হাই ফাইবার যুক্ত খাবার
আমরা অনেকেই শুনেছি, খাবারে ফাইবার থাকে, সেই মত খাবার হাই বা লো ফাইবার হতে পারে। আজ আমরা খাবারের ফাইবার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তবে এ কথা আগেই বলে নেওয়া ভাল, ফাইবার আছে বলেই আমাদের রোগ-ভোগ অনেক কম হচ্ছে, কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করে শরীর সতেজ ও সবল থাকছে।
আগে জেনে নিই ফাইবার কি?
আমাদের খাবারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১) প্রোটিন ২) ফ্যাট ৩) কার্বোহাইড্রেট। এই কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারের থেকে আমাদের শরীর গ্লুকোজ পায়, যা না হলে আমরা বেঁচে থাকতে পারিনা। কারণ গ্লুকোজই আমাদের মস্তিস্কের একমাত্র খাদ্য।
কার্বোহাইড্রেট বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। এর মধ্যে এক ধরণের কার্বোহাইড্রেট আছে, যা আমরা হজম করতে পারিনে, ফলে মলের সাথে নির্গত হয়ে যায়। এই জাতীয় কার্বোহাইড্রেটকে বলে হাইবার।
ফাইবার আবার দুই ধরনের হয়
১। জলে দ্রবণীয়
২। জলে অদ্রবণীয়।
জলে দ্রবণীয় ফাইবার
জলে দ্রবণীয় ফাইবার জলের সাথে মিশে গিয়ে থকথকে জেলী জাতীয় এক প্রকার পদার্থ তৈরি করে এবং পাকস্থলী থেকে অন্ত্রের মাধ্যমে মলের সাথে নির্গত হয়। পেকটিন, ইনিউলিন, এবং বিটা গ্লুকান, জাতীয় যৌগ এই ফাইবারের প্রধান উপাদান। এই ফাইবার শরীরে যে সব উপকার করে তার মধ্যে
১) পেকটিন খাবারের ফ্যাট শোষণে বাধা দেয়, বিটা গ্লুকান খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়। ফলে এই ফাইবার শরীরের মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
২) ব্লাড প্রেসার কমায়। কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ব্লাড প্রেসার বাড়ার অন্যতম কারণ। কোলেস্টেরল শিরায় ও ধমনীতে জমা হয়ে রক্তনালিকার স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়, পকলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে, প্রেসার বাড়ে। ফাইবার দুটোই কমিয়ে দেয়।
৩) গ্লুকোজের শোষণে বাধা দেয়, ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম বাড়ে। এইভাবে এই ফাইবার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। বা যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ইন্সুলিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
৪) পেকটিন, ইনিউলিন ও বিটা গ্লুকানকে প্রিবায়োটিকও বলা হয়। কারন এই ফাইবার আমাদের শরীরে উপকারী ব্যাকটিরিয়া বা প্রোবায়োটিকের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আমরা হজম করতে না পারলেও উপকারী ব্যাকটিরিয়া বা প্রোবায়োটিক খাদ্য হিসাবে এই ফাইবার বা কার্বোহাইড্রেট ব্যবহার করে। উপকারি ব্যাকটিরিয়ার বৃদ্ধির ফলে আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে, পেটের অসুখ বা অন্য রোগ কম হয়।
যে সব খাবারে জলে দ্রবণীয় ফাইবার বেশি থাকেঃ সাধারনতঃ ফল বা শস্যের মাংসল অংশে এই ফাইবার বেশি থাকে। যেমন আলু, রাঙ্গা আলু, ওট মিল, বিউলি ডাল, মুশুর ডাল। বার্লি, আপেল, কমলালেবু ইত্যাদি। এই সব খাবার রান্না করলে গাঢ় লালা বা আঠাল হয়ে যায়।
জলে অ-দ্রবনীয় ফাইবারঃ
এই ফাইবারে সেলুলোজ ও লিগনিন জাতিয় যৌগ থাকে।
এই ফাইবার জলে দ্রবীভুত হ না, ফলে থকথকে হয়ে যায় না। আবার আমরা এই ফাইবার হজমও করতে পারিনা। ফলে এরা শক্ত অবস্থায় থাকে এবং মলের সাথে নির্গত হবার সময় আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্রের ময়লা আবর্জণা ঝাটার মত ঝাট দিয়ে বের করে নিয়ে যায়। এক কথায় এরা আমাদের পেট পরিষ্কার করে, মলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
