সেদিন কলেজে গাছের ছাওয়ায় বসে পাঁচু অর্থাৎ পাঞ্চজন্য রায় এবং চাঁদু অর্থাৎ চন্দ্রাণী মাহাতো ভাগাভাগি করে বিড়ি খাচ্ছিলেন। বলা যায় ওরা ইয়ে মানে পরস্পরের আকর্ষণে ক্লাস বাঙ্ক করে নিজেদের নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। পাঁচু কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ আকাশ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন “ফুটো হয়ে গেলো”
চাঁদু চশমা তুলে খানিক আকাশ দেখে বললেন “কি? তোর হিয়া নাকি?”
পাঁচু যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বললেন “তোর মাথা”
চাঁদু নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন “না হয়নি”
পাঁচু মর্মান্তিক ব্যথা পেয়ে বললেন “আহা ঐ যে ওজোনে ফুটো হচ্ছে … সিগারেটের বেঞ্জিন, টার, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, ফেনল, সব কিছু মিলে ওজোনে ফুটো করছে ”
দুজনেই রসায়নের সহপাঠী। চাঁদু খানিকক্ষণ মন দিয়ে নখ খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ওজোন আবার কবে তৈরি হলো?”
পাঁচু সন্দিগ্ধ চোখে চাঁদুকে দেখতে দেখতে বললেন “তার মানে? ওজোন তো প্রথম থেকেই ছিলো”
“বলিস কিরে? পৃথিবী তৈরি হলো ৫.৪ বিলিয়ন বছর আগে তখনও পৃথিবী আগুনের গোলক – জল নেই – অক্সিজেন নেই – তখনই ওজোন?”
“ছিলো না?”
“এজ্ঞে না, সেইজন্যে প্রাণও ছিলো না – আবার ওজোন ছিলো না বলেই প্রাণ তৈরি হয়েছে”
“চাঁদু তুই কিন্তু রহস্য তৈরি করছিস”
“তাহলে শোন, কান খোলকে শোন লো – একটা নেবুলা হচ্ছে বিশাল বিপুল এক ধুলোর বল। হুই ছায়াপথের ওপারে তাদের দ্যাখা যায়। অবর্ণনীয় তাদের ভর। কেউ বলেন নেবুলা থেকে আমাদের ছোট্ট সূর্য আর সৌরজগত সৃষ্টি হয়। নেবুলাটা থেকে সূর্য নামক নক্ষত্র তৈরি হওয়ার সময় সূর্যের আর আরেকটা নক্ষত্রের টানে পৃথিবী ছিটকে গিয়ে তৈরি হয়ে যায়; অনেক পরে অ্যাংলো স্যাক্সন জাতি পৃথিবীর নাম দেয় আর্ডা,যার মানে হলো মাটি,সেখান থেকেই আর্থ কথাটা এসেছে -বুঝলি গবেট? কেউ আবার বলেন সূর্যের থেকে কিছুটা অংশ ছিটকে এসে পৃথিবী তৈরি হয়। তারপর সূর্যের নিজের অক্ষে বনবনিয়ে ঘোরার চোটে পৃথিবীও ঘুরতে থাকে।”
পাঁচু চমকে যান “ডাঁড়া ডাঁড়া কিমাশ্চর্যম? সূর্য আবার ঘোরে নাকি?
“সিকিরে? জানিসনা?১৬১২ সালেই গ্যালিলেই গ্যালিলিও প্রথম লক্ষ্য করেন সৌর কলঙ্ক গুলো স্থান পরিবর্তন করে। এখন তো সবাই জানে পৃথিবীর সাতাশ দিনে সূর্য একবার নিজের অক্ষের ওপর পাক দেয়। ….এই পাঁচু গলা শুকিয়ে গেল, আরেকটা বিড়ি দে তো।”
পাঁচু চাঁদুকে একটা পতাকা বিড়ি এগিয়ে দিলেন। চাঁদু দু আঙ্গুলের মাঝে বিড়িটাকে ঠুকে দেশলাইএর এক স্ট্রোকে বিড়িটা ধরিয়ে তৃপ্তির ধোঁয়া ছাড়লেন।
“হ্যাঁরে চাঁদু আমাদের বিয়ে হলেও তুই কি তখন বিড়ি খাবি?”
