এবারের সরস্বতী পুজোর দিনটা শুরু হয়েছিল অন্য সব বছরের মতোই স্বাভাবিক ভাবে।
গতবছর লকডাউনের সময় থেকেই সরস্বতী পুজোর দায়িত্বটা আমার মেয়ে নিয়ে নিয়েছে তার মায়ের কাছ থেকে। এবারেও তার অন্যথা হলো না।
মূর্তি কেনা থেকে শুরু করে পুজোর আনুষঙ্গিক জোগাড় যন্ত্র সব প্রস্তুত দেখে দুপুরবেলা বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতালে। একটা ছোট অপারেশন রাখা রয়েছে। তারপর বাড়ি ফিরেই পরিবারের সাথে পুজোয় যোগদান করার পরিকল্পনা এক্কেবারে পাকা।
কিন্তু আপনি যদি পেশায় চিকিৎসক হন এবং আপনার জীবনে ‘ইমারজেন্সি’ বলে কোন বিষয় থেকে থাকে সে ক্ষেত্রে কোন কিছুই আপনার ইচ্ছে মত ঘটবে না। পরিবার পরিজন অথবা বন্ধু-বান্ধবদের জন্য হিসেব করে রাখা ‘সময়’, কাজের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাবে যখন তখন। আর ঠিক তাই হলো।
অপারেশন শেষ হতে না হতেই ইমারজেন্সিতে ডাক পড়লো আমাদের। আঠারো বছরের একটি ছেলে, সাগ্নিক, অচৈতন্য অবস্থায় ইমারজেন্সির বেডে শুয়ে রয়েছে। এই রকম অবস্থায় এক সপ্তাহ ধরে সে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছে। উপযুক্ত পরিষেবার অভাবে চিকিৎসা হয় নি।
সাগ্নিকের মস্তিষ্কের পিছনের অংশে, যাকে আমরা ডাক্তারি পরিভাষায় বলি, সেরিবেলাম, সেখানে গজিয়েছে একটি বড় টিউমার, যা ব্রেনের ফ্লুইডের (সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড) সঞ্চালন বন্ধ করে দিয়ে, মস্তিষ্কে জলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এবং ঠিক এই কারণেই সংজ্ঞাহীন সাগ্নিক। পরীক্ষা করে দেখা গেল ছেলেটির রক্তচাপ বেশ কম। দ্রুত মস্তিষ্ক থেকে টিউমারটি বের না করে দিতে পারলে, তার মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা। তার উপর সাগ্নিক আবার কোভিড পজেটিভ। কোভিড এখন সেরকম পাত্তা না পেলেও, হাসপাতালের প্রটোকল মেনেই তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিতে হবে। ব্যবহার করতে হবে পিপিই সমেত যাবতীয় ঢাল তরোয়াল।
সাগ্নিককে সেখানেই টিউব পড়িয়ে ভেন্টিলেটরে লাগিয়ে নিয়ে আসা হলো অপারেশন থিয়েটারে।
সময় যে খুব মূল্যবান। কোভিড নিয়ে ভাবার সময় নেই কারো। তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে এই অপারেশন।
এর মধ্যেই সকলে জানেন, কোভিড রোগী হাসপাতালে কমে গেছে অনেক। তাই রাস্তায় বা হাসপাতালের বাইরে বেশীর ভাগ মানুষ বেশ উদাসীন মাস্ক ব্যবহারে। কানে-গলায় মাস্ক, তাবিজ কবচের মত ঝুলিয়ে আড্ডা চলছে যত্রতত্র। হাত ধোওয়ার পরিমাণও কমে গিয়ে, সুস্থ থাকা মানুষের মনে মহামারী থেকে স্বস্তির এবং বিপদ কেটে যাওয়ার একটা সন্তুষ্টির আভাস দেখা যাচ্ছে। দেশ বিদেশের বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন ভারতীয় উপমহাদেশে অদ্ভুত ভাবে স্বল্পসংখ্যক কোভিড মৃত্যুহারের কারণ। কেউ বলছেন শরীরে আলফা ওয়ান অ্যান্টিট্রিপসিন এনজাইমের উপস্থিতি তো আবার অন্য কেউ বলছেন হাজার হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আদিম মানুষের (Neanderthal) বিশেষ জিন নাকি বাঁচিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর এই অংশের মানুষকে।
