আমাদের এক বন্ধু ছিল শ্যামল। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিলনা যে শ্যামলের শরীরে এক জন্মগত ত্রুটি রয়েছে। এমনিতে স্বাভাবিক, কিন্তু থেকে থেকে ওর হাতদুটো প্রবল ভাবে কাঁপতে থাকতো এবং কিছুক্ষণ পর বেঁকে যেত। প্রথম প্রথম আমরা সবাই ভাবতাম, শ্যামল বোধহয় আমাদের সঙ্গে মস্করা করার জন্য এমন করছে। পরে কাকাবাবু, মানে শ্যামলের বাবা, আমাদের ওর ঐ রোগের কথা জানালেন – শ্যামল একজন ডিস্টোনিয়া (dystonia)আক্রান্ত রোগী। রোগটি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের রোগ।
ডিস্টোনিয়া সম্পর্কে আমার আগ্রহ, উৎকন্ঠা, উদ্বেগ সবই বন্ধু শ্যামলের সমস্যাগুলোকে মাথায় রেখেই। আগেই বলেছি যে ডিস্টোনিয়া হলো আক্রান্ত মানুষের দেহের কোন অংশের পেশির অনৈচ্ছিক কম্পন বা সঞ্চালন। ডিস্টোনিয়া শব্দটি এসেছে দুটো শব্দ থেকে – ল্যাটিন উপসর্গ dys এবং গ্রীক শব্দ tonos, যার অর্থ পেশির কম্পন , এর সমন্বয়ে। আসলে আমাদের দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গের সঞ্চালন নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে পাঠানো সংকেতের মাধ্যমে। সেই সংকেত ঠিকঠাক না পৌঁছলে রোগীর শরীরের কোন বিশেষ অংশের পেশি কাঁপতে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ডিস্টোনিয়া হলো – a nervous system disorder that causes uncontrollable muscle contractions. তবে মাথায় রাখতে হবে যে, ডিস্টোনিয়া মুখ্যত দেহের কোন বিশেষ অংশের পেশির অনৈচ্ছিক কম্পনের সমস্যা হলেও তার উৎস কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক অথবা স্নায়ুতন্ত্রের অন্য কোনো অংশ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবশ্য ডিস্টোনিয়ার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা ডাইস্কেনিশিয়া নামের আরেকটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে থাকেন পেশির অনৈচ্ছিক কম্পনের বিষয়টিকে বোঝাতে। চিকিৎসকদের মতে ডিস্টোনিয়া হলো একধরনের ডাইস্কেনিশিয়া। তবে সব ডাইস্কেনিশিয়া কিন্তু ডিস্টোনিয়া নয়। অর্থাৎ এই দুয়ের মধ্যে কার্যকারণগত ভাবে কিছু পার্থক্য রয়েছে। ডাইস্কেনিশিয়া হলো আমাদের দেহের কোনো পেশির অসংলগ্ন অনৈচ্ছিক কম্পন বা সঞ্চালন। দেহের পেশির involuntary movement । গ্রীক শব্দ “ kinesis” থেকে Kinesis শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ হলো নড়াচড়া করা বা সঞ্চালন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের দেহের কতগুলো বিশেষ অংশে ডিস্টোনিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। তাঁদের মতে এই বিশেষ অংশগুলো হলো-
১. ঘাড় বা neck
ডিস্টোনিয়ায় রোগীর ঘাড় আক্রান্ত হলে তাকে cervical dystonia বলে। এরফলে রোগীর ঘাড় একদিকে ঘুরে যায় অথবা মাথা সামনে কিংবা পিছনে হেলে যেতে পারে। এই ধরনের ডিস্টোনিয়া বেশ যন্ত্রণাদায়ক।
২. চোখের পাতা বা eyelids
রোগীর চোখের পাতা ডিস্টোনিয়ায় আক্রান্ত হলে তা খোলা – বন্ধ করতে অসুবিধা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এমন অবস্থাকে বলা হয় blepharospasm. চোখের পাতা আক্রান্ত হলে তা সহজে বন্ধ করা যায়না। ফলে চোখে আলো পড়লে তা সহ্য করতে পারে না রোগী। এরফলে চোখ শুকিয়ে যায়। রোগীর অস্বস্তি বাড়তে থাকে
৩. চোয়াল অথবা জিভ
ডিস্টোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে আমাদের মুখের চোয়াল এবং জিভ। এই অবস্থাকে বলা হয় oromandibuIar dystonia.এমন হলে তা রোগীর পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে ওঠে – কথায় জড়তা আসে, কথা অস্পষ্ট হয়ে যায়, কিছু খেতে বা চিবিয়ে খেতে, গিলে খেতে পারেনা। এই ধরনের ডিস্টোনিয়া অত্যন্ত কষ্টের।
