অনেকদিন বাদে লিখতে বসেছি। অবসর সময় ক্রমশ কমে আসছে। লেখার ইচ্ছে-টিচ্ছেও প্রায় নেই। অথচ একটা সময় মনে হ’ত, না লিখে থাকতে পারছি না। রোজকার ছোটোখাটো খুঁটিনাটি লিখে রাখতে ইচ্ছে হ’ত। ক’দিন না লিখলে নিজেরই কেমন অস্বস্তি হ’ত। স্বীকৃতির চাপও থাকতো বোধহয়। লোকে ভালো বললে মনে মনে কলার তোলেন না এমন মানুষ সম্ভবত মঙ্গলগ্রহেই মেলে। কিন্তু শুধুমাত্র সেসবই নয়, শুধুই লাইক-শেয়ার গোনার উদগ্র বাসনা নয়। লেখাগুলো কখন যেন আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনের সাথে মিলেমিশে গেছিল। সে সব দিন গেছে। লেখারা আর কিলবিলিয়ে ওঠে না। বুকজুড়ে নরম আঙুল রাখে না। এখন শুধু সময়ের সাথে ভেসে যাওয়া…
ক’দিনে প্রচুর পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অগুনতি লাইভ অনুষ্ঠান দেখলাম। বেশিরভাগই আগে দেখা। তবু বারবার দেখতে ভালো লাগে। কী সব মানুষ! কী তাঁদের উচ্চতা! এত অজস্র অর্জনের পরেও কী আলগোছে জীবন কাটিয়ে দেওয়া! আমার কাছে মনের শান্তি মানে ওই পাঁচ থেকে আটের দশকের পৃথিবী। খুব সম্ভবত সে ভালো লাগার আবেশ কোনোদিনই কাটবার নয়। হাসপাতালে কাজের চাপ সামান্য হলেও কমেছে। বুকে সাঁইসাঁই, ঘড়ঘড় আর শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা খানিকটা কমের দিকে। সপ্তাহখানেক আগেও পাঁচ মিটার দূর থেকে রোগী দেখে বলে দিতে পারতাম, সম্ভাব্য রোগটা কী। ওয়ার্ড, আইসিইউ, আউটডোর সব উপচে পড়ছিল। সত্যি বলতে, এত এত এত্তওওও রোগী এলে কাউকেই ঠিক করে দেখা হয়ে ওঠে না। নিজের কাছেই অতৃপ্তি থেকে যায়। ডাক্তারিটা আমার কাছে খাওয়া, ঘুমোনো, শ্বাস নেওয়ার মতোই। আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য অনুযায়ী ‘ঠিক করে’ না দেখতে পারলে সারাদিন মনের মধ্যে খচখচানি চলতে থাকে। অথচ, সবসময় উপায় থাকে না। খুব বেশি হ’লে দু’মিনিটে এক-একজনকে না ছাড়তে পারলে আমার দুপুরের খাওয়া বিকেল পাঁচটায়। আর রোগীর লাইনে সুনিশ্চিত মারামারি। ওদিকে যিনি পাঁচ ঘন্টা ট্রেনে-বাসে এসে দেখাতে এলেন তাঁর মনে হবে, “এতদূর কষ্ট করে এলাম… ডাক্তার ভালো করে দেখলোই না শালা!”
কোভিড রোগীর জন্য নির্ধারিত আইসোলেশন ওয়ার্ডেও খুব বেশি রোগী বাড়েনি। তবে যারা আসছে তাদের বেশিরভাগই সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ। তথ্য বলছে, রোগীর সংখ্যা বিক্ষিপ্তভাবে বাড়লেও তৃতীয় ঢেউয়ের মতো পরিস্থিতি আসেনি। জানি না, সংখ্যাগুলো সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য নাকি সাধারণ সর্দিকাশির আড়ালে কোভিড এখনো গোকুলে বাড়ছে। যাই হোক, অন্তত মারাত্মক অসুস্থ শিশুর সংখ্যা যে নিয়ন্ত্রিত, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এমনিতেই ঋতুপরিবর্তন জনিত শ্বাসকষ্টের বাড়বাড়ন্ত চলছে। তার সাথে তৃতীয় ঢেউ জুড়লে আর খাওয়া পরার সময় থাকতো না। সেসব দিক দিয়ে নিশ্চয়ই স্বস্তির ব্যাপার। তবু ভয় এখনো অমূলক নয়। ফলের আশা না রেখে প্রতিবারের মতো বলে যাই, এখনো মাস্ক খোলার সময় আসেনি।
বারবার সায়ন্তিকার কথা মনে পড়ছে। পাঁচ বছরের মেয়ে। দু’মাসের জ্বর। বুকে-পেটে জল। সাংঘাতিক ইনফেকশন। বাবা রাজমিস্ত্রীর জোগানদার। এসব বাড়ির সেই পরিচিত গল্প যেমন হয় আর কী… হোমিওপ্যাথি, হাতুড়ে সব ঘেঁটেঘুঁটে শেষে সরকারি হাসপাতালে। কফ পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের পাশেই সরকারি টিবি পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলাম। রাস্তায় কোথায় দালালের খপ্পরে পড়ে কোন বেসরকারি ল্যাবে সাতাশশো টাকা খসিয়ে এসে হাত কচলাতে কচলাতে বলছে- এত টাকা লিয়ে লিল ডাক্তারবাবু…
