কোঁচকানো শিরা ওঠা হাতে বুড়ো গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা। বুড়ো গাড়ি ভারী খুশি কতো মাস, কতো বছর পরে বুড়ো ডাক্তার বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া খোলা জানালায় উড়ে যায়, মিলিয়ে যায়।
যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য চাকরি ছেড়ে অনির্দেশে বেরিয়ে এসেছিলো, তখনও এক মাথা কালো চুল আর উন্নত শির ছিলো, এক বুক স্বপ্ন ছিলো।
আপন দেশ গাঁয়ে মোট মিষ্টির দোকান ছিলো তিনটি।দেবেন, ভূষণ আর শ্রীকৃষ্ণ। তা’ও তাদের টিমটিমে ব্যবসা। কাপড়ের দোকান নেই। স্কুলের পোষাক কিনতে কাঁচড়াপাড়া হকার্স কর্নার ভরসা। দেশে কিছুদিন উপার্জনের চেষ্টা হলো, সেই দূর নগরউখড়া, গয়েশপুর, শিমুরালি- কিন্তু এসব করে ডাক্তার উচ্চ শিক্ষার পড়া করবে কখন? অগত্যা কলকাতা। পোড়া পেটের দায়ে-যেভাবে গ্রামের চাষী, মজুর, ক্ষেতের মনীষ ঘটি বাটি নিয়ে, মাটির শেকড় ছিঁড়ে শহরে আসে- সেই ভাবে।এখানে কতো মানুষ, কতো গাড়ি, কতো কতো দোকান, এখানে ঠিক দুটো টাকা উপার্জন হবে। হবেই। সৎ ভাবে, কম পয়সায় রোগী দেখলে কী কিছু রোগীও আসবে না?
তারপর এ দোকান, সে দোকান ঘোরা আর ফেরত আসা। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী। বিবেকানন্দ ফার্মেসির ৺শিশিরবাবু সকাল সাতটা থেকে আধঘণ্টা সময় দিলেন।আর ছোটোমামার দোকানে সন্ধেবেলা সাড়ে ন’টা থেকে। থাকতাম তখন ছোটোমামার বাড়িতেই। বাড়ি ভাড়া করার টাকা কোথায়? তখন ছোটোমামার দোকানে তার আগে চৈতন্যদা বসেন। কাজেই সাড়ে ন’টা পর্যন্ত বই নিয়ে ডাক্তার প্রদীপ কানুনগোর চেম্বারে বসে বই পড়ি। আমার তখন সপ্তাহে একটা দুটো রোগী। ধারা সর্ষের তেল তখন পাঁচশোর প্যাকেট পনেরো টাকা। গলানো সোনা তিরিশ টাকায়- এই বিজ্ঞাপন তখন প্রতিটি বাতি স্তম্ভে। প্রথম রোগীর টাকায় ধারা সর্ষের তেল কেনা। মেয়ের খাবার। কতো খরচা। এক হাজার পঞ্চাশ টাকা স্টাইপেন্ড-তাও নিয়মিত নয়। আস্তে আস্তে জমানো টাকা খৎম।
মা বাবা তখন তাদের জমানো টাকা থেকে মাসিক আয় প্রকল্পে আমাদের জন্য এক হাজার করে টাকার বন্দোবস্ত করলো। প্রতি মাসে হাত পেতে টাকা নিতে যদি ছেলের সম্মানে বাধে! দিন যায়, মাস যায়, বছর তিনেক পরে ভাড়া বাড়িতে উঠলাম। দুটো বারান্দা, একটা টগর গাছ। এভাবেই চলতে থাকলো। কোনোদিনই দক্ষিণাটা চেয়ে নিতে পারি নি। রিপোর্টিং ফ্রী।
এমন সময় এক বয়স্কা রোগী আমার কাছে খুব দরিদ্র এক রোগী নিয়ে এলেন। ইভামাসি আর ইনা খাতুন। শুরু হলো এক অন্যতর অধ্যায়।
মেডিক্যাল কলেজে সুনীতি মুখার্জী নামে একজন জরায়ুতে মৃত শিশু বহন করে সেপ্টিসিমিয়া, বেড সোর, গভীর রক্তাল্পতা নিয়ে ভর্তি ছিলো। বোধহীন,অজ্ঞান সুনীতি মুখার্জি। কলকাতার ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে দুই বন্ধু রক্ত নিয়ে এলাম। পূতিগন্ধময় বেডসোরের নিত্য ড্রেসিং হলো।সুনীতি স্বাভাবিক হলো। স্বামী এলো, সবাই এলো। সুন্দরী সুনীতি বাড়ি ফিরলো।
এই ইভামাসির ইনা খাতুন, এক বোবা কালা কঙ্কালসার মুসলিম যুবতী। এর শরীরময় গ্ল্যান্ড ফুলে আছে। জ্বর, অক্ষিধে, প্রত্যহ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। পাওয়া গেল টিবি। কে একে হাসপাতালে নেবে? কে এই বোবা মুসলিম কন্যাকে ওষুধ দেবে?
