উনিশশো ছিয়াশি বা সাতাশির কথা। বর্ষা প্রায় শেষ, পুজো আসব আসব করছে, লোকে ভাবছে এবার পুজোর বাজার শুরু করবে – এমন সময় হঠাৎ তিনদিনের প্রবল বৃষ্টিতে কলকাতা পুরো অচল হয়ে গেল।
কলকাতায় যাঁরা থাকেন, বা প্রায়ই আসেন, তাঁরা জানবেন যে কয়েক বছর পর পর কলকাতায় এমন একটা তিন দিনের বৃষ্টি হয়, যার ফলে শহরটা অচল হয়ে যায়। উত্তর কলকাতায় বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ, দক্ষিণে ফার্ন রোড অঞ্চলে মানুষ বাড়ি ছেড়ে চলে যান, একতলার অর্ধেক ডুবে যায়, দোতলার লোককে বারান্দা থেকে নৌকো করে উদ্ধার করতে হয়… ইত্যাদি। তিন দিনের পরে আবার লেংচে লেংচে শহর চলতে শুরু করে।
সে বছর জানা গেল বৃষ্টির ফলে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রবল বন্যা হয়েছে।
তখন বামপন্থী জমানার পূর্ণিমার চাঁদ। আমাদের কলেজের এস-এফ-আই সদস্যরা ভীষণ ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। রোজই শুনি এ গিয়েছে রাইটার্সে, নয়ত গিয়েছে ও। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেতাম, “কাজ আছে।”
তারপরে জানতে পারলাম তারা রাইটার্স গিয়ে গিয়ে রস্টার বানিয়েছে – বন্যাত্রাণে কোন ডাক্তার কবে কবে যাবে। ক্রমে সেই রস্টার অনুযায়ী সারি দিয়ে অর্ডার আসতে শুরু করল। প্রত্যেকটা অর্ডারের বয়ান একই। টাইপ করা এক পাতা জুড়ে দুষ্পাঠ্য, দুর্বোধ্য মধ্যযুগীয় ইংরিজিতে লেখা, এই অর্ডারে যে যে ডাক্তারের নাম আছে, তাদের সকলকে যেতে হবে বন্যাত্রাণে। তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মুখ্য হাসপাতাল, টালিগঞ্জের বাঙ্গুর হাসপাতালে গিয়ে রিপোর্ট করুন, পরবর্তী আদেশ পাবেন সেখান থেকেই। এই আদেশনামার ওপরে ডানদিকে একটা চৌকোনা বাক্স, তাতে চারজন ডাক্তারের নাম লেখা। টাইপ করেই।
অর্ডারে যাদের নাম লেখা তারা বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে রওয়ানা দিত কোনও অজানার উদ্দেশ্যে। আমরা বাকিরা ভাবতাম বাপরে! কীই না দেশোদ্ধারে চলেছে।
একদিন তপাই ক্যান্টিনে বসে বলল, “দাড়ি, লক্ষ করেছিস, বন্যাত্রাণে যারা যাচ্ছে তারা সবাই হাউজ-স্টাফ – অর্থাৎ আমাদের মতো লেভেলের লোকেরা? জুনিয়র টিচার, প্রফেসর – এদের কারওর নাম কিন্তু নেই।”
খেয়াল করলাম, তাই তো! বললাম, “তা বটে।”
তপাই বলল, “আরও খেয়াল করেছিস, যে যারা যাচ্ছে তারা সবাই কেবল এস-এফ-আই? ছাত্র পরিষদ, ডি-এস-এ, এদের কোনও মেম্বার, বা তোর-আমার মতো নিউট্রাল কেউ যাচ্ছে না?”
তা-ও তো ভেবে দেখিনি। বললাম, “ওই যে, অঙ্কণ যাচ্ছে, ডাক, জিজ্ঞেস করি।”
অঙ্কণ তখন এতই ব্যস্ত যে আমাদের দিকে তাকানোরই সময় নেই। তবু, তপাইয়ের সুমিষ্ট সম্বোধনাবলী – যার শুরু, ‘এই যে শালা, শুওরের বাচ্চা,’ দিয়ে – ইগনোর না করতে পেরে এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। বসার উপায় নেই। রাইটার্স, তথা পশ্চিমবঙ্গের তামাম ভবিষ্যৎ ওর কাঁধের ওপর চাপানো।
তপাই তাই ভনিতা না করে মূল প্রশ্নটাই করল। “হারামজাদা, বন্যাত্রাণে শুধু এস-এফ-আই-এর মেম্বাররা যাবে? আর অন্য পার্টির মেম্বাররা কি বানের জলে ভেসে এসেছে?”
