বরষার মাঝে ডেবরা হাসপাতালে সেদিন ডিউটি আমার। মেঘের কর্কশ আওয়াজের সাথে সাথে লোডশেডিং। চারিদিক প্রায় অন্ধকার। দুপুরের রোদ মেঘের প্রাচুর্যে মলিন। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তাও ভ্যাপসা গরমে পাশে থাকা বেড হেড টিকিটকেই হাতপাখা বানিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঝিলিক দিল মেঘ। কানে তালা ধরার জোগাড়। সভয়ে ভেতরে ঢুকে এলাম। সদর দরজায় তাকিয়ে দেখি বছর সতেরোর এক যুবককে কাঁধে করে নিয়ে এসেছে আরও সাত আট জন। কাকভেজা সবাই। “ডাক্তারবাবু,আমাদের ইলেকট্রিক লাইনে কাজ করছিলো। শক খেয়ে পড়ে গেছে। দেখুন না কি হয়েছে”।
প্রায়ান্ধকার মুখে ঝুঁকে পড়লাম। শীতল শরীর। নিস্পন্দ। প্রাণের লেশ নেই।
চোখ নামিয়ে কিছু বলার আগেই ভিড় জুড়ে কান্নার শোরগোল শুরু হলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে মাথাটুকু বার দুয়েক নাড়িয়ে সিস্টার দিদির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আধুনিক জীবনে এ নিয়ে নতুন করে গুরুত্ব বোঝানোর দায় নেই আজ। কমবেশি সবাই জানেন বা উপলব্ধিও করেছেন। কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই আজও অজানা। সচেতনতার অভাব স্পষ্ট।
প্রথমতঃ ইলেকট্রিক্যাল ইনজুরি চার প্রকার। প্রথম প্রকারে রোগীর শরীর ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ ইলেকট্রিক তারের মতই শরীর দিয়ে কারেন্টের প্রবাহ ঘটে। তাই শরীরে দুটি ক্ষতচিহ্ন থাকে। প্রবেশ ক্ষত দিয়ে ইলেকট্রিক শরীরে প্রবেশ করে ও প্রস্থান ক্ষত দিয়ে বের হয়।
দ্বিতীয় প্রকারে সাধারণত ইলেকট্রিক আর্ক থেকে ফ্ল্যাশ ইনজুরি হয়। মূলতঃ পোড়া। শরীর এক্ষেত্রে সার্কিট হিসেবে ব্যবহৃত হয় না।
তৃতীয় প্রকারে ইলেকট্রিক আর্ক থেকে রোগীর জামাকাপড়ে আগুন লেগে ফ্লেম ইনজুরি হয়।এক্ষেত্রে রোগীর শরীর সার্কিট হিসেবে ব্যবহৃত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
চতুর্থ প্রকার ইলেকট্রিক ইনজুরি মূলতঃ পলকে প্রকান্ড ভোল্টেজের কারেন্ট যদি শরীরের ওপর দিয়ে চলে যায় সেক্ষেত্রে দেখা যায়। ট্রেনের ওভারহেড তারে লেগে ইনজুরি এর একটা উদাহরণ।বা বাজ পড়ে দুর্ঘটনাও এর প্রকারবিশেষ।
এছাড়াও শক খেয়ে ছিটকে পড়ে আঘাত জনিত জটিলতাতো আছেই।
ইলেকট্রিসিটি আবার দু’প্রকারের। এসি ও ডিসি। ডিসি কারেন্টে শক খাওয়া ব্যক্তি সাধারণত ছিটকে দূরে সরে গেলেও এসির ক্ষেত্রে আবার আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে প্রভূত পরিমাণ কারেন্ট ইনজুরি হয়ে থাকে। তাই এসি কারেন্টে ক্ষতির সম্ভাবনাও অনেক বেশি।
ইলেকট্রিক ইনজুরিতে আমাদের শরীরের কোষপর্দার বিভবশক্তির তারতম্যহেতু যেমন মাংসপেশির টিট্যানি হয় আবার ইলেকট্রিক শক্তির তাপশক্তিতে রূপান্তর শরীরে বার্ন ইনজুরি ঘটায়।
সাধারনত ইলেকট্রিক ইনজুরিতে মৃত্যুহার বেশ বেশি। বেশির ভাগ সম্যক মৃত্যুর প্রকৃত কারণ হৃৎযন্ত্রের অচল হয়ে যাওয়া (অ্যাসিস্টোল) বা বিকল হয়ে যাওয়া ( অ্যারিথমিয়া)। এছাড়াও শ্বাসবেলুনের কার্যকারী মাংসপেশির হঠাৎ প্যারালিসিসও মৃত্যুর আর এক কারণ।
ইলেকট্রিক বার্ন ইনজুরিতে মৃত্যু, আর পাঁচটা পুড়ে যাওয়া রোগীর মতই গতানুগতিক। তবে আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রে যে বীভৎসতা চর্মচক্ষে চাক্ষুষ করা যায় ইলেকট্রিক বার্নে তা অন্তর্নিহীত থাকায় বাইরে থেকে বোঝার জো থাকে না।
বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানেদের আবার জলশূন্যতা (ডিহাইড্রেশান) প্রভূত বিপদ ডেকে আনে।
প্রাথমিক ভাবে রোগীকে ইলেক্ট্রিক লাইন থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে জ্ঞান থাকা রোগীকে শুইয়ে দিয়ে ও.আর.এস. দিন। ঘাড় ও শিরদাঁড়া এক লাইনে নট নড়ন চড়ন অবস্থায় রাখুন ও চিকিৎসকের দ্বারস্থ হবার প্রস্তুতি নিন।
ইলেকট্রিক ইনজুরির ক্ষেত্রে কমপক্ষে একখান ইসিজি করা ও ফ্লুইড রিপ্লেসমেন্ট খুব জরুরী যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবহেলিত হয়।
অজ্ঞান রোগীর শ্বাসপথ বাধামুক্ত রেখে শিরদাঁড়া ও ঘাড়কে স্থির রেখে যত দ্রুত সম্ভব কাছেপিঠের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করুন। ডাক্তারবাবু রোগীর শ্বাসপথ, রক্তপ্রবাহ পরীক্ষা করে ফ্লুইড রিসাসিটেশন করে হৃৎযন্ত্রের পরীক্ষা করবেন ও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা দেখে পরবর্তী জরুরি পদক্ষেপ নেবেন।
বাজ পড়া রোগীর জন্যেও উপদেশাবলী একই। প্রতিরোধের উপায় হিসেবে গাছের তলা, ফাঁকা মাঠ থেকে দূরে, বাড়িতে সুপরিবাহী বস্তু থেকে সংস্রবচ্যুত হয়ে আশ্রয় নেওয়া সমীচীন। নেহাৎই ফাঁকা মাঠে আটকে পড়লে আলের পাশে শুয়ে পড়া প্রাণ বাঁচাতে পারে।
সমীক্ষায় দেখা যায় ইলেকট্রিক ইনজুরি সাধারণত বাচ্চাদের অসাবধানতা ও ইলেকট্রিক কর্মীদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফলশ্রূতি। তাই অনুরূপ সাবধানতা অবলম্বন জরুরী।
ইলেকট্রিক ইনজুরিতে মুহূর্তের বিলম্ব সম্যক মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। তাই গ্রামবাংলার মানুষ সাধারনত জুতো শুঁকিয়ে বা গরম দুধ না খাইয়ে সময়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলেই জটিলতা কমবে।