১.
মাঝরাতে হঠাৎ দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় অভীকের। বিছানার পাশেই স্টিলের গ্লাসে জল রাখা থাকে। ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে নিয়ে একটু ধাতস্ত হয়।
কী বিচ্ছিরি স্বপ্ন! অভীক একটা খাড়াই পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে আর কেউ নেই। যেদিকে দু’চোখ যায় অগুনতি চিতা জ্বলছে। আর্ত চিৎকার আর পোড়া গন্ধ ছাড়া বুঝি এ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। গান নেই, প্রজাপতি নেই, নদী নেই। যতদূর.. যতদূর দেখা যায় ঘন অন্ধকারে শুধুই জ্বলন্ত চিতা..
একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর অনেকক্ষণ ঘুম আসে না অভীকের। উঠে একবার বাথরুম যায়। ফিরে এসে বিছানায় ছটফট করতে করতে মাথার কাছে মিউজিক প্লেয়ারটায় গিটারে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দেয়। কখন যেন ঘুম আসে..
২.
সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন বেশ বেলা হয়েছে। সকালের আলোয় চারদিক ভরে গেছে। এ’কদিন লক-ডাউনের জন্যই সম্ভবত পাখিদের আনাগোনা বেশ বেড়ে গেছে। সকাল হলেই অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির। চায়ের কাপটা নিয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। বেশ ফুরফুরে লাগছে। রাতের দুঃস্বপ্নের চিহ্নমাত্র নেই।
স্নান করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় অভীক। আগেই সবাইকে বলা ছিল, আজকের পর আর রোগী দেখবে না। সব ধরনের সুরক্ষা ছাড়া রোগী দেখা বেশ বিপজ্জনক। মহামারী শুরু হতেই সোমলতা মেয়ে তনিমাকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে গেছে। অবশ্য, অভীকই একপ্রকার জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়ে পাশে থাকলে কাঁহাতক আর দূরে দূরে থাকা যায়? এদিকে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে একটা হামি খেতে গেলেও মনে হয় অজান্তে জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছি না তো? সারাক্ষণই তো হাঁচি-কাশি-জ্বর নিয়ে কারবার..
৩.
পাড়ার মোড়ে মোড়ে জমজমাট আড্ডার আসর বসেছে। জমায়েত থেকেই মুহূর্মুহু কথা ভেসে আসছে..
– বা*র ডাক্তার সব!! এত নাকি বড় বড় হাসপাতাল সব। একটা রোগ কন্ট্রোল করতে পারে না..
– টিভি খুললেই কত বাতেলা। কে নেই বল তো? বুদ্ধিজীবী, নেতা,মন্ত্রী, পুলিশ, ডাক্তার.. কে নেই? আরে ভাই, একটা রোগ সারাতে পারছিস না আজ এতদিন হ’ল। শুধু পাবলিক হ্যারাসমেন্ট..
আরও একটু রাত বাড়ে। অন্ধকার পাড়া ভরে ওঠে মোমবাতির আলোয়। দূরে বাজি ফাটার আওয়াজ আর সম্মিলিত চিৎকার..
৪.
পাঁচ দিন হ’ল অভীক আর রোগী দেখছে না। দূরের গ্রামগুলো থেকে বহু রোগী ডাক্তার দেখাতে এসে ফিরে গেছে। শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসার জন্য গাড়ি পাওয়া মুশকিল। অ্যাম্বুলেন্সগুলো দ্বিগুণ টাকা চাইছে। অগত্যা গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে ভিড় জমিয়েছেন অনেকে।
মন্মথবাবুর হাঁপের টানটা বেড়েছে আবার। ঘোষপাড়ার হরি মন্ডল টোটো চালায়। ছেলের আজ আটদিন জ্বর। কোয়াক ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়েছে। মুদিখানা দোকানের সাইদুলের অসহ্য গাঁটে ব্যথা।
মানুষের কাজ বন্ধ। বাজারে আগুন। তবু খিদে পেয়ে যায় বে-আক্কেলে..
৫.
পাঁচদিন বাদে ডা. অভীক চৌধুরীকে আবার রোগী দেখতে দেখে হাঁফ ছাড়ে এলাকার মানুষ।
বাড়িতে হাত গুটিয়ে বসে থাকা অভীকের সইছিল না। এ ক’দিন অনেক ভেবেছে সে। তারপর, খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই আবার রোগী দেখা। পেশেন্টের সাথে একজন ছাড়া বাড়তি কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ভেতরে আসছেন। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে।
৬.
একলা হলেই মেয়ের মুখটা বড্ড মনে পড়ে। কতোদিন ভালো করে মেয়েকে কোলে নেওয়া হয়নি..
মুখ থেকে ডাক্তারের ছদ্ম গাম্ভীর্য খসে পড়ে। ডাঃ অভীক চৌধুরী এখন শুধুই একজন অসহায় ‘বাবা’। স্টেথোস্কোপ আর মেয়ের হাসিমুখ দাঁড়িপাল্লার দুদিকে চাপিয়ে ক্রমাগত দুলতে থাকা একটা পাঁচফুট এগারো ইঞ্চি শরীর..
অভীক স্বপ্ন দেখে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। পাবলিক বাসে ঘামতে, ঘামতে ফিরবে অফিসফেরত মানুষ, স্কুলগুলো আবার মুখর হবে, ট্রেনে চানাওয়ালা হাঁক দেবে, দু-নম্বর প্লাটফর্মের সিঙাড়া-চপের দোকানটায় আবার ভিড় জমবে। একতারার ট্যাং, চায়ের কাপের টুং, সাইকেলের ক্রিং, নতুন শাড়ির খস, সস্তা জুতোর চট, চুলের ক্লিপের খট.. আবার ভরে উঠবে থমথমে পৃথিবী..
রাতে চাঁদের আলোয় ভেসে যাবে নির্জন ছাদ। তনিমাকে কোলে নিয়ে অভীক কবিতা বলবে। ততদিনে ‘আমাদেল থোতো নদী’কে ‘আমাদের ছোট নদী’ বলতে শিখে গেছে সে।
জ্বলন্ত চিতা আর অভীকের দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে না। বৃষ্টির জলে কবেই নিভে গেছে সব। শুধু কিছু পোড়া কাঠকয়লার দাগ দেখা যায়..
খুব তাড়াতাড়ি গল্প টা শেষ করলেন। যদি সময় থাকে ফোন করবেন___6297926930.