ধরা যাক, কলকাতার শহরতলির একটা মাঝারি মানের ডেন্টাল ক্লিনিক, যেখানে ব্র্যান্ড ভ্যালু বিশেষ নেই, কিন্তু উঠতি ডাক্তারবাবুর ভাল কাজের প্রচেষ্টা আছে সর্বাত্মক। ক্লিনিকে ফলস সিলিং আছে, এসি আছে, ইলেকট্রিকাল চেয়ার আছে, একটা মাঝারি মানের ক্লিনিকে যা যা অত্যাধুনিক যন্ত্র রাখা সম্ভব, প্রায় অনেকগুলোই আছে। ডাক্তারবাবু বিশেষ বড়লোক নন, তাই বাবার থেকে ধার করে, ব্যাঙ্কলোন নিয়ে একটা চেম্বার দাঁড় করানোর প্রয়াস করেছেন। অনেকেই বলবেন, এত খরচের প্রয়োজনীয়তা ছিল না, কিন্তু এসব না থাকলে আবার শহর ও শহরতলিতে রোগীরা নাক সিঁটকোয়। করোনার চক্করে ডাক্তারবাবুর রোগী কমেছে, আগেও যে বিশেষ ছিল, তা নয়। কারণ সব উঠতি ডেন্টাল সার্জনই মনে করেন, শহরে পসার জমানো সহজ। কারণ গ্রামে যারা খেতে পায় না ঠিক করে, তারা দাঁতের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দেবে কোত্থেকে? ওদিকে সরকারও নিয়োগে বিশেষ ব্রতী নন, গ্রামের লোকের বুকে ব্যথা সারলেই হল, দাঁতে ব্যথা নিয়ে অত ভাবনা তাদের আছে বলে দেখা যায় না। থাকলে অন্তত প্রতিটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তত একজন করে ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের ব্যবস্থা হত। যাক গে, সেসব কথা। এক রোগী আসে আমাদের এই শহরতলির ডাক্তারবাবুর ক্লিনিকে। তার দাঁতে গর্ত হয়ে গেছে, ফলে তীব্র যন্ত্রণা। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে তাকে দাঁত তোলার খরচে বিষয়ে বললে রোগী জানায়, সে কোথা থেকে দেবে, কারণ গত মাসেই তার বেসরকারি চাকরিটি খোয়া গেছে। রোগীর আয় কম, ফলে ডাক্তারবাবুরও। এদিকে ডাক্তারবাবুও বুঝে পান না, রোগীর মনমতো খরচে দাঁত তুললে তিনি চেম্বার কী করে চালাবেন…
কাট টু, পুরুলিয়ার এক আধা গ্রাম্য ওষুধের দোকানের সাথে থাকা খুপরি ডেন্টাল ক্লিনিক, যেখানে এক পাশ করা স্থানীয় ডাক্তারবাবু বসেন, কারণ শহরে গিয়ে তার ক্লিনিক খোলার সামর্থ্য নেই। তাই গ্রামেই ওষুধের দোকানের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। রোগী এসেছে, গালে একটা দগদগে ঘা নিয়ে, রোগীর আবার খৈনী খাওয়ার অভ্যাস। দিনমজুরি করা রোগী ২টাকায় চাল কেনার পাশাপাশি খৈনীর জন্য টাকা জমিয়ে রাখে। খুপরিজীবী ডাক্তারবাবু একঝলক দেখেই বুঝে যান, রোগী ওরাল ক্যান্সারে আক্রান্ত, পাঁচবছরের অভিজ্ঞ চোখ রোগ চিনতে ভুল করে না। ওরাল ক্যান্সার হল ভারতে হওয়া সর্বাধিক ক্যান্সার, পাশ্চাত্যে অনেক মহান বিশেষজ্ঞ যাকে ব্যঙ্গ করে ইন্ডিয়ান ক্যান্সারও বলেন। অথচ তারপরও কেন্দ্র রাজ্য এই রোগ থামানোয় বিশেষ ব্রতী হন না। সরকারি সমীক্ষায় যেটুকু চিত্র উঠে আসে, তা হিমশৈলের চূড়াবিন্দুমাত্র। ডাক্তারবাবু রোগীকে জেলা হাসপাতালে রেফার করেন, কিন্তু রোগী অপারগ। একদিন জেলা হাসপাতালে যাওয়া মানে তার একদিনের আয় বন্ধ, সে দিন আনে, দিন খায়। ডাক্তারবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিজের ডিগ্রি আর পকেটের দিকে তাকান। না তো তিনি জনগণকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করতে পারলেন, না তিনি একজন পেশাদার হিসেবে নিজের আয় বাড়াতে পারলেন।
এই চরিত্রগুলো কাল্পনিক, কিন্তু ঘটনাগুলো নয়। আজও সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে পর্যাপ্ত দন্তচিকিৎসকের অভাবে সাধারণ মানুষ যেমন স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনি দন্তচিকিৎসকদের গ্রাস করছে বেকারত্ব। তাদের নিয়োগ করা যায় দন্তচিকিৎসক হিসাবে, জন স্বাস্থ্য অফিসার হিসেবে, তামাক নিয়ন্ত্রণ অফিসার হিসেবেও। কিন্তু কেন্দ্র রাজ্য কেউই জনস্বাস্থ্য তথা তামাক নিয়ন্ত্রণে আগ্রহ দেখান বলে মনে হয় না। প্রতিবছর শুধু তামাক নিয়ন্ত্রণ দিবস, চিকিৎসক দিবস, স্বাস্থ্য দিবস, দন্তস্বাস্থ্যদিবস ইত্যাদি পালন করলেই কাজ হয় না। আসল কাজ সরকার কবে করবেন, সেই আশায় এই দুই ডাক্তার বসে থাকে। আর পাঁচবছর অন্তর নিয়ম করে ভোট হয়,দন্তচিকিৎসক আর রোগী যে তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই থেকে যায়।
Dignity এর সাথে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মানুষের অধিকার। অতএব, স্বাস্থ্যও প্রতিটি মানুষের অধিকার হওয়া উচিত। শুধুমাত্র অর্থের নিরিখে কিছু মানুষ সেই অধিকার পাবেন, আর বাকিরা পাবেন না, এটা মানবতাবিরোধী। একটা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে এই ঘটনা প্রতিনিয়ত চললে তা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবমাননা। প্রত্যেকের জন্য স্বাস্থ্য তথা মৌখিক স্বাস্থ্যের অধিকার চাই। দন্তচিকিৎসকদের উপযুক্ত নিয়োগ চাই। নইলে গোটা সমাজের জন্য তা অতীব লজ্জাজনক বলেই প্রতিপন্ন হয়।
Khub sundor bolechen dada ❤️