দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২০
ডাক্তারদের ওয়েবম্যাগাজিন বলে কথা! এখানে আমার অসুখের লক্ষ্মণ, তার চিকিৎসা, ওষুধপত্তর, কেমোথেরাপির ঝঞ্ঝাট…. এ সব বলে বিশেষ লাভ নেই| তারচেয়ে বরং সুবিধাভোগী, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন হিসেবে দ-য় পড়লে, যাবতীয় অহংবোধ, আত্মশ্লাঘা, আত্মম্ভরিতা, মানে যা যা নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে থাকি, সেই ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’ মার্কা একজন কর্কটরোগ থেকে কি কি শিখলো তাই একটু বলি…
প্রথমেই ধাক্কা খাবেন খরচের নমুনা দেখে| সে যতই আপনার কলার-তোলা রেস্ত থাক| ক্যান্সার হয়েছে কিনা এটা বুঝতে গেলেও যা যা টেস্টের প্রয়োজন আমাদের দেশে অর্ধেক মানুষের বাৎসরিক আয় তাই| চিকিৎসা তো দূরের কথা! কাজেই জীবনের প্রায়োরিটি তৎক্ষণাৎ বদলে যাবে আপনার| যিনি এতদিন ভেবেছেন পনেরো বছরের চারচাকাটা বিক্রি করে আরো বড়ো একটা গাড়ি কিনবেন – তিনি ঐ বিক্রি অবধি গিয়ে ‘কেনা’র ধাপটি ধামাচাপা দিয়ে দেবেন| সন্তানকে বলতে হবে আপাতত মায়ের ফোনেই অনলাইন ক্লাস সারো, দেখি, তোমার ফোন কবে কিনে দিতে পারি! যে লোনগুলি নিয়ম করে শোধ না করলে বাড়িতে বাউন্সার আসে, সেগুলো বাদ দিয়ে বাড়ির যাবতীয় মাসিক খরচে থাবা বসায় ক্যান্সার| আর অসুস্থ মানুষটি পরিবারের প্রত্যেকের এই আত্মত্যাগকে নিজের ঘাড়ে নিয়ে দোষারোপ করতে থাকে নিয়তির..’কেন আমার সঙ্গেই এমন হলো…!?’ কিন্তু না, আজ কপাল চাপড়ানো নয়| ডক্টরস ডায়াল’-এর মতো এমন অসাধারণ একটি ওয়েব ম্যাগাজিনের জন্মদিনে কেক-কাটার মতোই কিছু আনন্দঘন মুহূর্তের সুলুক-সন্ধান দিতে বসেছি আমি| প্রথমেই ভেবে ফেলা যাক বিনয়-বাদল-দীনেশ যদি কয়েকখানা বোমা নিয়ে অত্তজন সশস্ত্র ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের তাগদ রাখতে পারে তাহলে আমি কম কীসে…! অর্থের যোগান দেওয়ার জন্য এখন নানাধরণের এন.জি.ও রয়েছে, যারা ক্যান্সার-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার বেশকিছুটা ভার বহন করে| রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, যদি আক্রান্তের আত্মীয়-পরিজন-বন্ধুরা সে দায়িত্ব নেন ক্রাউডফান্ডিং এখন যথেষ্ট তাড়াতাড়ি হয়|
চিকিৎসা শুরু হয়ে গেলে চেষ্টা করে ফেলুন ক্যান্সার-সারভাইভরদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা- এটা মাথায় রেখে যে প্রতিটি রোগী কিন্তু আলাদা| বাক্যালাপ করতে বলা এ কারণেই যাতে আপনার না মনে হয় যে জগৎ-সংসারে আপনি-ই একমাত্র ভুক্তভোগী| আর নিজের কথা, কোথায় কষ্ট, কতটা কষ্ট, কষ্টকে ছাপিয়ে কোথায়-কতটুকু আপনি জিতে যাচ্ছেন, সেল্ফ-ডিনাই করে অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের গল্প তো তখন আপনার মতো কেউই বলতে পারবেনা… সেই গল্প বলুন, সেই গল্প লিখুন| লিখতে গেলে আঙুলে জোর পাবেন না.. কলম বা কী-বোর্ড.. আঙুল ব্যবহার করতে কষ্ট হবে আপনার, সেক্ষেত্রে ভয়েস রেকর্ড করুন| আপনার অভিজ্ঞতার কথা রেকর্ড করে নিজের জন্যই সংগ্রহে