একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানের চেম্বারে প্রতিদিন অন্তত চারভাগের একভাগ রুগি এই সমস্যা নিয়ে আসেন। রুগিরা প্রেস্ক্রিপশনের এই ডাক্তারি পরিভাষা ব্যবহার করেন না। তাঁরা বলেন, ‘প্রচন্ড দুর্বল। ডাক্তারবাবু। সারাদিন ঘুম পায়। কাজের কোনো ইচ্ছে নেই। বিছানা থেকে উঠতেই পারছি না। প্লিজ কিছু করুন। অফিস থেকে আর ছুটি দিচ্ছে না। আমার উইদাউট পে হয়ে যাচ্ছে। এই কোভিডের বাজারে সংসার চালাব কিভাবে?’ কেউ কেউ বলেন, ‘ডাক্তারবাবু সারা গায়ে পায়ে ব্যথা। কাজ করতে গেলেই বুক ধড়ফড় করে। এত উইক। আমার দুটো বাচ্চা মেয়ে। ছোটটা চার বছরের। আমি আর আমার স্বামী থাকি। প্লিজ কিছু করুন”।
রুগিরা অনেক আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছেন কিন্তু আমি কী করব? কেন করব? আমি তো জানি না কেন এমন হচ্ছে? অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি জানি না কেন এমন হচ্ছে? ডাক্তারি শাস্ত্রও জানে না কেন এমন হচ্ছে। তারা বলছে এমন হয় কিন্তু কেন? সঠিক কোনো উত্তর নেই। কোভিডের পরবর্তী প্রচন্ড দুর্বলতার কথা ছেড়ে দিলাম। এই গত তিন সপ্তাহে সারা বাংলা জুড়ে যেরকম ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ চলল, যদিও তা এখন অনেকটাই কমের দিকে, এই জ্বর কমে যাবার পর সবাই এই দুর্বলতার সমস্যা নিয়ে আসছেন।
জ্বরটা যদিও এখনকার অনুষঙ্গ কিন্তু সারা বছর ধরেই আমরা ডাক্তারেরা এই সমস্যার রুগিদের পাই। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। এঁদের মধ্যে অনেকেই মানসিক সমস্যায় ভোগেন। ডিপ্রেসনে ভোগেন। কেউ থাইরয়েডের সমস্যায় ভোগেন। কেউ ক্যানসারের রুগি। কেউ ডায়াবিটিক। কেউ ক্রনিক ফেটিগ সিন্ড্রোমের রুগি। কেউ হার্টের অসুখের চিকিৎসা করাচ্ছেন। যাঁদের ক্ষেত্রে আমরা কারণ জানতে পেরেছি তাঁদের নিয়ে সমস্যা নেই। আমরা জানি কারণটার সমাধান করলেই হয়ত তিনি কিছুটা ভালো বোধ করবেন। আর যাঁদের সমস্যার সমাধান নেই তাঁদের জন্য আশার বাণী তো আছেই। কিন্তু যাঁদের কারণ জানি না, সবে জ্বর থেকে উঠেছেন, কিংবা অনেকদিন হল বড় কোনো অসুখ থেকে সেরে উঠেছেন তাঁদের নিয়ে কী করব?
খুব নামজাদা, ব্যস্ত ফিজিসিয়ান হলে তিনি ডক্টর হাউসের মত বলবেন, ‘জাস্ট ডু নাথিং। অ্যাজ ইট ইজ ডিউ টু পোস্ট ভাইরাল ইটিওলজি, ইট উইল রিসল্ভ বাই ইটসেলফ। ডোন্ট ওয়েস্ট ইউর টাইম অ্যান্ড এনার্জি”। একদম হক কথা। তবে সমস্যা হল আমি তো ডক্টর হাউস নই। আমার কাছে দৈনিক যে জনা পনের জন রুগি এই সমস্যা নিয়ে আসছেন তাঁদের আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে যেতে বলতে পারি না। তাঁরা আমার কাছে অনেক আশা নিয়ে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে আমি কী করব?
