কালা? মোমবাতি জ্বালা
চারিদিকে এখন এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে, এখন মনে হচ্ছে – আধুনিক চিকিৎসকদেরই ভুল এই পদ্ধতিতে কোন রোগের চিকিৎসা করা! কোটি কোটি মানুষকে বাঁচাতে পেরেছে যে বিজ্ঞান, তাকে ভুল প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে এমন কিছু লোকজন, যারা কোনকালে একজন মরণাপন্ন মানুষকে বাঁচিয়েছে কিনা সন্দেহ! এই অপকর্মকে সাপোর্ট করতে নেমেছে এমন কিছু লোকজন, যারা আধুনিক চিকিৎসা তো দূরের কথা, এইসব ট্রাডিশনাল সিস্টেম অফ মেডিসিন এর পৃথিবীব্যাপী লেজেগোবরে কলঙ্কিত হবার ইতিহাস অব্দি জানেন না!!
তবু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে – বিজ্ঞান মেনে চলাই যেন আধুনিক চিকিৎসকদের ভুল! এমন বলা হচ্ছে যেন – আধুনিক চিকিৎসকরাই বাকি সব ট্রাডিশনাল সিস্টেম অফ মেডিসিনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে! সেও বাণিজ্যিক স্বার্থে!
এই রকম মানসিকতার পেছনে না আছে কোন যুক্তিতর্ক, না আছে প্রমাণ! ফলাফল – পড়লে বা শুনলে ঘোড়া হেসে ফেলবে! আর বিজ্ঞানের মূল শর্ত মানার কথা যদি বলেন – তাহলে এইসব সিস্টেম অফ মেডিসিন একটাও মানেনি!!
তবে কে বা কারা কেন আছে এর পেছনে, সবাই জানে। কে কোথায় সুড়সুড়ি দেয়, সেও জানে! তবু সাধারণ মানুষের কাছে অবোধ্য ঠেকে। কারণ?
মূলতঃ পেট বাঁচাতে এখন মিডিয়ার বিজ্ঞাপনী ভাষা এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিভিন্ন মিডিয়ায় এইসব ট্রাডিশনাল মেডিসিনের দ্বারা স্পনসরড প্রোগ্রাম এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে – ঠিক কেন আধুনিক চিকিৎসকরা অন্য কোন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করেন না – সেটার জবাব খোঁজার দায় এখন মিডিয়ার সঞ্চালকদের!! কিংবা সাংবাদিকদের!!
অথচ বিজ্ঞান বিষয়ক কোন গবেষণা কোন কালে টিভি চ্যানেলে হয়নি, এটা একটা আস্ত গবেটও বোঝে! মিনিমাম একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যাকে টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানিপুলেট করা যায় (আমি কিন্তু মোটেই রাজস্থানের নিমস এর কথা বলছি না, শুনেছি ওখানেও মহৌষধি র ট্রায়াল হয়েছে!?), তার দরকার আছে! সেটা কন্ডাক্ট করা কোন টিভি চ্যানেলের কাজ অন্ততঃ নয়!!
শুনলেই মনে হবে – আইএমএ সেক্রেটারি একবার ট্রাডিশনাল মেডিসিন এর পক্ষে কথা বললেই, ঢাক ঢোল পিটিয়ে সেটিকে মান্যতা দেয়া যাবে! জ্ঞানবৃদ্ধ সাংবাদিকগণ, ওটি আপনাদের কাজ নয়, আপনারা ও জানেন!!
কিন্তু এমন কেন??
বিজ্ঞান তথা আধুনিক চিকিৎসা তো জাস্ট এইসব ট্রাডিশনাল মেডিসিন এর বিবর্তিত রূপ! বয়স কত এর? অন্য সব সিস্টেমকে ঠেলে এই বিজ্ঞান উঠে এলো কেন? কিভাবে? জানতে ইচ্ছে হয় না??