অঙ্কণ ধপ করে বসে পড়ে বলল, “ছাত্র পরিষদের মেম্বাররা আমি বললে যাবে?”
তপাই বলল, “তুই বলবার কে রে? তুই কি স্বাস্থ্যমন্ত্রী?”
অঙ্কণ বলল, “মেডিক্যাল কলেজ থেকে ভলান্টিয়ার সিলেক্ট করার দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ভলান্টিয়ার সিলেক্ট করে কী করে?”
বামপন্থায় অভ্যস্ত অঙ্কণ মিক্সড মেটাফরটা বুঝল না, কিংবা না বোঝার ভান করে বলল, “আমার তাড়া আছে। তোদের কি কাজের কথা কিছু আছে?”
তপাই বলল, “ভলান্টিয়ার চাই – এই কথাটা তোর সরকার বা পার্টি যদি অ্যানাউন্স না করে, লোকে ভলান্টিয়ার করবে কী করে?”
অঙ্কণ বলল, “দরকার নেই ছাত্র-পরিষদ বা ডি-এস-এ-র ভলান্টিয়ার। আমাদের যথেষ্ট লোক আছে।”
ততক্ষণে আমার আর তপাইয়ের চা এসে গেছে। অঙ্কণ আর থাকতে পারল না। নিজেও এক কাপ চা চাইল। তারপরে বলতে শুরু করল, কেমন বন্যায় সুন্দরবন অঞ্চলের গ্রামকে গ্রাম ভেসে গেছে। লোকে না খেতে পেয়ে, আন্ত্রিকের প্রকোপে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় হাজার হাজার ডাক্তার পাঠানো উচিত গ্রামে গ্রামে – কিন্তু আমাদের ডাক্তারদের এমনই দুরবস্থা, যে আমরা কেউ যেতেই চাই না।
তপাই বলল, “এই যে খুব বড়ো মুখ করে বলছিলি, তোদের ছেলেরাই যথেষ্ট – আর কাউকে লাগবে না?”
বিপাকে পড়ে অঙ্কণ বলল, “বাজে না-বকে বল, তোরা যাবি কি না। তাহলে আজ গিয়ে তোদের নাম দিই?”
তপাই বলল, “আলবাত দিবি। সব কিছু নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখবি নাকি – বদমাশ কোথাকার!”
“বেশ,” বলে অঙ্কণ উঠতে যাবে, আমি বললাম, “তিনদিনের বৃষ্টিতে কত জল হয়েছে, যে গ্রামকে গ্রাম ভেসে গেছে? এ বছর তো নদী উপচে বন্যা কোথাও হয়ইনি।”
অঙ্কণ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “অত জানি না। সাংঘাতিক বন্যা হয়েছে, লোকে মারা যাচ্ছে এই খবর। এ ছাড়া আর কিছুই জানি না। যাবি তো বল, নাম দিই।”
বললাম, “দে। যাব।”
*
পরদিন আমরা যে যার ডিপার্টমেন্টে জানিয়েছি যে আমরা বন্যাত্রাণে যাব। সরকার ডেকেছে। কাজে না গিয়ে ক্যান্টিনে বসে আছি সকাল থেকে, অঙ্কণের দেখা নেই। সকাল যায়, দুপুর যায়, প্রায় বিকেলবেলা, আমরা যখন প্রায় হতাশ হয়ে বাড়ি যাব, এমন সময় অঙ্কণ এল হন্তদন্ত হয়ে।
“শোন, ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে আপাতত সরকারিভাবে আর ভলান্টিয়ার দরকার নেই। সুতরাং লাস্ট যে ভলান্টিয়ারের দল যাবে, তাতে আমি যাব, কিন্তু তাতে তোদের নেওয়া হবে কি না বলতে পারছি না।”
“লে হালুয়া! এই নাকি তুই পচ্চিম্বঙ্গের হেলথ-এর দায়িত্ব নিয়েছিস? এই তুই নেতা?”
তপাইয়ের প্যাঁকের উত্তরে অঙ্কণের কলার তোলা আমি কী-না-কী ভাবটা মিইয়ে গেল। বলল, “দাঁড়া, সবই কি আমি করি নাকি?”
আমরা খুব অবাক হবার ভান করে বললাম, “সে কী! তুই করিস না? তাহলে এতবড়ো স্বাস্থ্যব্যবস্থা চলছে কী করে? এই যে হাসপাতাল, টাসপাতাল…”
খুব রেগে অঙ্কণ বলল, “দাঁড়া দেখাচ্ছি তোদের আমি কী করতে পারি-না-পারি!”
