মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ইমারজেন্সি বিভাগে কর্মরত তখন। রাত প্রায় একটা। একঘেয়ে অভ্যস্ত স্ট্রেচারের ঘ্যাঁচর ঘোঁচর আওয়াজে বছর কুড়ির তরুণীর পেটের যন্ত্রণায় কাতর প্রবেশ। “সকাল থেকে পেটের যন্ত্রণা। গ্যাসের ওষুধ সব দিয়েছি। ইঞ্জেকশনও দিয়েছি, স্যার। স্যালাইনও দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির লোকে আর রিস্ক নিতে না চাওয়ায় এখানে নিয়ে এলাম, স্যার”। বিস্ফারিত চোখে বললেন গ্রামীণ এক কোয়াক চিকিৎসক। নিদ্রালু চোখে রোগীর প্রেসার দেখলাম। নিম্নমুখী প্রেসারের সাথে সাথে উর্ধ্বগতির হার্টরেট মনের কোণে শঙ্কা তৈরী করলো।চোখের নিচের পাতা টেনে দেখলাম, একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা।
ঋতুস্রাব কেমন হচ্ছে? “আগের মাসে বন্ধ ছিলো। গতকাল রাত থেকে হালকা ব্লিডিং হচ্ছে”। কঁকিয়ে উঠলো তরুণী। মনের মাঝে দড়ি টানাটানি শুরু হলো তখনই। তরুণীর বহিরাঙ্গে বিবাহের চিহ্ন নেই। কিভাবেই বা জিজ্ঞেস করি কঠিন প্রশ্নটা? রোগীর গোপনীয়তা রক্ষাও চিকিৎসকের কর্তব্য। পরিজনেদের বাইরে যেতে বললাম বটে। কিন্তু সে আদেশ উপেক্ষা করাটাই এখনকার সামাজিক ধর্তব্য। তাই এড়িয়ে থাকা উঁকিঝুঁকি জনতার মাঝেই সিস্টার ম্যাডামকে ইশারা করতেই সিস্টার জিজ্ঞেস করলেন “তোমার বিয়ে হয়েছে”? দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ঋণাত্মক জবাব দিলো তরুণী।
একমাস ঋতুস্রাব বন্ধ থাকার পর হালকা ব্লিডিং, পেট ব্যথা, রক্তাল্পতা, উর্ধ্বগতির পালস।
চিৎকার করে উঠলাম “এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি”!
তাড়াতাড়ি স্যালাইন রেডি করুন। গাইনি ইমারজেন্সি বিভাগে কল করুন। ইমিডিয়েট অপারেশান থিয়েটার রেডি করতে বলুন। অন কল গাইনাকোলজিষ্টকে কলবুক পাঠান। বোধহয় রাপচার করেছে।
সিস্টার ম্যাডাম অভ্যস্ত হাতে শশব্যস্ত হয়ে ছুটলেন আমার কথা শুনে।
কান পেতে এড়িয়ে থাকা পরিজনেরা “এক্টোপিক” না বুঝলেও “প্রেগন্যান্সি” কথাটা হাড়ে হাড়ে শুনেছে। অবিবাহিত মেয়ে। তায় পেট ব্যথা। হতেই পারে অ্যাপেনডিসাইটিস, গ্যাস্ট্রাইটিস, কোলেলিথিয়াসিস। কমবয়েসী ডাক্তারের মুখে “প্রেগন্যান্সি” শুনে অবিশ্বাস, ভয়, রাগ সব মিলে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিলো। ছুটে এলেন মেয়ের বাবা। গ্রামীণ চিকিৎসকও তখন ভ্রু কুঁচকে সামনে প্রকট হয়েছেন। “কি যা তা বলছেন ডাক্তারবাবু?”
সবার অবিশ্বাসে জল ঢেলে সম্যক প্রমাণের আশায় ইমারজেন্সীর ট্রে থেকে ইউরিনারী প্রেগন্যান্সি কিট বের করে তরুণীর হাতে দিয়ে ঈশারা করতেই অবিশ্বাসের রক্তরাঙা ঝাঁঝালো আগুন ঝরে পড়লো তরুণীর চোখে। আড়ালে থাকা ভয়ের ঢোঁকগেলাটাও আমার চোখ এড়ালো না। ততক্ষণে বাকি পরিজনেরা আমার উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেও মুখ নামিয়ে এগিয়ে এলেন তরুণীর মা। প্রেগন্যান্সি কিটটা হাতে নিয়ে তরুণীকে নিয়ে ইমারজেন্সীর বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
কিছুক্ষণের শ্বাসরুদ্ধকর নিরবতার পর থমথমে মুখে বেরিয়ে এলেন মা-মেয়ে। মায়ের চোখ ছাপিয়ে জলের গড়িয়ে পড়া আমার উপর আক্রমণের তিব্রতা এক ধাক্কায় ম্লান করে দিলো। নাটকীয়তার মঞ্চে এবার প্রবেশ করলেন অন-কল গাইনিকোলজিষ্ট। সঙ্গে আসা অপারেশান থিয়েটারের কর্মীরা স্যালাইন চালিয়ে তরুণীকে নিয়ে মেন বিল্ডিং ছুটে চললেন। দ্রুত রক্তের প্রয়োজন। রক্তের রিকুইজিশন ফর্ম পূরণ করে হতভম্ব বাবার হাতে ধরিয়ে ব্লাডব্যাংকের দিকে তর্জনি তুলতেই বাবার চোখের কোণ ভিজে এলো। এতক্ষণ দাপাদাপি করা গ্রামীণ চিকিৎসক ফনা নামিয়ে আমার কাছে দাঁড়িয়ে অনুগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন “কেস টা কি”?
