UNICEF-এর ব্যবস্থাপনায়, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের মেডিকেল টিমের অংশগ্রহণে, ১লা জুন থেকে ৩রা জুন, গোসাবার আশেপাশে ৭ টি দ্বীপের ১৫ টি উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে মেডিকেল ক্যাম্প করলাম আমরা।
এই লেখার উদ্দেশ্য কী করলাম আমরা তা নয় বরং কী দেখলাম কী শুনলাম কী শিখলাম।
কী দেখলাম কী শুনলাম?
প্রথমত, এই অঞ্চলে (গোসাবার আশেপাশে) আমফানের প্রভাব আয়লার মত ব্যাপক নয়। তার কারণ হিসেবে যেটা জানা গেল- সুন্দরবনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব যেটা পরে তা হল নদীবাধ ভেঙে নদীর জল, সমুদ্রের নোনা জল গ্রামের ভেতর ঢুকে পরা। ফলত যেসব অঞ্চলে আয়লায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয় তার কিছু অংশে ৪০ ফুটের বাঁধ (যাকে এরা বলে হাতি বাঁধ) তৈরী করা হয়। আমফান ঝড়ে সেই বাঁধ মূলত আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুরোপুুুরি হয়েছে কিছু কিছু অংশে (এর পেছনেও উঠে আসছে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি, অবৈধ ভাবে বাধ কেটে মাছ চাষের জন্য প্রভাবশালীদের জল ঢোকানোর মত অভিযোগ)। কিন্তু আর কয়েক ঘন্টা ঝড় চললে হয়তো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোও ভেঙে আয়লার থেকেও ব্যাপক সঙ্কটের সম্মুখীন হতে পারত গোটা অঞ্চল।
অন্যদিকে যেসব অঞ্চলে হাতিবাধ তৈরী হয়নি এবারের ঝড়ে সেসব অঞ্চলের দীর্ঘ বাধ ভেঙে বড় অঞ্চল জলের তলায়। সেসব অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতি আয়লার মতই।
দ্বিতীয়ত, আমরা যেসব অঞ্চলে গেলাম তার মধ্যে পুঁইজলি কুমিরমারি অঞ্চলে কিছু অংশে বাঁধ সম্পুর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্রামে জল ঢুকেছিল। কিন্তু গ্রামের মানুষ পরের দিনই নিজেদের উদ্যোগে সেই বাধ কাজ চলবার মত মেরামত করে জল ঢোকা আটকে দেয়। ফলে দ্বীপের বেশি অঞ্চল বেঁচে যায়। অনেক কাঁচা বাড়ি ভেঙেছে, বিশেষত খড়ের চাল আ্যাসবেস্টসের চাল উড়ে গেছে। কিন্তু এই দুসপ্তাহেই গ্রামের মানুষ নিজের উদ্যোগে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর মেরামতের কাজ এগিয়ে নিয়েছে অনেকটা।
তাহলে কী শিখলাম?
প্রথমত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে গ্রামের মানুষের তৎপরতা শেখবার মত। শহরের মানুষ যখন তার বাড়ির সামনের রাস্তায় গাছ সরাবার জন্য সরকারের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল (ব্যতিক্রম ব্যতীত) তখন গ্রামের মানুষ তার তাৎক্ষণিক সুরক্ষায় অনেক বেশি স্বনির্ভর।
দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় চাই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। যেভাবে হাতিবাধ কিছু অঞ্চলের মানুষকে বাচিয়েছে তাতে গোটা সুন্দরবন জুড়ে এই ধরনের নানান বিপর্যয় প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন এবং প্রতিটি দুর্যোগের পর তার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলোর দ্রুত মেরামত প্রয়োজন। এখন যদি আরেকটি বড় ঝড় আসে অনেক জায়গায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হাতিবাধগুলো সম্পূর্ন ভেঙে প্লাবিত হবে বিরাট অঞ্চল। আর এই প্লাবনের তাৎক্ষণিক ক্ষতির চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি অনেক বেশি। যেসব অঞ্চলে নোনা জল ঢোকে সেখানে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যায় কয়েক বছর। ফলে শুরু হয় গ্রাম ছেড়ে পরিবার ছেড়ে দূর শহরে লেবারের কাজ করতে যাওয়ার ঢল। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা এই লেখায় সম্ভব নয়।
অন্যদিকে যেভাবে কাঁচা বাড়িগুলো ভেঙেছে পাকা বাড়ির ক্ষতি সেভাবে হয়নি। সরকারি সাহায্যের মাধ্যমে যত দ্রুত সবার জন্য পাকা বাড়ির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ভবুষ্যতের বিপর্যয়গুলোর ভয়াবহতা কমাতে।
যাদের চাষের জমি ডুবে গেছে তাদের জন্য স্থানীয় স্তরে বিকল্প রোজগারের পথ বিকল্প গ্রামীন অর্থনীতির ভাবনারও অত্যন্ত প্রয়োজন।
আর প্রয়োজন সুন্দরবনকে রক্ষা করা। কোর অঞ্চলের পরিধি ছোট না করা। কোর অঞ্চল বা তার সংলগ্ন অঞ্চলে কোন ধরনের ব্যবসায়িক বৃহৎ নির্মাণ সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করা।
আজ আমরা যারা আমফান বিধ্বস্ত মানুষদের দিকে তাৎক্ষণিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি তারা যদি এই সূদুরপ্রসারী ব্যবস্থা নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারি, সরকারকে চাপ দিতে পারি, তাহলেই হয়ত এই মানুষগুলোর প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা দেখানো হবে।
যারা মানুষকে ভালবাসে এই কাজে অংশ নিয়েছেন এই লেখা তাদের জন্য। যারা দয়ার দান দিয়ে আত্মশ্লাঘা অনুভব করছেন তাদের জন্য নয় কারণ মানুষ দুর্ভোগে না পড়লে তারা ভবিষ্যতে দয়া দেখাবেন কি করে।
রিপোর্ট লিখেছেন চিকিৎসাদলের সদস্য ডঃ বিষাণ দত্ত।