পরদিন আবার পুনর্মুষিক হয়ে গিয়ে কাজে ফিরেছি। বলেছি, “এখনও একটা লট বাকি আছে। তাতে আমাদের পাঠান হলেও হতে পারে।”
কিন্তু বেশিক্ষণ লাগল না, অঙ্কণ এসে হাজির। আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই নে। আমাদের ছ’জনের টিম। আমরা ক্যানটিন থেকে ৩টের সময় বেরোব। তার মধ্যে জামাকাপড় নিয়ে ফিরে আয়।”
কাগজ হাতে নিয়ে দেখি তাতে অন্য কাগজের মতো চারজনের নাম নেই। ছ’জনের নাম। অঙ্কণ সহ এস-এফ-আই-এর দিগ্গজ কিছু মেম্বার, আর তপাই, আর আমি। তবে তাজ্জবের বিষয় এই, যে তপাই আর আমার নাম কালির কলমে হাত দিয়ে লেখা। টাইপ করা নয়।
বললাম, “হাতে লেখা কেন?”
অঙ্কণের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাব-ভাবটা ফিরে এসেছে। বলল, “ওটা আলাদা করে ঢোকাতে হয়েছে বলে। এই দেখ, নামের পাশে ডিরেকটর অফ হেলথ সার্ভিসের ইনিশিয়াল আছে।”
দেখলাম। তারপরে আমার ডিপার্টমেন্ট হেড, ডাঃ পি কে বসুর কাছে গিয়ে কাগজ দিয়ে বললাম, “এই অর্ডারটা এসেছে। বাড়ি যাব, বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে আসতে হবে। দু’সপ্তাহর জন্য যাওয়া।”
প্রফেসর বসু মন দিয়ে অর্ডারটা দেখে বললেন, “তোমার নাম ডি-এইচ-এস নিজে হাতে লিখেছেন কেন?”
অন্যান্য ডাক্তাররা ঝুঁকে পড়লেন। তখন ডি-এইচ-এস ছিলেন ডাঃ কালীকিঙ্কর ভট্টাচার্য। খুব সম্মানিত সিনিয়র। আমার মাস্টারমশাইরাও ‘কালীদা’ বলে ডাকতেন। অবাক হয়ে সবাই মানলেন, ঠিক, অর্ডারে আমাদের নাম, সে নাম-লেখার কলম, কলমের কালি – সবই কালীদার সইয়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। যাঁরা কালীদাকে চিনতেন, তাঁরা বললেন, এ কালীদারই লেখা।
কেন তিনি আমার আর তপাইয়ের নাম হাতে লিখেছেন, সে কথা বলে দেবার লোকটা তখন সেখানে নেই। বাড়ি চলে গেছে। জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। আমিও চললাম, বাড়ি থেকে জামা কাপড় আনতে।
নির্দিষ্ট সময়ে ক্যানটিনে দেখা হতে বুঝলাম এস-এফ-আই-এর অন্য যে তিনজন মেম্বারের নাম আদতে টাইপ করা ছিল, তারা আমার আর তপাইয়ের অন্তর্ভুক্তিতে খুব আনন্দ পায়নি। তাতে আমাদের এমনিতে বয়ে যেত, তবে আগামি দু’সপ্তাহ তিনটে তেতো-মুখের সঙ্গে কাটাতে হবে সেটাতে আমাদের অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা, যবনের হাতে একরকম সাধ করেই নিজেদের সঁপে দিয়েছি। অঙ্কণের নির্দেশে অ্যাকাউন্টস সেকশনে গিয়ে টাকা তুললাম। টি-এ, ডি-এ মিলিয়ে দু’সপ্তাহের টাকা দেখে চোখ কপালে। এত হাজার টাকা! তপাই বলল, “এ তো আমাদের প্রায় চারমাসের মাইনে রে!” বলা বাহুল্য তখন আমরা হাউস জব করে কয়েকশো টাকা মাত্র উপার্জন করতাম।
পৌঁছলাম সদলবলে বাঙ্গুর হাসপাতাল। সেখানে যা করার অঙ্কণরাই করল। আমরা এদিক ওদিক দেখলাম মাত্র। একটু বাদে অঙ্কণ এসে বলল, “আমাদের একসঙ্গে যাওয়া হবে না। আমরা এখন যাব ডায়ামন্ড হারবার। সেখান থেকে কাকদ্বীপ। কাকদ্বীপ থেকে আমরা আলাদা হয়ে যাব। তুই আর তপাই যাবি পাথরপ্রতিমা।”
এ ব্যবস্থা কি অঙ্কণের রাজনৈতিক বন্ধুরা করেছে? অবশ্য করে থাকলে আমাদের আপত্তি নেই। এক একটা টিম নাকি দুজনের হবে। আমি আর তপাই দুজনেই তো আর অঙ্কণের সঙ্গে যেতে পারব না। আমাদের একজন অঙ্কণের সঙ্গে গেলে অন্যজনকে এমন কারওর সঙ্গে যেতে হবে যে আমাদের অনাহূত বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী মনে করছে। তারচে’ এ-ই ভালো।