রেখে দিন| নিজের সঙ্গে কথা বলুন| এ অসুখ যেমন বেঁধে বেঁধে বাঁচার কথা বলে তেমনই এ অসুখ একলা মানুষের একাকী চলার মন্ত্র-ও যোগায়| আশেপাশে আপনার নানান মানুষ| কেউ আরো জড়িয়ে ধরবে, কেউ ভাববে ‘যেমন কর্ম, তেমন ফল’, কেউ ভাববে ‘কবে যে মরবে?’, আবার কেউ মোটে কিছু ভাববেই না…! আর এতসব ভাবনার মাঝে এই অসুখের মজা হলো এ অসুখ সর্ব অর্থেই আপনাকে দ্বিজত্ব দান করবে| চল্লিশ বছরের জীবন কাটিয়ে সেই যে পাহাড়চূড়ায় পাথরে ধাক্কা মেরে মেরে নিজের ভোঁতা হয়ে যাওয়া ঠোঁট টুকরো টুকরো করে ফেলে ঈগল, তারপর সে ঠোঁট ফের গজায়, তারপর সেই নতুন ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে সে খুবলে নেয় ডানার পুরনো পালক| তারপর ফের পালক গজিয়ে উঠলে একাকী ঈগল পৃথিবীর স্বাদ-গন্ধ-দৃশ্যের জন্য আরো লুটেপুটে নেয় মুহূর্ত – ঠিক তেমনই কেমোর কষ্ট আপনার মাথার চুল উপড়ে ফেলবে, ভুরু নির্মূল করবে, চোখের পাতা থাকবে না| আর সে কারণে মাথার ঘাম আক্ষরিক অর্থেই পায়ে পড়বে| ঘাম ভ্রূ বা আঁখিপল্লবের বাধা না পেয়ে সোজা আপনার চোখে ঢুকে জ্বালিয়ে দেবে চোখ| আপনার জিভ কালো হয়ে যাবে, হাত-পায়ের নোখ কালো হয়ে যাবে, চ্যানেল ফুটে ফুটে হাত ফুলে যাবে, হাতেরশিরা দপদপে-যন্ত্রণায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম হবে, পেশীতে মারাত্মক ব্যথা হবে, বিনিদ্র রজনী কাটাতে হবে, আপনার হাঁটাচলা হয়ে যাবে অশীতিপর বৃদ্ধের মতো, আর আপনি সেই একা ঈগলের মতো এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাবেন কারণ আপনিই সেই নাছোড়বান্দা মানুষ যিনি বিশ্বাস করেন ‘আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা/ মিথ্যা হত কাননে ফুল ফোটা….’
সাহস, ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস – এ বড় ক্লিশে হয়ে যাওয়া শব্দগুচ্ছ| কিন্তু ক্যান্সারের সঙ্গে সম্মুখসমরে এরাই আমাদের মহাস্ত্র| আর ভালো গান, ভালো ছবি, ভালো বই… যা আপনাকে উদ্দীপ্ত করবে, শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে দেবে আনন্দ, স্নায়ুতে পৌঁছে দেবে আলোকবার্তা– সে সব দিয়ে ঘিরে রাখুন নিজেকে| এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যেটুকু শরীর আর মন অনুমতি দেবে সেটুকুই করবেন| অন্য অনেক কাজ, যা কিনা করতে পারছেন না আপাতত, ফেলে রাখুন| আর জড়িয়ে ধরুন চিকিৎসকের চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথকে| তাঁর ওষুধ প্রতিদিন নিয়ম করে আত্মস্থ করলে আপনি ফের চাঙ্গা.. ঠিক পূর্ববৎ…
‘আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা – তরিতে পারি শকতি যেন রয়/ আমার ভার লাঘব করি নাইবা দিলে সান্ত্বনা, বহিতে পারি এমনি যেন হয়…’
আর হ্যাঁ, এই অসুখ শেখায়, সুস্থ হয়ে জীবনের ছন্দে ফিরে এলে পাশে দাঁড়ানো সেইসব মানুষদের যারা অর্থের জন্য স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-বাবা-মায়েদের ক্যান্সার চিকিৎসার সামান্যতম উদ্যোগটুকুও নিয়ে উঠতে পারেননা|
জন্মদিনে তাই তো বলি many happy returns of the day and be responsible…