৪. কন্ঠনালী বা স্বরযন্ত্র
এমন রোগে রোগীর কন্ঠনালী ও স্বরযন্ত্রের অসারতা দেখা দিতে পারে। একে বলা হয় laryngeal dystonia. কন্ঠনালী বা স্বরযন্ত্র আক্রান্ত হলে রোগীর পক্ষে কথা বলায় অসুবিধা হয়। রোগী স্বাভাবিক স্বরে কথা বলতে পারে না।
৫. হাত এবং বাহু
যেসব মানুষ একই ভাবে হাত ও বাহু সঞ্চালনে অভ্যস্ত, যেমন লেখক, বাদ্যযন্ত্রী কিংবা ট্রাফিক পুলিশ, তাঁদের হাত এবং বাহুতে এই ধরনের শিথিলতা দেখা যায়।
ডিস্টোনিয়ায় কারা আক্রান্ত হতে পারেন?
এর উত্তরে বলবো, যে কোন মানুষের মধ্যে এই রোগটি দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়সের কারণে এই রোগে আক্রান্ত হয়, আবার জন্মগত ত্রুটির কারণে অথবা বাল্যবয়সেই এই রোগটি শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। আবার পরিণত বয়সেও হঠাৎ এই রোগে আক্রান্ত হয় বেশ কিছু মানুষ। এই রোগ সম্পর্কে যেহেতু সচেতনতা তুলনায় অনেক কম, তাই অনেক সময় বয়স্ক মানুষ এই সমস্যার শিকার হলে তাকে বয়স জনিত সমস্যা বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে কত সংখ্যক মানুষ স্থায়ীভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
ডিস্টোনিয়াতে আক্রান্ত হলে তা কী করে টের পাওয়া যাবে? আজকের আলোচনা সূত্রে আমরা জেনেছি যে অনিয়ন্ত্রিতভাবে দেহের কোন বিশেষ অংশের পেশি কাঁপতে থাকলে তা ডিস্টোনিয়ার কদম সাধারণ লক্ষণ। প্রশ্ন হলো শরীরের পেশির এই অনৈচ্ছিক কম্পনের ফলে শরীরে ঠিক কী ধরনের অনুভূতি জাগে? আসলে এর ওপর নির্ভর করে ডিস্টোনিয়াকে ধরতে পারার বিষয়টি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে কম্পনের অনুভূতি হতে পারে –
- বিদ্যুতের শক্ মারার মতো অস্বস্তিকর অথবা যন্ত্রণাদায়ক।
- রিপিটেটিভ বা আবর্তনশীল । অর্থাৎ বারংবার কম্পন অনুভব হতে পারে।
- পরিবর্তনশীল কম্পন তার স্থায়িত্বকালের মাত্রার তারতম্যভেদে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম্পন কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয় আবার অনেক সময় তা মাস কয়েক ধরে চলতে পারে।
- কখনো কখনো পেঁচিয়ে ধরার মতো অথবা তীব্রভাবে টেনে ধরার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়। যারফলে শরীর মুচড়ে গিয়ে অস্বাভাবিক চেহারা নেয়।
অবশ্য দেহের ঠিক কোন বিশেষ অংশ ডিস্টোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে পেশির খিঁচুনি বা বিকলন মাত্রা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে এই অনৈচ্ছিক কম্পনের সমস্যা অন্যূন পাঁচ ভাবে ঘটতে পারে। তবে এই নিবন্ধে সেই জটিলতা এড়িয়ে যাব আমার পরিমিত জ্ঞানের কারণে। তবে ডিস্টোনিয়া সম্পর্কে আরও কিছু জরুরি তথ্য এই অবসরে জেনে নেওয়া যাক।
ডিস্টোনিয়া একটি স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা। জন্মগত ত্রুটির কারণে এই রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে সমস্যার জটিলতা বাড়তে পারে। কেননা এই রোগটিকে প্রতিরোধ করা এককথায় অসম্ভব। বংশগত ভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তাকে ঠেকানোর কোনো উপায়ই জানা নেই। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে সেকেন্ডারি বা পরবর্তী ডিস্টোনিয়ার আক্রমণকে কমাতে বা প্রতিরোধ করা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো কী কী সেই ব্যবস্থা?