ইদানিং কোভিডের জলবায়ুতে অনেক ডাক্তারবাবুরা আমেরিকানদের মত খুব স্মার্ট হয়ে গেছেন। তাঁরা সবাই এমন রুগি পেলেই সি আর পি, এল ডি এইচ, ইন্টারলিউকিন সিক্স, ভিটামিন ডি, প্রোক্যাল- এসব নানান বাঘা বাঘা ব্লাড টেস্ট করতে দিচ্ছেন। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শুধু রুগিদের পকেটে টান পড়ছে। তাঁরা হয়ত বলবেন, ‘যে কোনো ভাইরাল ফিভারের পরে ইনফ্ল্যামেটরি মিডিয়েটর বেড়ে যায়। এতে ফেটিগ হতে পারে’। একদম। সত্যিই পারে। হয়ত তাই হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা জেনে আমি কী করব? অতঃকিম? আমি তো সেই ভিটামিন আর আশ্বাসই দেব। তাহলে আমার মতে এসব করিয়ে লাভ কিছু নেই। আমি তাই কিছুই করাব না।
যাঁরা করালেন তাঁরা কী খুব দোষ কিছু করেছেন? না, তাঁরা ঠিকই করেছেন। তাঁরা জানার চেষ্টা করেছেন। মেডিসিন, সায়েন্স ইজ অল আবাউট আ কোয়েস্ট। আর পরীক্ষা করাতে দিয়ে তিনি রুগির থেকে কিছুটা সময় চুরি করে নিলেন। সে এই সময়ের মধ্যে সুস্থ হয়েও যেতে পারে। আমি যে কিছু করলাম না আমি দোষ করলাম? না, আমিও দোষ করলাম না। কারণ পরীক্ষার ফলাফলের ওপর আমার রুগির ভালোমন্দ নির্ভর করছে না। আমিও জানি তাঁরাও জানেন সে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। সুতরাং আমি আমার রুগিদের পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করছি।
সে তো বাঁচালাম। যিনি এসেছেন তিনি তো আমাকে পয়সা দিয়েই দেখাচ্ছেন। তার থেকে পয়সা নিয়ে কী বলে দেব দেখুন কিছু করার নেই, আপনি এমনিই ভালো হয়ে যাবেন। আমার দক্ষিণাটা দিন। তারপর কেটে পড়ুন। রুগি কি তাহলে এরপর আর আমার কাছে আসবে? একেবারেই না। তাহলে তাঁকে আমার কিছু ওষুধ দিতে হবে। কী দেব? আমি জানি না। কোনো ওষুধের কথা চিকিৎসাশাস্ত্রের মান্য বইয়ে বলা নেই। তাই হাতের পাঁচ ভিটামিন। খেয়ে কি কিছু হবে? কিছুই হবে না। কোভিডের সময় যেমন কোটি কোটি লোক অ্যাজিথ্রোমাইসিন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, ডক্সিসাইক্লিন, আইভারমেক্টিন, ভিটামিন সি খেয়ে গেল কোনো লাভ ছাড়াই- এক্ষেত্রেও তাই। তবে আমাকে দিতে হবে। কারণ আমাকে প্র্যাকটিস করে খেতে হয়। আর লোকে ডাক্তারের কাছে আসে ওষুধ খেতে।
তবে এমন যদি কেউ থাকেন যিনি বোঝালে বোঝেন, যিনিও আমার মত ওষুধ খাবার পক্ষপাতী নন তার চিকিৎসা আমি কেমনভাবে করব? ‘যদি’ বললাম বটে কিন্তু এমন অনেক রুগি আছেন। তাঁরা আমার অনেকদিনের চেনা। পুরনো রুগি। তাঁদের আমি যা বলব তাঁরা তাই করবেন। তাঁরা আমাকে বিশ্বাস করেন। তাঁদের আমার প্রতি আস্থা আছে। তাঁদের আমি তাই বলি অন্য সব চিকিৎসকরাও ওষুধ লেখার পরে মুখে যা যা বলেন।
বিশ্রাম নিন। বিশ্রাম নিন। বিশ্রাম নিতে হচ্ছে বলে আপনি নিজেকে দুর্বল ভাববেন না। আপনি বিশ্রামের মাধ্যমেই দ্রুত সুস্থ হবেন। জল বেশি করে খান। খেতে ইচ্ছে না হলেও খান। ভালো লাগলে সরবত বা ও আর এস খেতে পারেন। ইউরিন পরিষ্কার হচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখুন। ‘গো ফর কালার্স’। সবুজ শাকসবজি আর রঙ্গিন ফল খান। যে টাকা দিয়ে ফালতু ভিটামিন খাবেন সেই টাকায় আম কিনে খান। এ বছর আমের ফলন খুব ভালো। বাজারে এখনও সত্তর টাকায় ভালো ল্যাংড়া, চৌসা, আম্রপালি পাওয়া যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের আনারস খান। বারুইপুরের পেয়ারা খান। পেয়ারা অনেক সময় রুচি ফিরিয়ে আনে। পেট পরিষ্কার করে।
