সোমবার, বৃহস্পতিবার সকালে ঘোলায় চেম্বার থাকে। সেখানে রোগী দেখা শেষে বাড়িতে ঢুকতে দেরী হয়ে যায়। বাড়িতে তারমধ্যে বেশ কিছু রোগী উপস্থিত হয়ে যান। ফলে ঘোলা থেকে ফিরেই আমাকে বাড়িতে রোগী দেখা শুরু করতে হয়।
এই সোমবারও যখন বাড়ি ফিরলাম এগারোটা বাজে। অনেকেই চলে এসেছেন। গৌর আর পার্থ পরপর সকলকে টোকেন দিচ্ছে।
স্কুটার থামাতেই দুজন মেডিকেল রিপ্রেজেণ্টেটিভ এগিয়ে এলেন। বললাম, ‘আজ আর বৃহস্পতিবার তো আপনাদের সাক্ষাৎ নেওয়া হয় না।’
ওরা বললেন, ‘জানি, ভুল করে এসে গেছি। প্রোডাক্ট লিস্টটা দিয়েই চলে যাব। কাল বা পরশু আসব।’
আমি কোনো রকমে দু মুঠো ভাত খেয়েই খুপরিতে ঢুকলাম। এবার চারটে- সাড়ে চারটে অবধি একটানা রোগী দেখা চলবে। তারপর আবার মনোরমার খুপরিতে ছুটতে হবে। ধুর… এই খুপরি জীবন বড্ড একঘেঁয়ে।
প্রথম রোগীই এক থুড়থুড়ে বুড়ি। একটা গাছের ডালের লাঠি ভর করে টুকটুক করে খুপরিতে ঢুকলেন। জ্যালজেলে শাড়ি পরনে। বুড়িমার মাজা বেঁকে গেছে। তাঁর হাজার রকম সমস্যা। এখন মূল সমস্যা ব্যথা। পা থেকে মাথা অবধি সর্ব অঙ্গে ব্যথা।
ইনি আগেও অনেকবার দেখিয়েছেন। সাতকূলে কেউ নেই। কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবেন না। ক্লিনিক্যালি দেখে ওষুধ দিতে হবে। ওষুধটাও দিয়ে দিলে ভালো হয়।
বুড়িমা যাওয়ার সময় দুটো হাঁসের ডিম জোর করে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘তুই তো আর ভিজিট নিবি নে। কিছু না দিলে রোগ সারবে নে।’
পরের রোগী একজন মাঝ বয়সী মহিলা। বেশ পরিশ্রম করা চেহারা। সম্ভবত একাধিক বাড়িতে গৃহ সহায়িকার কাজ করেন। তাঁরও নানা সমস্যা। একেবারেই ঘুম হয় না। কিন্তু বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, ঘুমের ওষুধ দেবেন না। ভোর চারটেতে উঠতে হয়।’
তিনি ডাক্তার দেখিয়ে দিব্যি গট গট করে চলে গেলেন। ভিজিট দেওয়ার ব্যাপারে উচ্চ বাচ্য করলেন না। একটু খারাপ লাগল। আর্থিক সমস্যা থাকলে বলতে পারতেন। ভিজিট নিতাম না। কিন্তু একবার বলা উচিৎ ছিল।
তার পরের রোগী আমারই সমবয়সী একজন ভদ্রলোক। পোষাক আষাক ফিটফাট। ডায়াবেটিসের রোগী। ইনসুলিন চলে। বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার দেখিয়ে বেড়ান। কারোর চিকিৎসাতেই সন্তুষ্ট হন না।
ভদ্রলোককে বললাম, ‘এভাবে ঘন ঘন ডাক্তার পাল্টাবেন না। তাতে আপনারই ক্ষতি হবে।’
‘আসলে আমার বড় শালা আর পাশের বাড়ির একজন বললেন আপনাকে একবার দেখাতে। ওনারা আপনাকে দেখান। ইনসুলিন ছাড়াই ওদের সুগার কন্ট্রোলে আছে। আপনি ইনসুলিন বাদ দিয়ে শুধু ওষুধ করে দিন না।’