যে কারণেই হোক, এই মহামারীর প্রথম পর্ব নিশ্চিতভাবে সমাপ্ত হলেও, সিঁদুরে মেঘ কিন্তু দেখা যেতে শুরু করেছে ঈশান কোণে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকেই ধীরে ধীরে, স্বল্প হলেও করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আমাদের দেশে। মূলত মহারাষ্ট্র এবং কেরালা ছাড়াও পাঞ্জাব মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্রিশগড়েও বাড়ছে কোভিড। এবং সেটা সারা দেশজুড়ে কোভিড ভ্যাক্সিনেশনের চলাকালীন। যা মূলত হেলথ এবং ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কারদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও, পরের সপ্তাহ থেকে শুরু হয়ে যাবে অন্যদের মধ্যে। সরকারি ছাড়াও বেসরকারি সংস্থা গুলিতেও পাওয়া যাবে ভ্যাক্সিন। এইরকমই বলছে খবর।
এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে জিন সিকোয়েন্সিং রিপোর্টে কোভিড ভাইরাসের মিউটেট করার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজারের মতো। সেটা শুধু মাত্র আমাদের মতো দেশে যেখানে টেস্ট হয়েছে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। সারা পৃথিবীর হিসেবটা যে কি পরিমাণ হতে পারে তা এখান থেকেই ধরে নেওয়া যায়!! বোঝাই যাচ্ছে কি দ্রুত হারে প্রতি মূহুর্তে বদলাবার চেষ্টা করছে ভাইরাস প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু মিউটেটেড ভাইরাসের মধ্যে মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেওয়া বা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার মত কোন বিপদ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এটাই যা বাঁচোয়া। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যে পাওয়া যাবে না, এমন ভাবনার কিন্তু কোনো কারণ নেই। স্প্যানিশ ফ্লু এর সময়েও এই রকম মিউটেটেড ভাইরাস এবং মানুষের বেপরোয়া আচরণ ডেকে এনেছিল সেকেন্ড ওয়েভ। আর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল এই দ্বিতীয় তরঙ্গের অভিঘাতেই। আর এটাও মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবী জুড়ে কোভিড ভাইরাসের যে তিনটি মিউটেশন (ইউ কে, ব্রাজিল আর দক্ষিণ আফ্রিকা) রোগ সংক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে ইদানীং তার বিরুদ্ধে আমাদের ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড কিন্তু একটু দুর্বল। সুতরাং ভ্যাকসিন নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য,….. নৈব নৈব চ।
তাই সাধু সাবধান। আমাদের কিন্তু দ্রুত ফিরে যেতে হবে মাস্ক আর স্যানিটাইজেশনের জগতে।
দরকার ছাড়া বেরোনো একেবারেই নয়। সামাজিক মেলামেশা কমানোর সময় আবার এসে পড়েছে।
সাগ্নিকের অপারেশন শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল আমাদের। অচৈতন্য রোগীকে ভেন্টিলেটরে কোভিড আই সি ইউ তে পাঠিয়ে বাড়ি ফিরলাম যখন, তখন প্রায় মাঝরাত। সরস্বতী পুজো শেষ হয়ে গেছে বহু আগে। পাড়ার ক্লাবের মা ঠাকরুনের চোখেও সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি আর ঘুমের আভাস। বউ আর মেয়ের সাথে সাগ্নিকের গল্প করতে করতেই পুজোর খিচুড়ি খাওয়া শেষ করা হলো।
এই রকমটাই হয় বেশীর ভাগ ডাক্তারের জীবনে।
পরিবারের সকলেও মেনে নেয় ধীরে ধীরে। ধরেই নেয় এই লোকটা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারবে না কখনো।
যাই হোক আমাদের পুজোর দিন ও রাতের লড়াইয়ের কারণে সেই সাগ্নিক বাবু পরের দিন থেকেই দ্রুত সুস্থ হওয়া শুরু করে আজ বাড়ি যাওয়ার পথে। এ বছরের সরস্বতী পুজোর দিনটা ওর মনে না থাকুক, আমাদের মনে থাকবে অনেকদিন।
অতএব, ভালো থাকবেন সকলে। কোভিডের বাদল মেঘ ঘনাতে শুরু করেছে আবার। তবে সাবধানতা অবলম্বন করলে বিপদের ভয় নেই– এটুকু বলে দিতেই পারি নিঃসন্দেহে।
আবার ফিরে আসবো অন্য কোন দিন। অন্য কোন গল্প নিয়ে।