বসতে হবে। ওষুধপত্রের প্যাকেজ তৈরি হচ্ছে। আজকের দিনটা আমাদের পক্ষে ভালো। সরকারি তহবিলের মাইনের টাকা নিয়ে ডায়মন্ড হারবার যাবে একটা সরকারি অ্যাম্বুলেনস। আমরা তাতেই যেতে পারব।
বসে আছি, বসেই আছি। ক্রমে ওষুধের তল্পি এল। দেখে চোখ চড়কগাছ। তল্পিই বটে। ট্যাবলেট, নানা ইঞ্জেকশন, ড্রিপবোতল আর ড্রিপ চালাবার সরঞ্জাম সব একটা বিছানার চাদরে মোড়া। ঘাড়ে করে নিতে হবে। তিনটে দলের জন্য তিনটে আলাদা চাদর।
একজন ক্লার্ক বলল, “সবকটা টিমে চারজনের নাম – এই অর্ডারে ছ’জনের। ফলে আমাদের হিসেবে একটু গণ্ডগোল হয়েছে।”
ক্লার্করা এমন কথা বলেই থাকে। আমরা পাত্তা দিলাম না। এর পরের অপেক্ষা অ্যাম্বুলেনসের জন্য।
একফাঁকে অঙ্কণকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাদের নাম হাতে লেখা কেন রে? কে লিখেছে?”
অঙ্কণ বলল, “আরে, অর্ডার বেরোন’র পরে দেখলাম তোদের নাম নেই। আমার লিস্টে তোরা তো লাস্ট ছিলি – তাই। ক্লার্ক বলল, শুধু দুজনের জন্য আর একটা অর্ডার বের করবে না। আরও দুজনের নাম চাই। আমার আর নাম নেই। তাই কালীদাকে গিয়ে বললাম, কালীদা বলল, তাতে কী হয়েছে, বলে তোদের নাম হাতে লিখে দিল।”
ওরে বাবা! এত ক্যালি অঙ্কণের! কার সঙ্গে চলেছি!
তখনও জানি না, নামদুটো হাতে লেখা বলে আরও কী কী হতে চলেছে।
খানিক বাদে আমাদের ডেকে নিয়ে অ্যাম্বুলেনসে তুলে যাত্রা শুরু হল। পায়ের কাছে মস্তো ট্রাঙ্ক। তাতে নাকি নোট ঠাসা। সঙ্গে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ। ডায়মন্ড হারবার পৌঁছে ওখানকার হেলথ সেন্টারে যাওয়ামাত্র তারা বলল, “আরে, আপনারা এবারে টাকার সঙ্গে কাকদ্বীপ চলে যান। কারণ এই টাকা নিয়ে কাকদ্বীপ যাবে আমাদের লঞ্চ। ওরাই আপনাদের কাকদ্বীপ নিয়ে যাবে।”
হেলথ ডিপার্টমেন্টের লঞ্চে উঠে জানলাম ওরা কাকদ্বীপে টাকা নামিয়ে বাকি টাকা চলে নিয়ে যাবে পাথরপ্রতিমা। ফলে আমরা দু’জন, তপাই আর আমি – ওতেই চলে যাব। অঙ্কণরা অবশ্য কাকদ্বীপ থেকে অন্য কোথাও যাবে।
ডায়মন্ড হারবার থেকে উঠেছিল শঙ্কর। পাথরপ্রতিমার হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট। উৎসাহী ছেলে। বলল, “স্যার, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। পাথর পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। ওখানেই হেলথ সেন্টারে থাকবেন। কাল ভোরে আবার এই লঞ্চেই যাব। আপনারা কোথায় যাবেন আমি জানি। পাথর প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের এলাকায় একটা জায়গাতেই বন্যা হয়েছে খবর পেয়েছি। খুব বন্যা।
সারাদিন ধরে চলতে চলতে, কাকদ্বীপে থেমে চা খেয়ে অঙ্কণদের টা-টা বলে আবার চলে শেষ পর্যন্ত যখন পাথরপ্রতিমা পৌঁছলাম, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। অন্ধকারে শঙ্করের টর্চে পথ দেখে আমরা গেলাম প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে। ব্লক মেডিকাল অফিসার অফ হেলথ – সংক্ষেপে বি-এম-ও-এইচ – কোয়ার্টারে ছিলেন, শঙ্কর ডেকে-ডুকে বের করল। অসময়ে অফিস যেতে হল বলে ভদ্রলোককে খুশি দেখাল না। অফিসে গিয়ে ক্লার্ককে দিয়ে আমাদের পোস্টিং অর্ডার টাইপ করালেন। কোন সাবসিডিয়ারি হেলথ সেন্টারের এলাকাভুক্ত কোন কোন গ্রামে যেতে হবে, তা লেখা।
তারপরে সই করে দিলেন। আমাদের বললেন, “আপনারা কাল সকালে রওয়ানা দেবেন, সকাল পাঁচটায় লঞ্চ ছাড়বে। অনেকটা যাওয়া।”
সুন্দরবন অঞ্চলে যাতায়াতের সময় নির্ধারিত হয় জোয়ার ভাঁটার ওপর। সেটা জানতাম। কিন্তু সকাল পাঁচটা-টা আমাদের সমস্যা নয়।
বললাম, “আমাদের রাতে থাকার কোনও উপায়… লঞ্চে থাকা যাবে কি?”
