রোগী দেখা শেষ করে সবে রুটি আর ঝিঙেপোস্ত দিয়ে লাঞ্চ সারছি চেম্বারে বসেই, এমন সময় কম্পিউটারের স্ক্রীনে ভেসে উঠল আপডেট- ‘মহামান্য হাইকোর্ট রানী রাসমনি রোডে দ্রোহের কার্নিভ্যালে অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।’
সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম ধর্মতলার উদ্দেশ্যে। চারটের মধ্যে পৌঁছতে হবে। পেশাগত প্রয়োজন ছাড়া গত তিরিশ বছরে উৎসাহের সাথে এমন বে-রুটিন দৌড় তো কখনো দৌড়ই নি!
ভাগ্যিস অপারেশন নেই আজ বিকেলে। রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে সকাল থেকে চোখ রাখছিলাম খবরের দিকে। কলকাতা পুলিশ প্রবল আক্রোশে দ্রোহের কার্নিভ্যাল ভেস্তে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। গোঁফ চোমড়ানো নাথুলালের ভায়রাভাই ডোরিনা ক্রশিং থেকে শুরু করে রাসমনী রোড- গোটা ময়দান চত্বর জুড়ে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৬৩ ধারা জারী করেছেন। ছয় সাত-ফুট উঁচু গার্ডরেলের পর গার্ডরেল, ব্যারিকেড, মোটা মোটা লোহার শিকল, তালা ইত্যাদিতে একেবারে লৌহ আবরণে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। ছবি দেখে বোঝা মুশকিল যে একদল নিরীহ নিরস্ত্র লোক আসছে নাচ-গান-আবৃত্তি করতে বা ঢাক বাজিয়ে প্রতিবাদ করতে। মনে হচ্ছে কোনো বিদেশী সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী আসছে কলকাতা দখল করতে! একমাত্র রেড রোডে প্রবেশের রাস্তা খোলা।
এইরকম আবহে সকাল থেকে ভাবছি যাব কি যাব না! শিরদাঁড়ার চিকিৎসা করি ঠিকই। কিন্তু এই মাঝবয়সে নিজের শিরদাঁড়াটা কি আর অত শক্তপোক্ত আছে? নিশ্চিত ভাবে নেই। আমরণ অনশনরত তরুণ-তরুণী দের কথা ছেড়েই দিলাম (একদিন অরন্ধন, আর একদিন প্রতীকি অনশন করে পিচ বুঝে গেছি- কতক্ষণ ব্যাটিং করতে পারব) – শিরদাঁড়াটা ডাঃ তপোব্রত বা ডাঃ ঐন্দ্রিলের মতও আর নেই। ঐন্দ্রিল লিখেছে, ‘দ্রোহের কার্নিভ্যালে যাবই। যেখানে আটকাবে, সেখানেই বসে পড়ব- সেটা শিয়ালদায় হলেও।’ কিন্তু আমি কি করি- বসে তো পড়ব, উঠতে পারব কি?