আকাশ থেকে পড়লাম। গরীবগুর্বো, বোকাসোকা লোকগুলোকে ঠকানোর জন্য চারদিকে সব জাল বিছিয়ে ওঁত পেতে বসে আছে। সারাদিন ধরে মেজাজটা খিঁচড়ে ছিল। এটাসেটা পরীক্ষার পর সায়ন্তিকার এসএলই ধরা পড়েছে। খুব জটিল একটা রোগ। শরীরের অনাক্রম্যতা নিজেই নিজেকে ভুলে যায়। নিজের সাথে লড়তে গিয়ে নিজেকেই রক্তাক্ত করে। সর্বাঙ্গে প্রদাহ শুরু হয়। ইনফেকশনটাও বিচ্ছিরি। জ্বর কমছে না। ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আইসিইউ থেকে বেরোতে যাচ্ছি, সায়ন্তিকার বাবার সাথে দেখা।
– ডাক্তারবাবু… বড্ড অস্পষ্ট, কুন্ঠিত উচ্চারণ।
– ডাক্তারবাবু, আজ সায়ন্তিকার জন্মদিন।
ব্যাস! আগে-পরে আর কিচ্ছু না। তারপর বেশ দীর্ঘ নীরবতা। কিছু কিছু মুহূর্তে কথার জোর বড্ড পানসে মনে হয়। বাবার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বেরিয়ে আসি। এখনো মানুষ ডাক্তারকে বিশ্বাস করে দু-ফোঁটা চোখের জল, এক চিলতে একান্ত অনুভব দিতে চায় তাহলে! অথচ কতটুকুই বা করতে পারি? একটা ডায়াগনোসিস, ক’টা ওষুধ। কখনো কখনো সেটুকুও সম্ভব হয় না। সায়ন্তিকাও সেরে উঠবে কিনা জানি না। গোটা শরীর ফুলে উঠেছে। অসহায় বাবা রোজ এসে শুনে যায় মেয়ের সেরকম কিছু উন্নতি নেই। কোনোদিন কোনও অভিযোগ শুনিনি। শুধু এসে জানিয়ে গেছে আজ মেয়ের জন্মদিন। এই মুহূর্তগুলোর জন্যই তো ডাক্তার হতে পারা সার্থক।
ওদিকে তখন এক মা হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে উল্টে পড়েছে। চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি পড়ে গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা-টিকিৎসা করার পর বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হ’ল। অনেকবার ডাকার পর মেয়েটির বরকে খুঁজে পাওয়া গেল। সব দেখেশুনে দিব্যি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে দিল, “উ কিচু হবেনিক। ফুঁ দিয়্যা ঝেড়ে দিলি ঠিক হই যাবে।” আগে আগে এসব শুনলে তেড়ে গালাগালি করতাম। এখন চট করে মাথা গরম হয় না। এরা যে আর্থ-সামাজিক পরিবেশ থেকে আসে সেখানে এসব অন্ধবিশ্বাস খুব স্বাভাবিক। বরং, এটা আমাদের মতো তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তদেরই ব্যর্থতা যে আমাদের কথা ওদের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। এই যে এত কিছু লিখছি এগুলো যাদের পড়ার কথা তারা কেউ এসব পড়ে না। তাদের প্রতিদিনের জীবনে ফুঁক, জ্বীন, তাবিজ অনেক বেশি করে সত্যি। দেখার চোখ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বয়স বাড়ছে…
এই সব কিছুর সাথেই আরও একটা বছর পার করে ফেললাম। আজও সারা সকাল পেরিয়ে বিকেল অব্দি রোগী দেখেছি। শিশু দিবসে জন্ম আবার শিশুদের জন্যই কাজ করি; মাঝে মাঝে ব্যাপারটা ভাবলে কেমন পদ্যের ছন্দমিলের মতো মনে হয়। বাচ্চাগুলো সুস্থ হওয়ার পর হাসিটা দিয়ে যায়। কিছু মানুষ আমাকে বিশ্বাস করেন, ভালোবাসেন। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের কাছে এটা বিরাট পাওয়া। জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তার প্রত্যুত্তরে ‘ধন্যবাদ’ বলাটা বড্ড কাঠখোট্টা শোনায়। সবাইকে প্রত্যুত্তর দিতে পারিনি। তবে ভালোবাসা মাথা পেতে নিলাম। অতিমারী কেটে যাক। সব সায়ন্তিকারা সুস্থ হয়ে উঠুক।