এই সেদিন বছর বাইশ-তেইশের একটি মেয়ে আমাকে দেখাতে এসেছিল। শ্যামল বরণ। ছোটবেলা থেকে কালো মেয়ে কালো মেয়ে শুনতে শুনতে একদিন সে মহৌষধের সন্ধান পায়। মনোবেঞ্জাইল ইথার অফ হাইড্রোকুইনন (20%) ক্রিম। দু-তিন মাস মুখে ঘষার ফলে তার রং একটু ফর্সা হতে শুরু করল। তারপরে সে একদিন দেখল জায়গায় জায়গায় ছুলির মতো সাদা ছোপ পড়েছে। এক ওষুধের দোকানের দোকানদার কাকু তাকে মনোবেঞ্জাইল ইথার অফ হাইড্রোকুইনন লাগানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই দোকানে গেল মেয়েটি। দোকানদার কাকু বললেন, ও কিছু নয়, ছুলি হয়েছে। ছুলির ওষুধ নিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি গেল সে। চলল মনোবেঞ্জাইল ইথার অফ হাইড্রোকুইনন, সঙ্গে চলল কাকুর পরামর্শমতো ছুলির ওষুধ। কিন্তু ছুলির দাগগুলো ক্রমশ আরো বেশি সাদা হয়ে যাচ্ছে যে! তখন সে প্রথম ডাক্তারের কাছে গেল। তিনি বললেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে। তারপরে সে এল আমা্র কাছে।
আমি দেখলাম সাদা দাগগুলো ছুলি নয়। ওখানে ত্বকের স্বাভাবিক রঙ তৈরি হচ্ছে না। ত্বকের মধ্যে কালো রং তৈরি করে কিছু কোষ, তাদের বলে মেলানোসাইট। সাদা জায়গাগুলোতে চামড়ায় কোনও মেলানোসাইট কোষ নেই, সেগুলো মরে গেছে। এই ব্যাপারটা শ্বেতীরোগেও হয়। সাদা জায়গায় আর কখনো স্বাভাবিক ত্বকের রঙ তৈরি হবে না। একমাত্র আশা, আশেপাশের মেলানোসাইট কোষ যদি এই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে পারে, তাহলে সাদা দাগ একটু কমবে। পুরোপুরি মিলিয়ে যাবে কিনা বলা খুব শক্ত, তবে সম্ভাবনা খুব কম।
মনোবেঞ্জাইল ইথার অফ হাইড্রোকুইনন (20%) এখন বাজারে সহজে পাওয়া যায় না। শরীরে শ্বেতী হয়ে যদি শরীরের অনেকটা চামড়া সাদা হয়ে যায়, তাহলে বাকি স্বাভাবিক চামড়াতে ওই ক্রিমটি লাগিয়ে তাকে সাদা করা যায়। এই একটি ক্ষেত্রেই এর সঠিক ব্যবহার। ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ এই ওষুধটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কিন্তু আমাদের দেশে ওষুধ বিক্রির ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। একসপ্তাহের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে দশ বছর ওষুধ খাওয়া যায়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ পাওয়া যায়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া যে কোনো ক্রিম লাগানো যায় অনন্তকাল। ফলে এইরকম দুর্ঘটনা ঘটল। ফর্সা হতে গিয়ে মেয়েটির সারা মুখে সাদা সাদা প্রায় স্থায়ী দাগ হয়ে গেল। মনোবেঞ্জাইল ইথার অফ হাইড্রোকুইনন একটি সহজপ্রাপ্য ওষুধ নয়, তাই বাঁচোয়া। এই মেয়েটির মতো ঘটনা আমি জীবনে অল্পই দেখেছি। কিন্তু অজস্র মানুষ দেখেছি যাদের মুখে বা অন্যত্র ফর্সা হবার ওষুধ লাগিয়ে ভয়ানক ক্ষতি হয়েছে।
কী সেই ওষুধ?
ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষ পাগল হয়ে খুঁজে ফিরছে সেই জিনিসটি, যাতে তাদের রং ফর্সা হবে। কালো ছেলের যদি বা দাম থাকে কালো মেয়ের কোনও দাম নেই। এই সামাজিক অবস্থায় কম বয়সী ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে মেয়েরা, যে ফর্সা হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর প্রসাধন সামগ্রী প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো নানারকম ফেয়ারনেস ক্রিম বের করে। সেই ফেয়ারনেস ক্রিম কাজের কিনা সেটা পরে দেখব। আগে একবার দেখে নিই এই সমস্ত স্বঘোষিত ফেয়ারনেস ক্রিম ছাড়া আর কী কী জিনিস ফর্সা হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
সানস্ক্রিন
এই একটি জিনিস ‘ফর্সা’ হবার জন্য ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ব্যবহার করা ক্ষতিকারক নয়, এবং টানা ব্যবহার করে যেতে পারলে মুখের রং সাময়িকভাবে একটু হালকা হবে। সানস্ক্রিন সূর্য রশ্মি থেকে মুখের ত্বককে আগলে রাখে। ত্বকে সূর্যরশ্মি লাগলে তার রঙ কালচে হয়ে যায়। সানস্ক্রিন ত্বকের ওপর ছাতার কাজ মতো করে, ফলে ত্বকে স্বাভাবিক কালো হয় না বা ‘ট্যান’ পড়ে না।
মনে রাখতে হবে প্রত্যেকের ত্বকের একটি স্বাভাবিক রং আছে। যতই সানস্ক্রিন লাগানো হোক না কেন, কাপড়জামায় ঢাকা থাকা ত্বক যতোটুকু ফর্সা থাকে, মুখের চামড়া তার থেকে বেশি ফর্সা হবে না। জামা কাপড় যেমন করে আমাদের শরীরে সব জায়গার চামড়া ঢেকে রাখে, সানস্ক্রিন অনেকটা তেমন করেই মুখ ইত্যাদি খোলা জায়গার চামড়াকে ঢেকে রাখে, তার বেশি কিছু নয়। উপরন্তু একবার লাগানোর পরে সানস্ক্রিন মোটামুটি দু-ঘন্টা কার্যকর থাকে। গরমের দেশে বেশি ঘামলে এই কার্যকারিতা আরো কমে যায়। সুতরাং সানস্ক্রিন দিয়ে ত্বকের রঙ যদি ঢাকা জায়গার মতো ফর্সা করতে হয়, তাহলে বারবার সানস্ক্রিন লাগাতে হবে। আবার সূর্যালোক একেবারে না লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয় না, সেটা আরেকটা ভাবার বিষয়।
ফর্সা হবার ভুল ওষুধ
আমাদের ত্বকে কালো রং তৈরি করে মেলানোসাইট নামে একটি কোষ। যখন কারো ত্বকে মেলানোসাইট-গুলি বেশি পরিমাণে মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ তৈরি করে, তার ত্বক কালো হয়ে যায়। ফর্সা মানুষের ত্বকে মেলানোসাইট কোষ কম পরিমাণে মেলানিন তৈরি করে।
ত্বকের মেলানোসাইট কোষগুলিকে কম কার্যকর করে দিয়ে কাজ করে কয়েকটি ওষুধ। আমি তাদের সবগুলির নাম উল্লেখ করতে যাচ্ছি না। এদের মধ্যে প্রতিনিধি-স্থানীয় এবং কার্যকর একটা ওষুধ হলো হাইড্রোকুইনন। মনে রাখবেন মনোবেঞ্জাইল ইথার অফ হাইড্রোকুইনন আর হাইড্রোকুইনন এক জিনিস নয়। হাইড্রোকুইনোন দু শতাংশ থেকে চার শতাংশ ক্রিম দিলে মেলানিন তৈরি কমে। হাইড্রোকুইনন (2%-4%) ক্রিম বিশেষ করে মেচেতা-জাতীয় ত্বকের রোগে ব্যবহৃত হয়। কৃত্রিমভাবে ফর্সা হওয়ার জন্য ব্যবহার করলে মুখটা সাময়িকভাবে সাদাটে হয়ে যায়, তারপর মুখে সাদা ছোপ-দাগ পড়ে যায়। সেই দাগ সারানো বেশ কঠিন। এছাড়াও কিছু রাসায়নিক আছে, তারা সবাই মেলানিন তৈরি কমায়। এগুলো ব্যবহারে রঙ সামান্য একটু ফর্সা হয়, কিন্তু স্বাভাবিক ত্বকে বেশিদিন মাখলে সেটা কতটা নিরাপদ, সেটা জানা নেই।
স্টেরয়েড ক্রিম
