অজকর্ণ তার বহু যত্নে গজানো নতুন সাদা দাড়ি নেড়ে প্রচুর হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বড় উঁচু পাথরটায় উঠে বসে ঘোষণা করল,’ আমিই এখন থেকে এই জঙ্গলের রাজা।’
জঙ্গলের মাঝখানে এই জায়গাটায় অনেকটা ঘাসজমি। তার একদিকে সিংহাসনের মত এই উঁচু পাথরটা। অনেককাল ব্যবহার না হওয়াতে শেওলা জমে পেছল হয়ে গেছে। আজকাল এতে কেউ বসে না, কারণ গণতন্ত্রে রাজসিংহাসন ফাঁকাই থাকে। তার জায়গা নিয়েছে গদি। বহুদিন আগে সিংহ যখন রাজা ছিল, এখানে বসেই সে জঙ্গল শাসন করত। সিংহের অবর্তমানে এই জঙ্গলের রাজত্ব এখন অজকর্ণের দখলে।
বনের পশুরা কেউ অবাক চোখে, কেউ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে, কেউ মহাবিরক্ত হয়ে অজকর্ণের কান্ড-কারখানা দেখতে লাগল।
মেঠো ইঁদুর কুতকুতে চোখ মেলে বলল, ‘আমি সিংহকে একবার শিকারীর ফাঁদ কেটে উদ্ধার করেছিলাম। কিন্তু এই ব্যাটাকে করব না।’
পেটমোটার একটাও কান নেই। দুটোই কাটা। সে বলল, ‘দরকার নেই। শিকারীরা আর আসবে না। আমি শিকারীদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছি।’
খ্যাঁকশিয়াল ধূর্ত চোখে ভাবল, এইবার নিজের লোক রাজা হয়েছে। জঙ্গলের সব কটার রক্ত চুষবো। আধপেটা খেয়ে থেকেছি কতদিন! সব সুদে-আসলে পুষিয়ে নেবো এবার। তবে মনের কথা মনের মধ্যেই রেখে সে বলল, ‘রাজ্যাভিষেক-টা এবার হয়ে যাক।’
পেটমোটা বলল, ‘তার আগে ইঁদুর, খরগোশ, কাঠবেড়াল – এদের সব কটাকে আটক করা দরকার। অভিষেকের সময় এরা দল বেঁধে চেঁচিয়ে ঝামেলা পাকাতে পারে।’
‘কিন্তু বিচার ছাড়া ওদের ওভাবে আটক করা যায় নাকি?’
‘খুউব যায়। নতুন আইনগুলো লেখা হল কি এমনি এমনি! পুরোনো জঙ্গুলে আইন সব বাদ। তাছাড়া ঘড়িয়াল কুমির তো আছেই। ডাঙ্গায় এসে ও এখন আমাদের লোক। ও-ই বিচার করবে।’
ঘড়িয়াল কুমীর একটু মুচকি হেসে চোখদুটো পিটপিট করে বলল, ‘মাছ খাবো। বেশী না, বড় সাইজের দুটো বোয়াল মাছ হলেই চলবে।’
‘কোনো ব্যাপার না। সব হয়ে যাবে।’
অজকর্ণ আপন মনে আকাশটার দিকে তাকিয়ে ছিল। উত্তর-পশ্চিমে মেঘ জমছে। ফটোগ্রাফার একটা ক্যামেরা ষ্ট্যান্ড বসিয়ে ফোকাস করছিল। অজকর্ণ লাফিয়ে উঠে বলল, ‘দাঁড়াও দাড়াও, ভালো করে একটু মেক আপ নিয়ে নিই।’
মেকআপ ম্যান এসে দাড়িতে মেহেদি ঘসতে বলল,
‘দাড়িটা একেবারে সিংহের কেশরের মত বানিয়ে দেব। কেউ বুঝতে পারবে না।’
শুনে সবুজ ভামবেড়ালটা ফ্যাঁচ করে হেসে ফেলল।
সামনের গাছের ডালে পা দুলিয়ে বসে থাকা রঙবেরঙের গিরগিটিটা বলল, ‘হেঁ হেঁ, আমি আসবো না কি? যদিও সাতে-পাঁচে থাকি না, তবে আমি কিন্তু খুব ভালো তেল মাখাতে পারি।’
পেটমোটা বলল, ‘না না, এখনই আসার দরকার নেই। এখন প্রচুর বেনোজল ঢুকে পড়ছে।’
আকাশ নীল। জঙ্গলের ছায়া পড়েছে পাথরের সিংহাসনে। দূরে কোরাসের মত একটা আওয়াজ শোনা যেতে থাকল। শব্দটা কাছে আসতেই বোঝা গেল, অনেকগুলো ঘিলু শুখিয়ে যাওয়া গাধা একসাথে অভিষেক মন্ত্র বলছে।
অজকর্ণ পেটমোটার কানে কানে বলল, ‘রাজা তো হলাম, কিন্তু আমি যখন অন্য জঙ্গলে চরতে বেরোবো তখন কি রাজ্যের কি হবে? সিংহাসন বেহাত হয়ে যাবে না?’
খ্যাঁকশিয়াল কথাটা ঠিক কান পেতে শুনে ফেলেছে। পেটমোটা মাথা চুলকে কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, ‘কোনো অসুবিধে নেই। একটা ঘ্যামা স্ট্যাচু বানিয়ে দেব। সবাই সেই স্ট্যাচুর সামনে ভক্তিভরে প্রণাম করবে।’
হাওয়াটা বইছিল অনেকক্ষণ। হঠাৎ সেটা মৃদু থেকে বেড়ে ঝড়ে পরিণত হল। মাটি কাঁপিয়ে দলে দলে ইঁদুর ছুটে এল চারিদিক থেকে। অজকর্ণ একা দাঁড়িয়ে। বাকি সুযোগ বুঝে সবাই পালিয়ে গেছে। জঙ্গল কাঁপিয়ে একটা শব্দই শোনা যেতে থাকল, ‘দাড়ি ধরে মারো টান। রাজা হবে…’
ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ কচলে দেখলাম টিভিতে ‘হীরক রাজার দেশে’ চলছে।
অসাধারণ।