‘উইকেট পড়ছে’, শব্দগুলো জীবনের বিভিন্ন সময় ভিন্ন মানে নিয়ে হাজির হয়। ছোটোবেলায় উইকেট মানে ছিল ঠাকুমার বসার কাঠের টুল, পাঁচ ছ’টা ইঁট একটার ওপর আর একটা সাজানো, তিনটে লাঠি পর পর রাখা। একটা লাঠি দিয়ে মা সাবান কাচত আর আমাদের পেটাতো, অন্যটা দিয়ে পিসি পাখি তাড়াতো আর একটা দাদুর লাঠি।
এই সাবান কাচার লাঠিটা একটা ইতিহাস। দুপুরের রান্না যখন শেষ হতো তখন পড়ন্ত আঁচে এক বড়ো হাঁড়িতে জল গরম হতো। তারপর একটা বড়ো বালতিতে সার্ফ, ডেট বা নিরমা সাবান গুঁড়ো দিয়ে তাতে গরম জল ঢালা হতো। তারপর এই লাঠিটা দিয়ে সাবান গোলা হতো আর জামাকাপড় চোবানো হতো। বাড়িতে ভাইরা কেউ বেশি বদমাইশি করলে এই লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। মা আমাকে মারার জন্য যেই এই লাঠিটা খুঁজতো আমি চিল্লাতাম, ঠাকুমা গো, মা মেরে ফেললো গো। মা লাঠিটা হাতে পাবার আগেই ঠাকুমা আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে মাকে বলতো, তোমার কোনো আক্কেল নেই ছোটো, বৌমা। মারলেই কি ছেলে মানুষ হয়। আমরা কী বাচ্চা মানুষ করিনি। সে যাত্রায় বেঁচে যেতাম। মা যেদিন মারত এক হাতা পায়েস বা ক্ষীর একটু বেশী পেতাম।
আমরা প্রথম উইকেট পেলাম লাল্টুর জন্মদিনে, ওর ছোটো কাকা দিয়েছিল। লাল্টু আউট হলে ওর উইকেট নিয়ে চলে যেত, তাই ওকে একটু বেশী খেলতে দিতে হতো। যাই হোক, তখন উইকেট পড়া মানে ছিল আউট হাওয়া। নিজে আউট হলে একটু মন খারাপ, অন্য কেউ হলে মহা স্ফূর্তি।
তারপর কলেজে পড়ার সময় আবার উইকেট পড়তে লাগলো। মানে বন্ধুরা প্রেমে পড়ছে, গ্রুপটা ছোটো হচ্ছে। ক্যান্টিনে আমাদের টেবিলটা ছেড়ে তিনটে টেবিল দূরে বসতো, ঘাড়টা নিচু করে ফিস ফিস করে কথা বলতো আর সব কাজ করার আগে GFএর পারমিশন নিতো। তার তিন চার বছর পর উইকেট পড়া মানে হোল বিয়ে হওয়া। এই উইকেট পড়াটা ছিল বিশাল মস্তির। এই করতে করতে গিঁটগুলো আলগা হতে লাগলো, কিন্তু ভালোবাসার সেই অদৃশ্য সুতোটা জড়িয়েই থাকত। বন্ধু মানেই গালাগালি, বন্ধু মানেই গলাগলি।
তারপর চুলে পাক, রক্তে চিনি ধরলো, ঘুম থেকে উঠেই চশমাটা খুঁজে লাগালাম। এবার উইকেট পরা মানেই চির বিচ্ছেদ, শুধু স্মৃতি নিয়ে থাকা। কিছুক্ষণের মন খারাপ, কিছুক্ষনের ভয় পাওয়া, তারপর আবার রোজের কাজে ফিরে যাওয়া। ফোনে আরো কিছু নাম আর নম্বর বেড়ে যায় যেখান থেকে আর কখনো ফোন আসবে না। কিন্তু সেগুলো ডিলিট করতেও মন চায়না। মানুষ’টার গায়ে না হোক নামটার ওপর একদিন হঠাৎ আঙুল বোলোবো! ❤️