মারাত্মক দ্বিতীয় তরঙ্গটা তাহলে চলেই যাচ্ছে! যদিও এই অভিঘাতের রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন।
প্রথম ঢেউ এসেছিল অতিমারীর যাবতীয় বিস্ময় নিয়ে। এর আগে আমাদের প্রজন্মর সাথে মহামারীর প্রত্যক্ষ মোলাকাত কখনও হয়নি। বই পড়ে আর ইন্টারনেটে সার্চ করে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, ঠিক ততটুকুই ছিল ধ্যানধারণা।
যতদিন এগিয়েছে, ভাইরাস চমকে দিয়েছে তার সংক্রমণ করার শক্তি দেখিয়ে। দুয়োরাণীর মতো ঘরের এককোনায় পড়ে থাকা প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে তার সাথে লড়াই করা যে একপ্রকার আত্মহত্যার সামিল, বোঝা গিয়েছিল তখনই।
তা, যে কারণেই হোক না কেন, সেই প্রথম তরঙ্গ দেশের জনগণের উপর আছড়ে পড়লেও, তার অভিঘাত কিন্তু পৌঁছাতে পারেনি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। বলা যায় তা সীমিত ছিল শহর এবং লাগোয়া মফস্বলি এলাকায়। আর আমরা সেইসময় সারা পৃথিবীর দুর্দশা দেখে মনে মনে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছি এই ভেবে, যে কোন এক আলৌকিক শক্তি আমাদের দেশকে এই রোগের মারণ ক্ষমতা থেকে দূরে রেখেছে। বিশ্বাস এতটাই ছিল আমাদের, যে সরকার পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে দেন করোনা মুক্ত ভারতের কথা।
কিন্তু গল্প যে এতটা সহজ নয় তা আমরা বুঝতে পারিনি। অতিমারী কখনোই এক ধাক্কায় চলে যায় না। একশো বছর পুরনো স্প্যানিশ ফ্লু, এই অতিমারীর পুর্বপুরুষ কিন্তু অন্য কাহিনী শোনাচ্ছিল। মনে করিয়ে দিচ্ছিল, সেই অতিমারীর প্রথম তরঙ্গের পরবর্তী কালে মানুষের বাঁধন ছেঁড়া আচরণ, সামাজিক মেলামেশার বাড়বাড়ন্ত কেমন ভাবে ফিরিয়ে এনেছিল সংক্রমণকে। মিউট্যান্ট ভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করে বসতির পর বসতি সাফ করে দিয়েছিল তার সেকেন্ড ওয়েভে। আমাদের দেশের নদীনালাও ভরে উঠেছিল মানুষের মরদেহে। মৃতদেহ জ্বালানোর কাঠকুটো হয়ে পড়েছিল অপ্রতুল।
কিন্তু এইবারে এত কিছু ইতিহাস জেনেও যে লাভ হলো না আমাদের! অতিরিক্ত আত্মসন্তুষ্টি আর মানুষের বিশৃঙ্খল আচরণ আবারও ডেকে নিয়ে এলো সংক্রমণকে। দ্বিতীয় বারের জন্যে।
প্রথম অভিঘাতের পর আমরা আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা কে ঢেলে সাজানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু একমাত্র কেরালা ছাড়া আর কোন রাজ্য সরকার সেই রাস্তায় পা বাড়ালেন না। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ঘাড়ে এসে পড়লো নির্বাচনী প্রচার, আর কুম্ভমেলার মতো বহু মানুষের একত্রিত হওয়ার মতো ঘটনা।
সংক্রমণের এই সুবর্ণ সুযোগ মিউট্যান্ট ভাইরাস হাতছাড়া করলো না। অতিমারীর এই আগুন এবার ছড়িয়ে পড়লো শহর, মফস্বল হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শুধুমাত্র জীবনদায়ক অক্সিজেনের অভাবে মারা পড়লেন বহু মানুষ।
আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরেই তাই এখন শোকের ছায়া। প্রত্যেক পরিবারের কেউ না কেউ যে চলে গিয়েছেন এই অতিমারীতে সংক্রামিত হয়ে। নমো নমো করে জানাতে হয়েছে শেষ বিদায়, চোখের জল চোখেই রয়ে গেছে।
এই কষ্ট গুলি কোনদিন যাওয়ার নয়।
কিন্তু কি শিক্ষা পেলাম আমরা?
পারবো কি এরপর আমরা গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খোলনলচে পালটে ফেলতে?
পৌঁছে দিতে পারবো কি শ্বাসকষ্টের রোগীর কাছে জীবন দায়ী অক্সিজেনের সিলিন্ডার?