চাঁদু বীষণ চটে ওঁর গ্রামের বুলি ঝাড়েন “ক্যানে? তোর বাবা বিঁয়ার পর সিগারেট খান না বট্যেঁ?
“না মানে….বাবা ….মানে…..বাবা তুলে……”
“ওহ্ পুরুষ বলে তিন সাত্তে একান্নোটা খুন মাফ, তাই তো? এর নাম পুরুষতন্ত্র। বাঃ…. হুঁ হুঁ বাওয়া – আমাকে কিন্তু দাবায়ে রাখতে পারবা না। …. যাক গে আসল কথায় আয়। প্রথম যুগে তার মানে ৫.৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপমাত্রা ছিলো ৪০০০℃। বাতাসে ছিলো কেবল হাইড্রোজেন, মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া ….ব্যস আর কিচ্ছু না।”
“…. তাহলে জল কোথা থেকে এলো?” পাঁচুর তাৎক্ষণিক প্রশ্ন।
চাঁদু বিড়িতে একটা মহা টান দিয়ে টুসকি মেরে অবশিষ্টাংশ নিঁখুতভাবে ডাস্টবিনে ফেলে বললেন
“ধ্যাত্তেরি জল জল করে গলা শুকিয়ে দিলো। সমুদ্রের জলে ডিউটোরিয়াম আর যেকোনো উল্কাতে ডিউটোরিয়ামের অনুপাত সমান- তাই ভাবা হয় কোনও জলপূর্ণ উল্কা থেকে পৃথিবীতে জল এসেছে।কেউ কেউ বলেন ভেস্টা নামের একটা বিরাট জল ভরা উল্কা মানে অ্যাস্টেরয়েড এসে দুম করে পৃথিবীকে ধাক্কা দেয় – ব্যস …মাঝের থেকে বেচারা ভেস্টার সব জল পৃথিবীতে ঝরে পড়লো – তখন অবশ্য অক্সিজেন আলাদা করে ছিলো না। তাই ওজোনও ছিলো না। সমঝে বেটা?”
“কিন্তু অক্সিজেন?” অনন্ত প্রশ্ন নিয়ে পাঁচু সদা প্রস্তুত।
চাঁদু একটু মাথা চুলকে নেন -তারপর বলেন “হুম সেটা কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ জটিল বটে। আলট্রা ভায়োলেট রশ্মির প্রভাবে কিছু জল ভেঙে অক্সিজেন তৈরি হচ্ছিলো কিন্তু তৈরি হয়েই হালকা বলে মহাকাশে উড়ে যাচ্ছিলো … অক্সিজেন বহুৎ হালকা জানিস তো? ভেবে দ্যাখ তখন সিচুয়েশনটা – সব আগ্নেয়গিরি পৃথিবীর পেটের ভেতর থেকে লাভা উগরে দিচ্ছে। উত্তপ্ত পৃথিবীতে জল টগবগ করে ফুটছে। বাষ্প হয়ে মেঘ তৈরি করছে – মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ওদিকে চলছে মহাজাগতিক প্রলয় বিগ ব্যাং … তার ঠ্যালায় থেইয়া বলে একটা অ্যাস্টেরয়েড পৃথিবীর একদম কাছে চলে এসে ‘তা থেইয়া তা থেইয়া তাআআআ তুম তানা নানা নানা নানা’ বলে নাচতে লেগেছে- একেবারে ম্যাদাগাস্কার টাইপের ব্যাপার স্যাপার। গোদের ওপর বিষফোঁড়া – আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি, এ আবার পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতো কোষের গঠন বদলে দ্যায়। মানে একটা টোটাল হুলুস্থুলু চলছে। এই সময় চুপিচুপি আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি অজৈব কোষ থেকে এক দুটো নাইট্রোজেন বেস তৈরি করে ফেললো- ইউরাসিল আর সাইটোসিন। এগুলো আরএনএ তৈরিতে কাজে লাগে। অর্থাৎ প্রাণের সূচনা হলো । সেখান থেকে এককোষী প্রাণী এসে হাজির। এরা আবার মিথেনোজেন। মিথেন ছাড়ে মিথেনেই বাঁচে। কদিন আগেই সাবটেরানিয়ান বায়োস্ফীয়ার বা ডার্ক বায়োস্ফীয়ারে অর্থাৎ মাটির অনেক তলায় প্রচুর এই রকম ‘এখনও’ জীবন্ত