সভ্যতায় মানুষের হোলিস্টিক ইভোলিউশন না বুঝলেও, মগজের বিবর্তন না বুঝলেও, মেডিসিneর বিবর্তন যাঁরা কখনো জানেন না, বোঝেন না, পড়েননি, তাঁদের পক্ষে নানা রকম অপশক্তির দ্বারা প্রভাবিত হওয়া খুব সহজ! ঠিক এই কারণেই, নানা রকম অবিজ্ঞান, কুসংস্কার, অপবিজ্ঞান মানুষের অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করে চলেছে!
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এদেরকে এমনি এমনি ঠেলে দিয়েছে বলে যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন!!
তো ভাবছিলাম – পৃথিবীব্যাপী বেশ কিছু ট্রাডিশনাল সিস্টেম অফ মেডিসিন নিয়ে অল্প অল্প করে ইতিহাস ঘেঁটে দেখবো!
সেই চেষ্টার প্রথম পর্ব এটি!
টাইটেল দেখে কিছু বুঝলেন না, তাই তো??
বলছি। আজকাল আমরা আর একসাথে চোখ এবং মগজ খাটাতে চাই না! অতএব, পড়ার কথা বললে টিভি চ্যানেলের হেডলাইন ছাড়া বাকি কিছু মাথায় আসে না! কারণ, মগজ সেখানে দরকার হয় না! এমনকি আধুনিক চিকিৎসক তথা বিজ্ঞানীরা বলে বলে গলা ফাটিয়ে ফেললেও, কানে কিছু ঢোকে না!! তাই কান দিয়ে শুরু করা যাক!
****
একসময় কিছু পণ্ডিত দাবি করতো – কানে যদি কোন নোংরা জমে বা বিষাক্ত কিছু থাকে, তাহলে একটা পাইপের মত মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্য দিকটা কানে ঢুকিয়ে দিলেই, সব নোংরা বা বিষাক্ত পদার্থ বেরিয়ে আসবে!! ধোঁয়া নাকি নেগেটিভ প্রেসার তৈরি করে সব টেনে বের করে দেয়!! এর গালভরা নামও ছিল! Ear candling বা ear coning! আরো একটি নাম আছে – thermal auricular therapy!
কিভাবে করা হতো? পরপর একটা বা দুটো মোমবাতি জ্বালানো হতো। একটা জলভর্তি থালা রাখা হতো কানের উপর। তার ভেতর দিয়ে মোমবাতিকে কানে ঢোকানো হতো!
তো এর ফলাফল কি ছিল? ফলাফল হলো – না পোড়া মোমবাতির শেষ ভাগে কিছু অদাহ্য পদার্থ জমা হতো! স্বাভাবিকভাবেই যা ছিল – মোমবাতিতে বর্তমান কিছু ইমপিউরিটিস। সেটা দেখিয়েই পণ্ডিতরা দাবি করতেন – কান পরিষ্কার হয়ে গেছে! তাঁরা এমনও দাবি করতেন – এতে নাকি রক্ত বিশুদ্ধ হয়, ক্যান্সার অব্দি সেরে যায়!!
বলা হয়, চীন মিশর বা নর্থ আমেরিকায় এই পদ্ধতি প্রথম চালু হয়। কেউ কেউ Hopi tribal medicine-কে এই পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য দায়ী করেন। কিন্তু তারা এটি অস্বীকার করেছে!
এবার এই পদ্ধতি আমাদের দেশের বাইরেই চলেছে বহুদিন। আমেরিকা, কানাডার ন্যাচারোপ্যাথ রা এটা করতো।
তো যখনই এই পদ্ধতির কার্যকারিতা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হলো, দেখা গেল – কোন কাজের কাজ হচ্ছে না!
কোন ভাবেই কোন চিকিৎসার সুফল পাওয়া গেল না!! টোটাল ধাপ্পাবাজি!
অতএব FDA, কানাডার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানরা , নাক কান গলার সব ডাক্তাররা একযোগে বলে দিল – এসব পুরোপুরি সিউডোসায়েন্স!