মেয়ে ভালো হলো। শুরু হলো বৃহস্পতিবার বিনা পয়সার চিকিৎসা। এরপর দেখা গেলো কেউ শুক্রবার অসুস্থ হলে পরের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তারপর প্রতিদিন দুপুরে ফ্রি। আনলিমিটেড মহত্বগিরি। এর বোধহয় একটা নেশা আছে। যেমনি টাকা উপার্জন করার নেশা, যেমনি আছে নতুন নতুন গাড়ি বাড়ির নেশা। ক্রমশঃ প্রয়োজনীয় টাকা হয়ে গেলেই তারপর যে দিলো, দিলো-না দিলো বয়েই গেলো। সবাই বলবে ভুল করেছি। আমার টাকা নিয়ে আফশোস কোনও কালেই ছিলো না। আজও নেই। থোড়িই মরে গেলে ব্যাঙ্কের টাকা তুলতে পারবো!
লোকে ধরে ন্যায় দয়াবান গুণবান পুণ্যবান ডাক্তার মশাই যা বলবো সেটাই করে দেবে। না মিথ্যা সার্টিফিকেট দিই নি। নেতাদের মুখের ওপরে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছি। অকারণে, বা শুধু টাকার জন্য কারো বাড়িতে রোগী দেখতে যাই নি। রোগী নিয়ে আসুন, অপেক্ষা করুন, আমি প্রয়োজনে বিনা পয়সায় দেখবো কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখবো না। ওষুধের দোকানের অনুরোধে ওষুধ লিখবো না। ওষুধের কোম্পানি? ওরা সবাই জানে এ লোকটা উপহার চায় জ্যান্ত পেঙ্গুইন বা চাঁদে বেড়াতে যেতে। তবে পেন আর ওষুধ আমি নিতাম। অনাথ আশ্রম, গরীব বাচ্চাদের লেখা পড়ার জন্য। ওদের হাসি দ্যাখার জন্য। ওষুধ সব পরীক্ষিত দাতব্য সেবাকেন্দ্রে যেতো।
ক্রমশঃ শত্রু বেড়েছে। এই লোকটা প্র্যাকটিস করে অথচ আমাদের মানে না। এ কেমন বৈরী?
সহ্য করতে করতে আজ দীপঙ্কর মারা গেলো। যে বলতো পরোয়া করি না। নিয়ে এসো তোমার রোগী আর ওষুধ। আমি এখানেই বিনা পয়সায় তোমার কেমোথেরাপি ওষুধ চালিয়ে দিচ্ছি। চলো তোমার শয্যাশায়ী রোগীর কাছে বিনা পারিশ্রমিকে কেমো চালিয়ে দেবো। লিখে দিচ্ছি ওষুধ বাড়িতে শিরায় চালানো ওষুধ চালু করুন। পরে বাকি দেখা যাবে। এই দীপঙ্করের আজ মৃত্যুদিবস।
যদি সে ফিরে আসে অর্থাভাবে তখন সেটা হবে পলিক্লিনিকে। যেখানে ফিরে দেখার সুযোগ থাকবে না যে কে কোমরের গেঁজে থেকে বা আঁচলে গিঁট বাঁধা শেষ সম্বলটুকু দিচ্ছে। ওষুধ কেনার পয়সাটা আছে তো? প্রশ্নটা আর আসবে না।
এখন আমি মায়ের বাড়িতে ফিরছি। হাস্নুহানা, কামিনী, বেলা, জুঁই, চাঁপার গন্ধ মাখা,রঙন, ফুরুস, জবা, স্থলপদ্ম, গোলাপ আর রক্ত করবীর রংয়ে রাঙা বাড়ি। মায়ের পোঁতা ফলভারে নত আম্রপালি সারা রাত ধরে একটা একটা করে আম ঝরিয়ে দিয়ে বলে “ক্ষিদে পেলে খেয়ে নিস কিন্তু”, সঙ্গে থাকে গীতা দত্ত, দেবব্রত, কিশোর মুকেশ লতা হেমন্ত, ঋতু, আরতি। এরা আমার কথা মতো গান গায়। শুয়ে থাকি আমার লাইব্রেরি পাঠভবনের খাটে।
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে, হঠাৎ দুখানা আর্টারি বন্ধের বিপদে বা চলন্ত জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের চাকার সামনে ঘেঁস্টে এক মাইল গিয়েও মরি নি। মৃত্যুকে গুনে গুনে তিনবার হারিয়েছি। এখনও খেলায় তিন শূন্য এগিয়ে। বড়ো জোর একটা গোল খাবো। তাও তিন একে জয়।
আমাকে রঙিন ফুলের মালা দিও হে। আদ্যন্ত রঙিন মানুষ আমি। বর্ণ, গন্ধ, সুর আর রূপে মাতাল। আমাকে সাদা মালা মানায় না।