প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী পাওয়া গেছে। যারা সেই ডাইনোসরের আগে থেকেই বেঁচে আছে – কি হলো রে পাঁচু মুখটা ওর’ম ঝুলে পড়লো ক্যানো? সত্যিই ওরা আজও বেঁচে আছে। মাটির গভীরে (গুগ্লে সাবটেরানিয়ান বা ডার্ক বায়োস্ফীয়ার খুঁজলেই দ্যাখা যাবে) তাই তখন প্রচুর মিথেন তৈরি হলো ফলে মিথেন একটা বলয়ের মতো পৃথিবীকে ঘিরে রাখলো। পৃথিবীর তাপমাত্রা কমলো কিন্তু আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি হুশহুশিয়ে ঢুকতে লাগলো।এবার আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি ঐসব মিথানোজেন প্রাণীদের থেকে এককোষী উদ্ভিদ তৈরি করে ফেললো।”
পাঁচু ফুট কাটেন “বাহবা বেশ করিৎকর্মা তো!”
চাঁদু অদম্য, পাত্তা না দিয়ে বলেই যান “এরা অক্সিজেন ছাড়তে লাগলো। প্রচুর ….অনেক। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন প্রচুর বেড়ে গেলো তারপর এলো ওজোন (O3) লেয়ার।”
পাঁচু অবাক হয়ে যান “এই টুকু সময়ের মধ্যেই?”
চাঁদু অগ্নিবর্ষী দৃষ্টিতে তাকালেন “হাঁ জ্জি এইটুকু সময়ে”
তারপর পাঁচুর চুলের ঝুঁটি মুঠিতে চেপে হেঁইও বলে টান দিয়ে বলেন “মাত্তর দুই বিলিয়ন বছরের মধ্যেই বুঝলেন প্যাংলা কাত্তিক?”
পাঁচু ভয়াবহ একটা চিৎকার ছাড়লেন। ফলে মনোযোগ দিয়ে ঘাস চিবুনো দু একটা প্রেমরত যুগল ওর চিক্কুর শুনে ওদের দিকে তাকালো কিন্তু চাঁদুর মারকুটে স্বভাব সবাই জানে তাই পাত্তা দিলো না।
পাঁচু বললেন “মার ধোর বন্ধ করে বাকিটা বল”
চাঁদু আরম্ভ করলেন “ওজোন থাকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ..”
পাঁচু মাথার কটা চুল উৎপাটিত হলো গুনছিলেন ..উনি বাধা দিলেন “দুম করে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ঢুকে গেলি ক্যানো আগে বল পৃথিবীর ঠিক ওপরে যে বায়ুমণ্ডলে আমরা থাকি সেটার নাম ট্রোপোস্ফিয়ার – এটা আমাদের প্রয়োজনীয় সব জরুরী উপাদান সাপ্লাই দিয়ে থাকে, এটা প্রায় দশ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে তার ওপরে আছে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। এখানে ওজোন স্তর থাকে। যেহেতু সূর্যের আলো বিনা বাধায় এই স্তর পর্যন্ত চলে আসে তাই এর মধ্যেই প্রচুর ইউভি বিকিরণ থাকে। হ্যাঁ – এটা আসলে প্রচণ্ড শক্তি থেকে উৎপন্ন একটা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। তাই এখানে তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশী প্রায় ২০০℃ এর কাছাকাছি। এর ওপরে থাকে মেসোস্ফিয়ার – প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে। এর তাপমাত্রা কখনও কখনও ১০০০℃ থেকে ৪০০০℃ পর্যন্ত হতে পারে।”
চাঁদু নির্বিকার ভাবে বললেন “এখানে বাঁচানোর জন্যে ওজোন নেই – তাই সূর্যের সমস্ত তাপই এখানে উপস্থিত। কিন্তু ওখানে বাতাস এ্যাতো পাতলা যে প্রাথমিকভাবে খুব ঠান্ডা লাগবে তারপর হুঁহুঁ…. কাবাব হয়ে যেতে হবে। এর ওপরে আরেকটা জায়গা আছে -এক্সোস্ফিয়ার এটাকে প্রায় মহাকাশ বলা যায়। এটা কোথায় গিয়ে মহাকাশে মিলিয়ে গেছে …কেউই জানে না। এখানে তাপমাত্রা ১০০০℃ হতেই পারে।”