এর পেছনে কোনরকম যুক্তি তর্ক প্রমাণ নেই!! ন্যাচারোপ্যাথরা কিন্তু কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি!! তবু কি থেমেছে? সবচেয়ে বড় কথা – ২০০৮ সাল অব্দি এইসব ন্যাচারোপ্যাথরা মানুষকে এই ধাপ্পাবাজি দিয়ে নিজের পেট ভরিয়েছে!! হয়তো এখনো ভরায়! কেউ কেউ বললেন – এসব ব্যবসায়িক দিক ভেবেই এখনো কেউ কেউ প্রোমোট করেন!
আচ্ছা, জানতে চাইবেন না – ফলাফল কি হয়েছিল?? কান থেকে মোমবাতির অদাহ্য বর্জ্য পদার্থ বেরিয়েছে বটে, না নোংরা বেরিয়েছে, না কোন রোগের ক্ষেত্রে এটা কার্যকরী মনে হয়েছে!!
তবে লাভ কি কিছুই হয়নি?? হয়েছে। মানুষেরই লাভ হয়েছে!
অবাক হচ্ছেন? সত্যি ঘটনা শুনুন।
বলি, তাহলে কি – ২০০৮-এও চিকিৎসার সময় (ঘন্টাখানেক সঙ্গে গু-মন এর মতো) ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল! ফলাফল: দু’জন রোগী এই মোমবাতি থেকে নিজেদের ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল! একজন মরেছিল! প্রচুর রোগী শেষ অব্দি নাক কান গলা বিশেষজ্ঞদের কাছে গিয়েছেন – পুড়ে যাওয়া বা অন্য সমস্যা নিয়ে!!
ন্যাচারোপ্যাথ বা অন্য কোন বিশেষজ্ঞ বলতেই পারেন – কমপ্লিকেশন তো অন্য চিকিৎসাতেও হয়! হয় তো! কিন্তু তার প্রমাণিত বেনিফিট আছে! সেটাকে হাজার বার পরীক্ষা করলেও ফলাফল পজিটিভ আসবে!! এসেছে!!
কারো সাহস থাকলে, এ বিষয়ে নলেজ থাকলে আসুন না, সস্তায় কানে মোমবাতি গুঁজে একটু চিকিৎসা করে দেখান! বিজ্ঞান আপনার প্রমাণের অপেক্ষায় আছে সবদিন! সেটি যদি না করতে পারেন, দয়া করে কুযুক্তি দেবেন না!
আরো বড় কথা – সাধারণ মানুষ, যাঁরা কোন চিকিৎসা পদ্ধতিই জানেন না, তাঁদেরকে বলে দেখান তো – এভাবে ক্যান্সার চিকিৎসা করবেন! আধুনিক চিকিৎসকদের দরকার নেই! দেখুন না চেষ্টা করে! ওপেনলি করুন! কেউ মানা করছে না তো! লুকিয়ে চুরিয়ে লোককে বোকা না বানিয়ে আসুন টিভি চ্যানেলেই !! ক্যামেরার সামনেই আসুন! তারপর দেখুন, এই রকম মোমবাতি কার কার কোথায় কোথায় ঢুকিয়ে দেয় সাধারণ মানুষ!!!
যাঁরা এরপরও বলবেন – ট্রাডিশনাল মেডিসিন আমাদের গর্ব, এর পেছনে পয়সা অপচয় করা উচিত, তাঁদের জন্য বলবো – এই নিন মোমবাতি!! গর্ভিত হোন!! খালি ধোঁয়া বেরোলে একটু সাবধান হবেন পিলিজ!
এরপরও যাঁরা এই বিবর্তন বোঝেননি, তাঁদের কথা ভেবে শ্রীজাতর কবিতার লাইনটি বড্ড মনে পড়ছে –
“একটা সময় পেরিয়ে গেলে কোন কিছুই দাঁড়ায় না”!
(চলবে)