বিভিন্ন ধরণের ডাল, ছোলা-মটরের খোসায়, ধান বা গমের ভুসিতে এই ফাইবার বেশি থাকে।
যে সব ফলের খোসা শক্ত, যেমন আলু, রাঙ্গা আলু, নাসপাতি, পেয়ারা, আপের ইত্যাদির খোসায় এবং শক্ত ধরণের ফলে এই ফাবার থাকে। এই ফাইবার আমাদের যে ধরণের উপকার করে তার মধ্যে আছে-
১) কোষ্ঠকাঠিন্য কমিয়ে দেয়। ফাইবার হজম হয় না, ফলে মলের পরিমাণ বাড়ে।
২) পাইলস হতে বাধা দেয় বা যাদের পাইলস আছে তাদের পাইলস নিরাময় করে।
৩) মল বা মলের নোংরা দীর্ঘ সময় ধরে অন্ত্রে জমে থাকা অন্ত্রের ক্যান্সারের বা কলোরেকটাল ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। যেহেতু এই ফাইবার তাড়াতাড়ি মল নির্গত করে এবং সব কিছু ঝেঁটিয়ে বিদায় করে অন্ত্রকে পরিস্কার রাখে, তাই দেখা গেছে, যারা বেশি ফাইবার যুক্ত খাবার খায়, তাদের অন্ত্রের ক্যন্সারও কম হয়।
ফাইবার যুক্ত খাবারের উপকারিতাঃ
ফাইবার যুক্ত খাবার খেলে সামগ্রিক ভাবে আপনার শরীরের কি কি উপকার হয়, এবার আমরা তাই সংক্ষেপে আলোচনা করব।
- পেট সংক্রান্ত অসুখ কমায়। প্রোবায়োটিক জাতীয় ব্যাকটিরিয়ার বৃদ্ধির ফলে পেটের আসুখ কমে। আর যে সব অসুখ কমায়, তার মধ্যে আছে- পাইলস, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা, কিডনি স্টোন কমায়, গলব্লাডার স্টোন কমায়, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম কমায়।
- অন্ত্রের বা কোলোরেকটাল ক্যান্সার কমায়।
- অন্ত্রের গ্লুকোজ শোষণ কমিয়ে দিয়ে ডায়াবেটিস কমায়।
- ভাল HDL কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমায়, ফলে পরোক্ষে অনেক রোগ কমে।
- হার্টের অসুখ কমায়। কোলেস্টেরলের সাথে হার্ট এটাক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। HDL কোলেস্টেরল বাড়ার ফলে হার্টের স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
- ব্লাড প্রেসার কমিয়ে দেয়।
- পেট ও শরীর থেকে টক্সিন বের হয়ে যাওয়ার ফলে চামড়ার রোগ কম হয় ও চামড়ার স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
- ওজন কমে। ফাইবার যুক্ত খাবারে ওজন কমার অনেক কারণ আছে।
ক) ফাইবার যুক্ত খাবার খেলে পেট অনেকক্ষণ ভর্তি থাকে, ফলে খিদে কমে।
খ) ফাইবারের ক্যালোরি হজম হয় না, ফলে শরীরে ক্যালোরি কম ঢোকে।
গ) সুগার কমিয়ে দেবার ফলে চিনি খাবার ইচ্ছা কমে, ফলে ক্যালোরি কম খাওয়া হয়।
ঘ) যেহেতু মলের পরিমাণ বাড়ে এবং পেট পরিষ্কার থাকে, এই জন্যে শরীর সব সময় হাল্কা থাকে।
দৈনিক ফাইবারের চাহিদা
আমরা এখন দেখে নেব, আমাদের দৈনিক ফাইবারের চাহিদা কতটাঃ
- ১-৩ বছরের ছেলে ও মেয়েদের দৈনিক চাহিদাঃ ১৯ গ্রাম ফাইবার।
- ৪-৮ বছরের ছেলে ও মেয়েদের দৈনিক চাহিদাঃ ২৫ গ্রাম ফাইবার।
- ৯-১৩ বছরের ছেলেদের দৈনিক চাহিদাঃ ৩১ গ্রাম ফাইবার।
- ১৪-৫০ বছরের পুরুষদের দৈনিক চাহিদাঃ ৩৮ গ্রাম ফাইবার।
- ৫০-৭০ বছরের পুরুষদের দৈনিক চাহিদাঃ ৩০ গ্রাম ফাইবার।
- ৯-১৮ বছরের মেয়েদের দৈনিক চাহিদাঃ ২৬ গ্রাম ফাইবার।
- ১৯-৫০ বছরের মেয়েদের দৈনিক চাহিদাঃ ২৫ গ্রাম ফাইবার।
- ৫০-৭০ বছরের মেয়েদের দৈনিক চাহিদাঃ ২১ গ্রাম ফাইবার।
- এক ডজন ফাইবার যুক্ত খাবারঃ
এবার আমরা জেনে নেব কিছু হাই ফাইবার যুক্ত খাবার এবং ফল-ফলাদির কথা, যার মধ্যে যথেষ্ট পরিমানে ফাইবার থাকে এবং আমাদের খাওয়া উচিত।
- পেয়ারাঃ কাপ বা ১৬৫ গ্রাম পেয়ারায়
- ফাইবার থাকে ৮.৯ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ৩৬%
- এ ছাড়া থাকে প্রোটিন- ৪ গ্রাম, ভিটামিন সি, ভিটামিন-এ, পটাসিয়াম ও কপার।
- নাসপাতিঃ ১ কাপ বা ২২৫ গ্রামে
- ফাইবার থাকে ৭ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ২৮%
- এ ছাড়া থাকে ভিটামিন সি, ভিটামিন-কে, কপার ও ম্যাগনেসিয়াম
- কলাঃ ১ কাপ বা ২০০ গ্রাম কলায়