এরকম দোটানার মধ্যে হাইকোর্টের অর্ডার। তার পরেই খবরে দেখাচ্ছিল শিকল খুলে যাচ্ছে গড়গড় করে। পুলিশকর্মীরা নিজেরাই সরিয়ে ফেলছে ভারী ভারী গার্ডরেল আর ব্যারিকেড। তার ফাঁক দিয়ে পিল পিল করে ঢুকছে জনতা। একসাথে শাঁখ আর ভেঁপু বাজিয়ে। মোহনবাগান বা ইষ্টবেঙ্গল ডার্বি জিতলে যেমন হয়- অবিকল তেমন ছবি। কারো বুকে ফেষ্টুন ‘রাজপথ ছাড়ি নাই’, কারো হাতে প্ল্যাকার্ড ‘আর জি করের বিচার চাই’। ঢাক-ঢোল,বাঁশী, ভেঁপু বাজতে শুরু করেছে।
মোবাইল ফোনে এইসব দেখতে দেখতে মেডিক্যাল কলেজ। রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য কালো গ্যাস বেলুন। তারপর গনেশ অ্যাভিনিউ-এর কাছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ব্যারিকেড করে আটকালো পুলিশ। ‘যেতে নাহি দিব।’
কুছ পরোয়া নেই। দুটো পা তো আছে! গাড়ি থেকে নেমে হন্টন। ডোরিনা ক্রসিং পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম অকুস্থলে। সেখানে তখন জনসমুদ্র। পিলপিল করছে লোক, গিজগিজ করছে মাথা। চিকিৎসক, অ-চিকিৎসক বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র অনেকের সাথে দেখা হয়ে গেল। ঢাক বাজছে, গান হচ্ছে। কবিতা, স্লোগানে গমগম করছে এলাকা। রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা বাসের মাথায় চড়ে সেদিকে ক্যামেরা তাক করে রয়েছে টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা। অথচ কেউ কাউকে বাসে চড়িয়ে, নেমন্তন্ন করে, কার্ড পাঠিয়ে নিয়ে আসে নি। কেউ কাউকে একমুঠো মুড়িও খাওয়াচ্ছে না- ডিম্ভাত বা বিরিয়ানির প্যাকেট তো দূরের কথা! তবু জনতা নাছোড়। বাধা পেয়ে তারা যেন দশগুণ উৎসাহে ধেয়ে আসছে ধর্মতলার দিকে।
রাস্তায়, ফুটপাথে তিলধারণের জায়গা নেই। বন্ধুবান্ধব, পরিচিত অনেকেই এসেছে বা আসছে খবর পেয়েছি- কিন্তু কারো সাথেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। কারণ মোবাইল ফোন কাজ করছে না। সম্ভবতঃ জ্যামার বসিয়েছে। তার মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যাচ্ছে। মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে। কর্পোরেট হাসপাতালের ওড়িয়া বা দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তার বুকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বা বেগম রোকেয়ার ছবিওলা পোষ্টার লাগিয়ে ঘুরছে। তারা জানতে চাইছে এঁদের গুরুত্ব ও আত্মত্যাগের গল্প। চিৎকার করে বোঝাতে হচ্ছে সেসব। নাহলে শোনা যাবে না- এত ভীড়! কেউ কেউ বলছে, ‘এটা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে হলে ভাল হত।’ কেউ বলল, ‘এটাই ১৬৩ ধারা জারি করে আটকে রেখেছিল, আবার ব্রিগেড!’
ভীড়ের ঠেলায় ঘেমে-নেয়ে প্রায় দম আটকে গেল। তবু কার্নিভ্যালের কেন্দ্রে পৌঁছনো গেল না। আট থেকে আশী সবাই নেমে পড়েছে বিচার চাইতে।
বিদেশে দু-একবার কার্নিভ্যালে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এত ভীড় কোথাও দেখিনি। কার্নিভ্যাল নামক উদযাপন শুরু হয়েছিল মধ্যযুগীয় ইউরোপে। তখন ক্যাথলিকরা বছরের একটা সময় চল্লিশদিন ধরে মাংস খেত না। তার ঠিক আগের দিন নাচ, গান, হৈ-চৈ, খাদ্য-পানীয় সহযোগে শহর বা গ্রামের রাস্তায় সাধারণ মানুষ ভ্রাম্যমাণ উৎসবে মেতে উঠত। অদ্ভুতদর্শন পোষাক পরে, মুখে রং মেখে, রঙীন মুখোশ পরে রোজকার একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবন থেকে বেরিয়ে একদিন অন্যরকমভাবে মাংস বর্জনের সূচনা করত। কার্নিভ্যাল কথাটাই এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘কার্নি ভেলে’ থেকে। যার অর্থ ‘মাংস বিদায়’।