ততক্ষণে ইমারজেন্সি বিভাগে এক সাপে কাটার রোগী উপস্থিত। রোগ বর্ণনার অনু্যোগ সে সময় সত্যিই বিলাসিতা। পাশ থেকে প্রেগন্যান্সির কিটে তখনও জ্বলজ্বল করছে দুটো লাল রেখা। সেদিকে ঈঙ্গিত করে সাপে কাটার রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ভোরের আলো যখন ইমারজেন্সীর সামনের নীল শেডটায় পড়েছে তখন রোগীর ভিড় নেই। একটু থিতিয়ে নেবো ভাবছি।তখনই আবার জিজ্ঞাসু চোখে রাতের গ্রামীণ চিকিৎসক হাজির। “আসলে আমি তো ভেবেছিলাম গ্যাস হয়েছে। অবিবাহিত মেয়ে। মাথায় কি করে আসবে বলুন তো? একটু বুঝিয়ে বলবেন ডাক্তারবাবু”?
রাতের ক্ষণিকের অপমান ভুলে বললাম, সাধারণত গর্ভস্থ ভ্রূন ইউটেরাসে বা গর্ভাশয়ে স্থান পেলেও কিছু অস্বাভাবিক কারণে ডিম্বাশয় ও গর্ভাশয়ের মাঝে থাকা ফ্যালোপিয়ান টিউবে, বা অন্য কোনো পরিসরে জায়গা করে নিলেই এই বিপত্তি ঘটে। সময়ের সাথে সাথে ভ্রূণ বড় হয়। কিন্তু সরু ফ্যালোপিয়ান টিউবে বাড়ন্ত ভ্রূণের সংস্থান অসম্ভব। তাই শুরু হয় যন্ত্রণা। প্রেগন্যান্সির কারণে মাসিক বন্ধ ছিলো। কিন্তু ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়া বাড়ন্ত ভ্রূণের অস্বাভাবিকতায় যন্ত্রণার সাথে সাথে বেড়ে যাওয়া হার্টরেট, রক্তাল্পতা, মায় জ্ঞানলোপ অবধি হতে পারে। দ্রুত অপারেশান করে ভ্রূণটিকে বের করে না দিলে প্রাণহানিও হতে পারে বিনা নোটিশেই। তাই মাসিকের অনিয়মতায় রুটিন প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা অবশ্য কর্তব্য। এসব সমস্যা এড়াতেই সরকারি সুবিধা অনুযায়ী প্রত্যেক প্রেগন্যান্সির আলট্রাসোনোগ্রাফিও করা হয়।
লাফিয়ে উঠলেন গ্রামীণ চিকিৎসক। গতকাল সকালে যখন প্রথম দেখি, তখন তো বাড়ির বাথরুমে জ্ঞান হারিয়েছিলো বলেই আমাকে তলব করেছিলো ওর বাবা। আমি তো ভাবলাম গ্যাসটা বোধহয় মাথায় উঠে ঝামেলা পাকিয়েছে। তাই দিলাম একটা গ্যাসের ইঞ্জেকশন পুশ করে। কিন্তু তাতেও যখন কমলো না তখনই এরকম একটা সন্দেহ হয়েছিলো।
কনফিডেন্স গুলে খেয়েছেন ভদ্রলোক। মুচকি হেসে বললাম – গ্যাসের পৌষ্টিক পথে মস্তিস্কের দোরগোড়ায় পৌঁছান কিভাবে?
আমার হেঁয়ালি না বুঝেই মাথা নামিয়ে বললেন, পাড়ার মদনের সাথে ওর ভারি মাখামাখি। আমিই এক আধবার ওর বাবাকে বলেছিলাম। কথা কানেই তোলেননি। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে।
অনধিকার প্রবেশের গেরোয় আটকালাম ভদ্রলোককে। কথা এড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম – অপারেশান ঠিকঠাক হয়ে গেছে তো?
হ্যাঁ ডাক্তারবাবু। জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু লজ্জায় বোধহয় চোখ খুলতে চাইছে না।
ততক্ষণে সকাল হয়েছে। ডিউটি ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পথের পাশে তরুণীর মা, বাবাকে দেখলাম নিচুস্বরে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়েছেন। “তোমার প্রশ্রয় পেয়েই আজ এই অবস্থা”।
আমায় দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করতেই আশ্বস্ত করে বললাম, আমাদের চিকিৎসক জীবনে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি মোটেও অনভিপ্রেত নয়। বৈবাহিক বা অবৈবাহিক, এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি প্রায়ই দেখতে পাই। বরঞ্চ ভুল রোগ নির্ণয়ে এই রোগীর মৃত্যু অনভিপ্রেত। অনভিজ্ঞ হাতে মেয়ের জীবনের বাজি না রেখে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিলে বহু জীবনহানি রোধ করা যায়। সামাজিক অপবাদের ভয়ের থেকে মেয়ের জীবনের দাম অনেক বেশি।
প্রাতঃকালীন জ্ঞানগর্ভ পরামর্শে ভদ্রলোক বিচলিত না হয়েই অন্যপানে চেয়ে বিদায় দিলেন আমাকে।