নই উঠে না। জোরের সাথেই তাঁরা মনে করেন, ১৬৬৫ সালের লন্ডন প্লেগের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান এই ছড়ার। কিছু বিতর্কের কথা মাথায় রেখে, আমরা তাই বলতেই পারি, Ring-a-ring o’ roses শুধু আমাদের ছোটোবেলার স্মৃতিই নয়, এই ছড়ার সাথে জড়িয়ে আছে প্লেগ রোগের স্মৃতিও।