আর আধুনিক কার্নিভ্যালের উদ্ভব ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো-তে। সেখানে অগণিত মানুষ রঙীন পোষাক পরে নাচ, গান, খাদ্য, পানীয়, সার্কাসের মাধ্যমে রাস্তায়, সমুদ্র সৈকতে ভ্রাম্যমাণ গণউৎসব পালন করে।
তার মানে কার্নিভ্যাল হল এক ভ্রাম্যমাণ গণ উৎসব। সরকারি উদ্যোগে সাজানো কোনো আয়োজন নয়- যেখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত কয়েকজন শিল্পী রাস্তার পাশের মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনষ্ঠান করবে আর আমন্ত্রিত কিছু দর্শক সেটা দেখার সুযোগ পাবে। জনসাধারণের অংশগ্রহণে এ এক স্বতঃস্ফুর্ত ছকভাঙা উদযাপন, যার সাথে কোনো বড় মেলার কিছুটা তুলনা চলতে পারে।
এই দূর্গাপুজোর শেষে সিনিয়র ডাক্তারদের অনেকগুলো সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ‘জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স’-এর আহ্বানে এই স্বতঃস্ফুর্ত দ্রোহ কার্নিভ্যাল চলল প্রায় চার ঘন্টা। উদ্দেশ্য, আরজিকরের স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষনরত ডাক্তারী ছাত্রীর নৃশংস হত্যা ও ধর্ষণের সঠিক তদন্ত ও বিচার দাবী করা এবং গণআন্দোলন দমন করে মানুষকে উৎসব পরবর্তী কৃত্রিম শোভাযাত্রায় ভুলিয়ে রাখার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। তবে এই স্বতঃস্ফুর্ত গণপ্রতিবাদকে আটকানোর সরকারী ও পুলিশী প্রচেষ্টা কম হল না। প্রথমে অনুমতি না দেওয়া, তারপর প্রায় পুরো ধর্মতলা ও ময়দান অঞ্চলে ১৬৩ ধারা (পূর্বতন ১৪৪ ধারা) জারি করে লোহার ভারী ভারী উঁচু-উঁচু গার্ডরেল,ব্যারিকেড, ভারী শিকল ও একাধিক তালা লাগিয়ে এলাকা-টা কার্যতঃ দুর্গে পরিণত করা। তারপর হাইকোর্টের রায়ে সব খুলে দিতে বাধ্য হলেও ফোনো জ্যামার বসানো, অকারণে কার্নিভ্যালের মধ্যে বড় বড় ট্রাক এমনকি দমকলের গাড়ি ঢুকিয়ে দেওয়া ইত্যাদি বাধাপ্রদান করার চেষ্টা হলেও লক্ষ লক্ষ মানুষের উৎসাহিত অংশগ্রহণে দ্রোহের কার্নিভ্যাল আশাতীত সাফল্য পেয়েছিল।
কার্নিভ্যাল শেষে অনেকেই গেল জুনিয়ার ডাক্তারদের আহ্বানে মানব বন্ধনে সামিল হতে। সেখানেও বাধা। ‘গো-ব্যাক’ ধ্বনিতে বাধাদানকারী পুলিশ অফিসার – যিনি আবার পুলিশের সাংবাদিক সম্মেলনে সেমিনার রুমের ছবি দেখিয়ে উত্তরবঙ্গের অভিযুক্ত ট্রেনী ডাক্তারকে ‘পুলিশের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ’ বলে সনাক্ত করে হাসির পাত্র হয়েছিলেন- তিনি বাধাপ্রদান মূলতুবি রেখে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন।
চারঘন্টার-ও বেশী সেই চলমান গণকার্নিভ্যালে অংশ নেওয়ার পরে একটু ক্লান্ত বোধ হওয়াতে মেট্রো রেল ধরে ফেরার পরিকল্পনা করলাম। এসপ্ল্যানেড মেট্রো ষ্টেশনে মাটির নীচে তখন আরেক কার্নিভ্যাল! হাজার হাজার যাত্রীর ভীড়ে টিকিট কাটতেই লেগে গেল প্রায় চল্লিশ মিনিট। সমাজ মাধ্যম এবং গণ মাধ্যমের ভিডিও আর ছবিতে দেখছি তখনো চলছে দ্রোহ কার্নিভ্যাল ও মানব বন্ধন।