ফর্সা হবার সবথেকে প্রচলিত ঔষুধ হল স্টেরয়েড মলম বা লোশন। প্রচলিত একটি নাম হলো বে**ভেট। এটি তৈরি করে যে ওষুধ কোম্পানি, তারা কোথাও বলে না এটা ফর্সা হবার ক্রিম। কিন্তু স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ বেশি ব্যবহার করলে ত্বক সাময়িকভাবে খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়, এটা এই ওষুধের একটা ক্ষতিকর পার্শ্বক্রিয়া। মুখে এই ক্রিম লাগিয়ে ফর্সা হবার চেষ্টা করে অনেকে, ফল ভয়ানক। সাময়িক সাদাটে হবার পরে মুখ লাল হয়ে যায়, চুলকায়, জ্বালা করে, অজস্র ব্রণ বেরয়। চামড়া পাতলা ও খুব সেনসিটিভ হয়ে যায়, বিশেষ করে রোদে বেরলে খুব কষ্ট হয়। মেয়েদের মুখেও দাড়িগোঁফ বেরতে থাকে। হেরোইনের নেশার মতোই একবার শুরু করলে থামানো শক্ত, লাগানো বন্ধ করলে লালভাব ও জ্বালা বাড়ে, ওষুধ আবার লাগালে সাময়িক ভাল থাকা যায়। ডাক্তাররা পর্যন্ত এই ‘নেশা’ সারাতে হিমসিম খান।
বে**ভেট একমাত্র স্টেরয়েড ক্রিম নয়। আরও অনেক স্টেরয়েড ক্রিম আছে। সেগুলোর প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো কেউই সেগুলোকে ফর্সা হবার ক্রিম বলে দাবী করেন না। স্টেরয়েড মিশ্রিত অনেক ক্রিম আছে যা এমনিতে খুব বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাদের মধ্যে কয়েকটির প্রস্তুতকারী সংস্থা ক্রিমটিকে বেআইনিভাবে বিজ্ঞাপিত করেন দাদের ক্রিম হিসেবে, এমনকি চর্মরোগের সর্বরোগহর আশ্চর্য মলম হিসেবে। পাশ-না-করে যারা ডাক্তারি করেন তাঁদের কাছে সর্বরোগহর আশ্চর্য মলম বড়ই আকর্ষণীয়, তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় অনেক পাশ-করা ডাক্তারও রোগ না-ধরে এরকম মলম প্রেসক্রাইব করেন। কিন্তু সে-প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র। মোটের ওপর, প্যা**র্ম, কো**ডার্ম ইত্যাদি পাঁচমিশালী মলম রোগ না-বুঝে যেকোনো চামড়ার রোগে দেওয়া হয়, আর দেওয়া হয় রঙ ফর্সা করতে। এখন তো পাড়ার লোকের কথা শুনে নিজেরাই লাগান সবাই। ফল বে**ভেট লাগানোর মতোই ভয়াবহ।
আরেক জাতের মিশ্র মলম মূলত মেচেতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শমাফিক লাগাবার কথা, কিন্তু ফর্সা হবার মলম হিসেবে খুব অপব্যবহার হয়। এটা হল হাইড্রোকুইনন (২-৪%) এর সঙ্গে স্টেরয়েড ও ভিটামিন এ জাতীয় যৌগের মিশ্রণ। মেলা**র ইত্যাদি ব্র্যান্ডনামে বাজারে চলে।
ফর্সা হবার বাজারি ক্রিম
বিভিন্ন নামী কোম্পানির ফেয়ারনেস ক্রিমগুলির অধিকাংশতেই একটু সানস্ক্রিন দেওয়া থাকে। সেটা মুখের চামড়া একটু ফর্সা রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এইসব ক্রিমে সানস্ক্রিন ছাড়াও যেসব জিনিস থাকে তাদের অনেকগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত নয়, ফলে কিছু ক্ষতিকর জিনিস থাকতেও পারে। মনে রাখতে হবে ওষুধ হিসেবে কিছুকে ছাড়পত্র পেতে গেলে নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা বিষয়ে বেশ কড়া কিছু মাপকাঠি পেরতে হয়, কসমেটিক হিসেবে ছাড়পত্র পাওয়া অনেক সোজা।
সম্প্রতি দু-তিনটি বেশ বড় কোম্পানি স্টেরয়েড মেশানো ক্রিম রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘ফর্সা হবার ওষুধ’ বলে বাজারে ছেড়েছে। এটা একেবারেই বেআইনি। কিন্তু আমাদের শিবঠাকুরের আপন দেশে সবই চলে। সুতরাং আপনার ত্বকের স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তা সরকারের নিয়ন্ত্রক দপ্তরের হাতে চোখ বুঁজে ছাড়বেন না।
শেষ কথা
ফর্সা হবার দরকার নেই। ফর্সা হবার ব্যাপারটি একটা সামাজিক কুপ্রথা।
ফর্সা হবার ওষুধ বলে যা চলে তাদের মধ্যে কিছু একেবারে সরাসরি বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর, অন্য কয়েকটি খুব প্রচলিত কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত নয়।
সানস্ক্রিন একমাত্র পরীক্ষিত ও সামান্য কাজের।
Please provide some enlightenment about Glutathione