প্রথমত –পুষ্টিকর আহার ও শরীরের পরিমিত ওজন বজায় রাখতে হবে – এই দুটি বিষয় কেবল ডিস্টোনিয়াকে প্রতিরোধ করার সামর্থ্য জোগায় না ,শরীরের বহুবিধ সমস্যার কার্যকর সমাধান মিলবে এরফলে। যখন তখন, যেমন তেমন না খেয়ে সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। এরফলে দেহের ওজন ঠিক থাকবে, স্নায়ুতন্ত্র সতেজ থাকায় ডিস্টোনিয়ার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ কমবে।
দ্বিতীয়ত – সংক্রমণের প্রতিরোধে সচেতনতা প্রয়োজন শরীরে, বিশেষ করে চোখ ও কানে কোনো সংক্রমণ হলে দ্রুত তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, কেননা এগুলোকে উপেক্ষা করা হলে তা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে । মাথায় সংক্রমণের ফলে এনসেফেলাইটিস হবার আশঙ্কা বেড়ে যায় যা থেকে ডিস্টোনিয়া হতে পারে।
তৃতীয়ত – ঝুঁকিবহুল কাজ করার সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত
অনেক মানুষ আছেন যাদের পেশাগত জীবনে বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। এঁরা দুর্ঘটনায় পড়লে তাদের অনেকেই ট্রমার শিকার হন যা থেকে ডিস্টোনিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এইসব মানুষদের কাজে নামার আগে উপযুক্ত সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার করা উচিত। এতে দুর্ঘটনা ও পরবর্তী ডিস্টোনিয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
চতুর্থত –সাধারন স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে প্রত্যেককে নিজের নিজের সাধারণ স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে হবে কেননা অনেক ক্রনিক রোগ থেকে পরবর্তীতে ডিস্টোনিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস, উচ্চ মাত্রার রক্তচাপ, মৃগী রোগ ইত্যাদি থাকলে সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হবে কেননা এগুলো থেকে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমতে পারে।
কথায় বলে সাবধানের মার নেই। তাই আমাদের সম্ভাব্য সাবধানতা মেনে চলতে হবে। এতে করে যদি নিজেদের খানিকটা সুরক্ষিত রাখতে পারি, তাহলে তার থেকে ভালো আর কি হতে পারে।
খুব সুন্দর দাদা
বিষয়টি যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভালো লাগে, কাজের বলে মনে হয় তাহলেই জানবো আমার কলম ঠিক পথেই চলছে। ছড়িয়ে পড়ুক অন্যদের মধ্যে।
খুবই সুন্দর হয়েছে দাদা লেখাটা। সাধারণ মানুষের এই সমস্যাটি সম্মন্ধে ধারণা তৈরি করবে। ডিস্টোনিয়া বর্তমান সময় এ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ কিছু ওষুধ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ডিসটোনিয়া হতে পারে বিশেষত typical antipyschotics। আর মানসিক সমস্যা উত্তোরত্তর বেড়েই চলেছে।
একজন চিকিৎসকের থেকে মতামত পেলে লেখক হিসেবে বাড়তি উৎসাহ পাই। এই যে লিখেছো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা তা নতুন শঙ্কা জাগায়।
SAMRIDDHO HOLAM LEKHATA PORE
শুধু নিজে সমৃদ্ধ হলে চলবে না, অন্যদের সচেতন করতে হবে।
লেখাটা ছড়িয়ে পড়ুক সচেতনতার জন্য।
এই রোগটি সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারনা ছিলনা। এই লেখাটি পড়ার পর অনেক পরিচ্ছন্ন বুঝতে পারলাম।
বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে লেখকের আগের লেখাগুলোর মতো এই লেখাটিও সহজ সরল প্রাঞ্জল। ধন্যবাদ।