পাঁচু চিন্তাণ্বিত হয়ে পড়েন “একটু আগে বললি সূর্য ক্রমশঃ বড় আর গরম হয়ে উঠছে এরপর লাল দানব হয়ে উঠবে। এদিকে এয়ার কন্ডিশনারের থেকে বেরোনো অতি হালকা ক্লোরিনেটেড ফ্লুরোকার্বন উড়ে যাচ্ছে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে। সেখানে ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোনকে ভেঙে ফেলছে। ওজোন না থাকলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে কিছু না হলেও ৫০০℃ হয়ে যাবে। তাই যতো ওজোন ভাঙছে পৃথিবীতে তত গরম বাড়ছে আর ততই এসির ব্যবহার বাড়ছে। ততই আরও বেশী করে ওজোন নষ্ট হচ্ছে। কিছুদিন পরে আমাদের সাধের সবুজ পৃথিবী তো ঝলসানো রুটির মতো কালোপানা হয়ে যাবে। আমরা সবাই কাবাব হয়ে যাবো-যদিও দুঃখের কথা কাবাব খাওয়ার জন্য কেউ বেঁচে থাকবে না”
চাঁদু ইতিমধ্যে একটা চাওয়ালাকে ডেকে দুকাপ চা দিতে বলে দিয়েছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন “জানিস কি?এছাড়া ইউভি রশ্মি আমাদের চামড়ার সব রকম ক্যানসারের জন্যেই দায়ী। স্কিন ক্যানসার,রডেন্ড আলসার, মনে রাখিস সব থেকে ভয়ঙ্কর ক্যানসারের নাম ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা সেটার জন্যেও ঐ ইউভি বি রশ্মি দায়ী – এটা হলে চোখ থেকে লিভার কাউকে ছাড়ে না।যেটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ২৯০-৩২০ ন্যানোমিটার (এক মিটারের এক বিলিয়ন ভাগের একভাগ) সেই তরঙ্গ শরীরের পক্ষে সব থেকে ক্ষতিকর”
পাঁচু স্বগতোক্তি করেন “এরপরে ‘ডিএনএ’র বদল ঘটিয়ে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। ছানি পড়া ,অকাল বার্ধক্য , চামড়া কুঁচকে যাওয়া …”
চাঁদু বলেন “হ্যাঁ রে ঠিক বলেছিস- আমার কাকা মাঠে চাষ করেন ওনার গোটা মুখ বলীরেখায় ভর্তি হয়ে গেছে।”
পাঁচু বললেন “অথচ ‘ইউভি এ’ যেটা ৩৩০-৪০০ ন্যানোমিটার সেটা শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে”
দুজনে চা শেষ করে বললেন “চল রে আমরা আজ থেকেই গাছ লাগাই। ওজোনে ভরে উঠুক স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। আমাদের ছানাপোনারা যাতে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকে তার চেষ্টা তো আমাদেরই করতে হবে।”
[আশা রইলো এই ডাক্তার ডায়ালগের পাতায় একদিন ব্ল্যাকহোল- আর তার ভেতরে ঢুকলেই আমরা যে শক্তিতে পরিণত হয়ে চতুর্থ পঞ্চম এবং অন্যান্য সমস্ত মাত্রা বা ডাইমেনশন দেখতে পারবো, সেটা নিয়ে লেখার। আশা করবো ততদিনে আর পৃথিবীতে আর অসুখ থাকবে না। আমরা এই পাতায় ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ, ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ আর অনেক কিছু নিয়ে লিখবো যাতে মানুষ অজানাকে জানতে পারে]