- ফাইবার থাকে ৫.২ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ২১%
- এ ছাড়া থাকে ভিটামিন বি-৬, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন-বি-৬, প্যান্টোথেনিক এসিড
- মটরসুঁটিঃ ১ কাপ
- ফাইবার থাকে ৮ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ৩০% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে প্রোটিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন-বি১, ভিটামিন-এ, ও ফসফরাস।
- নারকেলঃ ১ কাপ বা ৮০ গ্রাম
- ফাইবার থাকে ৭.২ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ২৮% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে প্রোটিন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, সেলেনিয়াম ও আয়রণ।
- আপেলঃ ১টি মিডিয়াম বা ১৫০ গ্রাম
- ফাইবার থাকে ৪ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ১৮% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে ভিটামিন সি, ভিটামিন-বি১, ভিটামিন -কে, ও পটাসিয়াম।
- ফুলকপি ও বোরোকলিঃ ১ কাপ বা ১০০ গ্রাম
- ফাইবার থাকে ২.৫ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ১২% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে প্রোটিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন-কে, ফলিক এসিড ও ম্যাঙ্গানিজ।
- মাষকলাই বা কাল কলাই ডালঃ ১/২ কাপ বা ৮৬ গ্রাম
- ফাইবার থাকে ৮.৫ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ৩৫% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে প্রোটিন-৬.৬ গ্রাম, থিয়ামিন, ফোলিক এসিড, আয়রণ ও জিঙ্ক।
- ছোলার ডালঃ ১/২ কাপ, সেদ্ধ করা বা ৮৬ গ্রাম
- ফাইবার থাকে ৬.২ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ৩০% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে প্রোটিন-৬ গ্রাম, থিয়ামিন, ফোলিক এসিড, আয়রণ ও ম্যাঙ্গানিজ।
- বিউলির ডাল ১/২ কাপ, সেদ্ধ করা বা ৮৬ গ্রাম
- ফাইবার থাকে ৫.৬ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ৩০% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে প্রোটিন- ৬.৬ গ্রাম, থিয়ামিন, ফোলিক এসিড, আয়রণ ও ম্যাঙ্গানিজ।
- রাঙ্গা আলুঃ ১/২ কাপ, ১০০ গ্রাম সেদ্ধ করা
- ফাইবার থাকে ৩.৩ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ১৩% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে ভিটামিন সি, ভিটামিন-এ ভিটামিন-বি৬, ভিটামিন -কে, ম্যাঙ্গানিজ, নিয়াসিন।
- গাজরঃ
- ফাইবার থাকে ৩.৬ গ্রাম। যা আমাদের দৈনিক চাহিদার ১৬% পুরণ করে
- এ ছাড়া থাকে ভিটামিন সি, ভিটামিন-এ ভিটামিন-বি৬, ভিটামিন –কে ও পটাসিয়াম।
কি ভাবে হাই ফাইবার যুক্ত খাবার খাবেন, তাই নিয়ে কিছু টিপস
- দিন শুরু করুন গোটা দানার খোসা সহ ছোলা, মটর, সয়াবিন দিয়ে।
- ওটস, তার সাথে কলা, আপেল বা অন্য ফল দিয়ে ওটমিল তৈরি করে খান।
- সাদা চালের বদলে বাদামি ঢেকিছাটা চাল খান।
- সাদা আটা বা ময়দার বদলে গোটা গমের আটা খান।
- গোটা ডালের ডাল বা তড়কা খান। তিসি বা তিলে অনেক ফাইবার থাকে, এগুলো রান্নায় রাখার চেষ্টা করুন।
- যথা সম্ভব শাক-শব্জী, পালং, বোরোকলি, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, মুলো, শালগম রান্নায় রাখুন। তার খোসা কম ছাড়াবেন।
- খাবার শেষে ডেজার্ট হিসাবে ফল খান। ফলের মধ্যে আপেল, পেয়ারা, নাসপাতি, কমলালেবু, কলা রাখুন। ফল খোসা সহ খাওয়ার চেষ্টা করুণ।
- স্যালাডে খোসা সহ বাদাম, আমন্ড, মটরসুঁটি, রাখুন।
- বিভিন্ন রকমের ডাল রাখুন রান্নায়। সম্ভব হলে গোটা ডাল খান।
পরিশেষে বলি, আপনার খাদ্য তালিকায় ফাইবার রাখুন, অনেক রোগের হাত থেকে বাঁচুন। শরীর সুস্থ রাখুন।