‘দেখুন, সব ডায়াবেটিসের রোগীর চিকিৎসা এক রকম নয়। ওনাদের যা অবস্থা তাতে ওষুধেই হবে। কিন্তু আপনার দীর্ঘ দিনের ডায়াবেটিস। প্রথম থেকে সুগার ঠিক ঠাক কন্ট্রোলও ছিল না। ইনসুলিন বন্ধ করে দিলে আপনার ক্ষতি হবে। জেনে বুঝে একজন রোগীর ক্ষতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
ভদ্রলোক বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। প্রেসক্রিপশন নিয়ে গোমড়া মুখে উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলাম আমাকেও এনার পছন্দ হয়নি। উনি কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন ডাক্তারের খোঁজ করবেন।
আমাকে আশ্চর্য করে এই ভদ্রলোকও ভিজিট না দিয়ে চলে গেলেন। পেছন থেকে ডাকতেও পারলাম না। কী ব্যাপার? আজ কি কেউ আমায় ভিজিট দেবে না? এই ভদ্রলোককে দেখে তো দিব্যি আর্থিক ভাবে সচ্ছল বলে মনে হচ্ছিল। নাকি উনি স্কুলে আমার সাথে পড়তেন? নাকি কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয়? দেখে তো চেনা বলে মনে হচ্ছিল না।
পরের রোগী একজন মাঝ বয়সী মহিলা। বসিরহাটে বাড়ি। এনাকে আগে কোনদিন দেখিনি। দেখা হয়ে যাওয়ার পর ইনিও দেখি ভিজিটের ব্যাপারে উচ্চ বাচ্য না করে প্রস্থান করছেন।
ততক্ষণে নিশ্চিত এনাকে আমি কোনোভাবেই চিনি না এবং এনার কোনো আর্থিক সমস্যাও নেই। এভাবে সকলে আমার ভিজিট না দিয়ে চলে গেলে আমি তো নিজেই আর্থিক সমস্যায় পড়বো। চাকরি বাকরিও ছেড়ে দিয়েছি। এই ভিজিট টুকুই ভরসা। লাজ লজ্জা ত্যাগ করে পিছু ডাকলাম, ‘দিদি, আমার ভিজিট টা দিয়ে যাবেন।’
ভদ্রমহিলা রীতিমতো অবাক হলেন, ‘ভিজিট? বাইরে যে দেখলুম…’
‘বাইরে কী দেখলেন?’ আমি আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘বাইরে বড়ো করে নোটিশ টাঙানো আছে সোম আর বৃহস্পতিবার আপনি ভিজিট নেবেন না। একেবারে গেটের বাইরেই।’
গৌর কে ডাকলাম। বললাম, ‘ইনি কী বলছেন? বাইরে নাকি নোটিশ ঝুলিয়েছো সোমবার আর বৃহস্পতিবার ডাক্তারবাবু ভিজিট নেবেন না।’
গৌর হাসিমুখে বলল, ‘আপনিই তো বললেন নোটিশ টানাতে। সোম ও বৃহস্পতি আপনি ‘এম আর’ ভিজিট করবেন না। সেটাই বড় করে লিখে টানিয়ে দিয়েছি, যাতে সকলের চোখে পড়ে। না হলে সকলকে আলাদা আলাদা করে বলতে হচ্ছে।’
বললাম, ‘নোটিশটা নিয়ে আসো তো।’
গৌর সাদা কাগজ লাগানো বড়ো একটা পিচবোর্ড নিয়ে এল। তাতে লাল কালিতে উপরে লেখা “এম আর ভাইদের জন্য”। নীচে লেখা “সোমবার আর বৃহস্পতিবার ডাক্তারবাবু কোনো ভিজিট নেবেন না”
নাহ্, এই খুপরি জীবন যতোটা একঘেঁয়ে ভাবছিলাম ততোটা একঘেঁয়ে মোটেও নয়। প্রতিদিনই এই বদ্ধ খুপরিতে আজব আজব ঘটনা ঘটে।