বাড়ির ছাদে একটু একটু করে হাঁটুন। না হয় ঘরেই বা বাড়ির পাশের রাস্তায় হাঁটুন। শারীরিক এক্সারসাইজের থেকে আরোগ্যের ভালো উপায় কিছু নেই। আমাদের মাসল-জয়েন্ট যত নড়াচড়া করবে তত এন্ডরফিন তৈরি হবে শরীরে। তত আপনি ভালো বোধ করবেন। তত আপনার ব্যথা-বেদনার অনুভূতি কমে যাবে। কোনো যোগব্যায়াম যদি আপনি ভালো পারেন সেটাই দিনে কয়েকবার করুন।
মাছ খান বেশি করে। মাছের তেল আরোগ্যে সাহায্য করে। সময়মত শুতে যান, সময়মত উঠুন। এতদিন বিছানায় শুয়ে থেকে আপনার দেহের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’-এর গন্ডগোল হয়ে গেছে। আপনি আবার তাকে ‘রিসেট’ করুন। আপনি ‘মর্নিং লার্ক’ হতে পারেন বা ‘নাইট আউল’। দেরি করে ওঠা আপনার চিরকালের অভ্যাস হতে পারে। তাহলে সেই অভ্যাসেই ফিরে যান। ‘আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ’ বলে কিছু নেই। আপনি আপনার নিজের অভ্যাসে আবার ফিরে যান। রাতের ঘুম খুব দরকার। তেমন হলে দিনে ঘুমোবেন না। রাতে শোবার আগে মোবাইল দেখবেন না, নেটফ্লিক্স দেখবেন না। সেটা না হয় দিনের বেলা দেখুন।
মন ভালো রাখতে আপনার যা ভালো লাগে তাই করুন। প্রতিদিন ভাববেন আপনি আগের দিনের চেয়ে আজ একটু বেশি ভালো। আকাশের দিকে গাছেদের দিকে বৃষ্টির দিকে তাকান। প্রকৃতির থেকে বড় ডাক্তার কেউ হতে পারে না। আরোগ্যের উপলব্ধি প্রত্যেকের মনকে নবীন করে তোলে। বেঁচে থাকাটার মূল্য আমরা অসুস্থ হয়েই বুঝতে পারি।
নিজের টোটকা নিজে করুন। বাড়িতে মা-বাবা-ঠাকুমারা যা বলবেন তাই করুন। অড়হর পাতার রস খান, কুলেখাড়া পাতার রস খান, আখের গুড় ছোলা হলুদ খান, উচ্ছে পাতার বড়া, শেফালি পাতার বড়া, রসুনের কোয়া, ভাজা সাচি পেঁয়াজ- তাঁরা যা যা দিচ্ছেন তাই খান। ওনারা প্রকৃতির থেকে শিখেছেন। সংস্কারের মূল্য অনেক। আমরা তাদের গুরুত্ব বুঝি না তার কারণ আমরা তার অনুসন্ধান করি নি। যা খেয়ে আপনার ক্ষতি হবে না, তা আপনি খেতেই পারেন। উলটে আপনি সেই টোটকা বিশ্বাস করে খেয়ে আপনার প্রিয় মানুষটিকে খুশি করলেন। তাঁর সুখ ও প্রার্থনাও আপনার আরোগ্যে সাহায্য করবে।
এতসব বললাম কারণ এমন রুগিরাই এখন আসছেন। পরে যদি কোভিডের থার্ড ওয়েভ আসে তারপর আবার প্রচুর পরিমাণে আসবেন। এটা খুব সাধারণ একটা মতামত। সাধারণ রুগিদের জন্য। একজন সাধারণ ব্যাক্তিগত চিকিৎসকের পক্ষ থেকে। জীবনে সহজ বিষয়ে অভ্যস্ত হোন। সহজ সত্য। সহজ যুক্তি। সহজ পথ্য। সহজ পথ। পৃথিবীটা বেঁচে থাকার পক্ষে বিরাট কঠিন জায়গা নয়। আমরা তাকে অনেকটাই কঠিন করে তুলি। কারণ আমাদের সময় কাটাতে হবে। জটিলতা একটা মানসিক নির্বাচন। এটা তাদের জন্য যারা মনে করে পৃথিবীকে ঠিকঠাক করে তোলার সব দায়িত্ব ঈশ্বর কেবল তাদেরকেই দিয়ে পাঠিয়েছেন।
আপনি আরোগ্যে জেন সাধকদের মত হয়ে উঠুন। বিশ্বাস করুন জীবন জলস্রোতের মত। সে যখন থমকে দাঁড়িয়েছে আপনিও স্থির হয়ে দাঁড়ান। লক্ষ্য করুন পেছনের জলস্তর চাপ বাড়াচ্ছে। আবার সে ঠিক তার পথ করে নেবে। এই স্থিতিটাই আপনার ফেটিগ, আপনার আরোগ্য। জলের মতই সে আবার এগিয়ে চলবে। আপনি একটু ধৈর্য ধরুন।
বড়ো ভালো লিখেছেন হে। এ্যাতো কম লেখেন ক্যানো? আমি নিজেকে জিপি বলি না। হাতুড়ে বলি। এই সব মানুষদের শুধু সময় দিতে হয়, কথা বলতে হয়, বকতে হয়, ভালবাসতে হয়।
আমাদের বড়ো ডাক্তার বাবুরা ভালো বাসতে ভুলে গেছেন।