পাতা ওলটাতে ওলটাতে,অনেক আগে, এক্কেবারে শুরুতে পিছিয়ে যাই।
ডাক্তারি শিক্ষার প্রথমে সবচেয়ে উত্তেজনা থাকে ডিসেকশন নিয়ে। অন্য বিষয় নিয়ে পড়তে যাওয়া বন্ধুরা, আত্মীয় স্বজন সবার একটাই কৌতূহল তখন, দেখা হলেই শুধোয়– মড়া কাটলি? ভয় করে নি?
আমাদের কালে ডিসেকশন হলে এসি-র বালাই ছিল না। দোতলা সমান উঁচু হলে– শুধু ঘুরতে হয় বলেই একটা একজ্হস্ট ফ্যান ঘুরত। সেই পাখা বা ফরমালিনের সবসময় ওই উৎকট গন্ধ চাপা দেবার মোটেই দায় ছিল না।
তখনো তো কেউ আমাদের ডাক্তার মধুসূদন গুপ্তর নাম কাহিনী বলেনি– তাহলে না হয় বাঙালী বলে একটু কলার তুলেই ঢুকতাম। ইনি সেই মানুষ, যিনি সুশ্রুত-র প্রায় তিনহাজার বছর পরে ১৮৩৬ সালে ভারতে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। কল্পনা হার মানে এমন সব সামাজিক বাধা পেরিয়ে। সাহিত্য সংসদের বই– ডাক্তার শঙ্কর নাথ দাদার লেখা ওনার জীবনী পড়ে নেবেন সব্বাই।
পেত্থম দিকে আমাদের দু একজন বন্ধু যে মাথা ঘুরে ভিরমি খেত না তা নয়। এক বন্ধু কাকলী তো দেড়মাস ক্লাস করেই ইংরেজি অনার্স পড়তে চলে গেল। পরে আমাদের ওই গন্ধই হয়ে গেল যেন মেছুনির মাছের ঝুড়ি! ওই ঘরে আর এক রকম ভিরমি খাওয়া হত ৱ্যাগিং এর সময়। কার ঊর্বর মাথা থেকে বেরিয়েছিল কে জানে, প্রথম যে কোথায় শুরু সেটাও অজানা–সব মেডিক্যাল কলেজেই আমাদের সময়ে এটা চালু ছিল। ফ্রেশার্সদের মধ্যে সবচেয়ে ঠ্যাঁটা বা সবচেয়ে স্মার্ট ছেলেকে ৱ্যাগিং-এর এই আইটেমের জন্য নির্বাচিত করা হত। প্রসেকটর বা কারো কাছ থেকে চাবি যোগাড় করা হত। শোনো বাছা –ভালো রেজাল্ট করতে গেলে অনেক রাত পর্যন্ত একা একা ডিসেকশন হলে থাকতে হয় কিন্তু –যাও দেখি এই রসগোল্লার হাঁড়িটা নিয়ে ওখানে। সারি দিয়ে পর পর সব টেবিলে, একটা করে ক্যাডাভার শুয়ে আছে– সবার মুখে একটা করে রসগোল্লা গুঁজে দিয়ে এসো। ভীতু বদনাম হলে কেলেঙ্কারি। চলল ছেলে রণে চলল। সময় মাঝ রাত্তির। দুটো কি তিনটে। চারাদিক নিঝঝুম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দাদাদের হুকুম কোনো আলো জ্বালা যাবেনা, শুধু হাতে একটা টর্চ। কয়েকজনকে রসগোল্লা খাওয়ানো নির্বিঘ্নে সেরে ছেলে যেই পরের টেবিলের দিকে পা বাড়িয়েছে- হঠাৎ পেছনের টেবিল থেকে কে যেন বলে উঠল–“বহত বড়িয়া আর একটা দাও বাবু — ” —অ্যাঁ কে বলল!! ওরে বাবারে–মা রে– হাঁড়ি ছুঁড়ে দে দৌড়!
এতক্ষণ টেবিলে মটকা মেরে পড়ে থাকা, সিনিয়র দাদাও ছুটল তার পেছনে পেছনে।
সেই সব ক্যাডাভার। আমাদের বরাদ্দ হল দশ নম্বর টেবিল। আটজন করে গ্রুপ। একদল লোয়ার লিমব–পা। একদল– হাত। ষোলো জন সতেরো আঠেরো বছরের ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হলে যা হয়– পড়ার সঙ্গে ফাজলামিও চলে সমান তালে। এই একটা ক্লাস রুটিনে রোজ থাকে। নাকে মুখে ভাত গুঁজে আড়াইটের সময় হস্টেল থেকে সাদা বকগুলো বেরোত। অ্যাপ্রনের পকেটে ডিসেকশন বক্স আর কানিংহামের বই। শরীরের ছোট্ট ছোট্ট এক একটা অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানতে হবে–ধীরে ধীরে কেটে ছিঁড়ে। পায়ের তলায় প্রথম একটা লম্বা ইনসিশন– ছুরির ডগা দিয়ে উপরের চামড়া নিঁখুত ভাবে কাটা। আমাদের প্রথম দিনের পাঠ ছিল ওটুকুই। মনে পড়ে–সেই হাঁ করা ফাটা ফাটা মোটা চামড়া। কোনোদিন পায়ে হয়তো জুতো ওঠেনি– ছুরির ফলা বেঁধানোই যাচ্ছে না।
আমাদের দলের সবচেয়ে ফাজিল ছেলে সুতনু বলল–‘আগে জানলে, বেঁচে ছিল যখন একটা জুতো মোজা কিনে দিয়ে আসতাম রে –‘
তক্ষুনি মনটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল। ইনিও একসময়ে শ্বাস নিতেন, চলে ফিরে বেড়াতেন, খিদে পেত, কান্না পেত। পর মুহূর্তেই ডাক্তারি পড়ুয়াদের এ আবেগ ভ্যানিশ হতে বাধ্য– কোথা দিয়ে কোন শিরা উপশিরা কোন ধমনী, কোন পেশি কোন হাড় থেকে জন্মাল আর শেষ হল– কি তাদের গতিপথ –অযুত নিযুত জটিল ধাঁধা মুখস্থ করা আর মিলিয়ে নেওয়া। ধীরে ধীরে ক্যাডাভারকে অবজেক্ট মনে হতে থাকে–শিক্ষার বস্তু।
একদিন আমাদের কোনো বন্ধু না বুঝে, দুষ্টুমি করে এক টেবিলের ক্যাডাভারের মুখে একটা সিগারেট গুঁজে রেখেছিল। সেদিন স্যর ডাঃ হুই ক্লাসে ঢুকেই রাগে ফেটে পড়লেন। হু হ্যাজ ডান ইট? হু ডিসঅনার্ড দ্য ক্যাডাভার? থমথমে মুখে ওটুকুই যথেষ্ট।
ডাক্তারি জীবনে সমস্ত রোগ নির্ণয় ওই ব্যবচ্ছেদের পথ ধরেই।
ক্যাডাভার আমাদের ডাক্তারিপাঠের প্রথম শিক্ষক!