না কি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সরকারের
দায়িত্ব আবারও কাঁধে তুলে নিতে হবে রেড ভলান্টিয়ার্স দের মতো ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে এগিয়ে যাওয়া তরুণ তুর্কীদের! তাঁরাও যে নিজের সাথে পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন, বারংবার।
আজ অনেক দিন পরে বেশ ফাঁকা ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে দাঁড়িয়ে সে সব কথাই ভাবছিলাম।
শেষ দু মাস এখানে পা ফেলার উপায় ছিল না। চারিদিকে থিকথিক করছে রোগীর ভীড়। বেশির ভাগ কোভিড আর সামান্য কিছু নন কোভিড। আর তার মাঝখান দিয়ে গ্ল্যাডিয়েটরের বেশে ছুটে চলেছেন ডাক্তার, নার্স সহ স্বাস্থ্যকর্মীর দল। থমকে দাঁড়ানোর সময় নেই একদম।
ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে গেছে। আজ অনেক স্তিমিত সেই পরিস্থিতি। ফাঁকা ওয়ার্ডের একপাশে এক ‘ম্যানিকিন’ এর উপর ট্রেনিং চলছে জুনিয়র ডাক্তারদের। আপৎ-কালীন অবস্থায় কিভাবে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে হৃৎপিণ্ডকে, তার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সবাই। রোগীর সংখ্যা অনেকটাই কম। একটু রিল্যাক্সড ভাব সবার মধ্যে।
আমি অন্যদিকে আমাদের এক নন কোভিড রোগীকে নিয়ে পড়েছি। মাথায় রক্ত জমায় তাকে এখনই নিয়ে যেতে হবে অপারেশন থিয়েটারে। চলছে তারই প্রস্তুতি।
আমাদের কোভিড ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে, রোগীর অ্যাডমিশনের তুলনায় ডিসচার্জ বাড়ার ফলে। ধীরে ধীরে নন কোভিড রোগী আবার আসতে শুরু করেছেন হাসপাতালে।
তবে এর মধ্যেই কিছু খবর মনখারাপ করে দিয়ে গেল। এই লড়াইয়ে আমরা চিকিৎসকরা সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি সারা ভারত জুড়ে। চেনা বন্ধুবান্ধব থেকে অচেনা বহু ডাক্তারকে প্রায় রোজই চিরতরে হারাচ্ছি আমরা।
তবুও লড়াইয়ে আমাদের খামতি নেই। দৈনন্দিন সেই শোক ভুলেই আবার সবাই নেমে পড়ছেন ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই অসম যুদ্ধে। বাড়িতে কিন্তু সবারই রয়েছে পরিবার অথবা বৃদ্ধ বাবা, মা।
আজ তাই আসামে কোন এক গ্রামে এক জুনিয়র ডাক্তারের নিগৃহীত হওয়ার ভিডিও দেখতে দেখতে
আচমকাই মনে হলো, কাদের কথা ভেবে আমরা এই অসম লড়াইটা লড়ে যাচ্ছি নিজেদের জীবন বাজি লাগিয়ে?
যাদের জন্য যুদ্ধ চালাচ্ছি, তারা তো যে কোন সুযোগেই আমাদের উপর হাত ওঠাতে এতটুকুও চিন্তা করছে না!
প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা না পেয়ে হাতের কাছে পেয়ে যাওয়া ডাক্তারকে পিশাচের মতো মারধোর করে মেটাচ্ছে যাবতীয় জ্বালা! ভিডিওটা দেখলে মনে হবে যেন কত দিনের ঘৃণা জমে আছে সেই চিকিৎসকের উপর!
কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। চলে যাবে লড়াই করার উৎসাহ।
কিন্তু চিকিৎসক না মিললে পরিষেবা চলবে তো?
অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একেবারে সামনের লোকটাকে সরিয়ে দিলে বাঁচবে তো দেশ?
তাই প্রতিবাদ হোক চতুর্দিকে। আপামর চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের তরফ থেকে বটেই, সাধারণ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকেও সামিল হতে হবে এই প্রতিবাদে।অতিমারী চিকিৎসার সাথে সাথেই চলুক এই প্রতিবাদ।
মনে রাখতে হবে প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর সুস্থ থাকার সাথে জড়িয়ে আছে আপনার বা আপনার পরিবারের ভবিষ্যৎ।
আমরা সবাই সুস্থ থাকলে তবেই বাঁচবে দেশ আর শেষ হবে মহামারী।
তাই আজ আপাতত এটুকুই।
ভালো থাকবেন সবাই।
আবার ফিরে আসবো অন্য কোনদিনে। অন্য কোন কথা নিয়ে।