না। লঞ্চে থাকার নিয়ম নেই। তবে?
বি-এম-ও-এইচ বললেন, “আমি আমার বাড়িতে থাকতে বলতে পারতাম, কিন্তু আমার ফ্যামিলি নেই। আমি আজ একাই আছি, তাই…”
তপাই একটু হেঁহেঁ হেসে বলল, “তাছাড়া রাতে কিছু খেতেও হবে…”
বি-এম-ও-এইচ আর ক্লার্ক ছাড়াও সেখানে একজন চোয়াড়ে চেহারার লোক বসেছিলেন। তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই বলে, যে তিনি সুরজ সিং, হেলথ সেন্টারের সোশ্যাল ওয়ার্কার। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে বি-এম-ও-এইচকে, “স্যর, একঠু বাহার আসবেন?” বলে বেরিয়ে গেলেন, বি-এম-ও-এইচও উঠে বাইরে গেলেন, দুজনে নিচু গলায় কী আলোচনা হল, বি-এম-ও-এইচ নিশ্চিন্ত মুখে ফিরে এসে বললেন, “সিংজী ভালো আইডিয়া দিয়েছেন। আমি ওয়ার্ড বি খুলে দিচ্ছি। ওখানে আজ কোনও পেশেন্ট টেশেন্ট নেই। কাচা চাদর, বালিশের ওয়াড় দিয়ে দেবে।”
তপাই মিনমিন করে বলল, “আর খাবার কিছু ব্যবস্থা…”
সিংজী খুব কড়া গলায় বললেন, “খানা কুছ মিলবে না।”
আমি বললাম, “কোনও দোকান টোকান… যা হোক, বিস্কুট টিস্কুট হলেও চলবে।”
দুজনেই মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের অফিসে বোকার মতো বসে রইলাম।
তপাই বাইরে উঁকি মেরে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। ভীষণ রেগে বলল, “ব্যাপারটা কী বল তো? ব্যাটা কি পর্দানশীন মেয়েছেলে নাকি? যে ওর বাড়িতে আমরা থাকতে পারব না? বাড়িতে কেউ না থাকলে আমাদের ও-বাড়িতে রাখতে ওর কী অসুবিধে হত?”
আমি বললাম, “ধ্যাৎ, ও সব নিয়ে ভাবিস না। শোবার জায়গা পেয়েছি, পেটে যদিও ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে, রাতে জল খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারব আশা করি। বন্যাত্রাণে এসেছি, কিছু কষ্ট তো করতেই হবে… তবু তো সিং বোধহয় বলল তাই…”
তপাই আরও তেলেবেগুনে জ্বলে বলল, “ওয়ার্ডে শুতে দিচ্ছে তাতে কি মাথা কিনে নিচ্ছে? আমরা ভলান্টিয়ার করে বন্যাত্রাণে আসিনি? ওই সিং-টাও কেমন দেখতে শুনতে। বদের ধাড়ি নিশ্চয়ই।”
রাত্তির হয়ছে। সিং-এর বদামি নিয়ে আলোচনায় সময় ব্যয় করার মতো খাবার পেটে নেই – বরং ভর্তি ছুঁচো – বাইরে গিয়ে দেখলাম ওই দূরে সিং আর ডাক্তারবাবু কিছু একটা আলোচনা করতে করতে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারের দিকে চলে গেলেন। এবার?
আমাদের আর কিছু করার নেই। কেউ কোত্থাও নেই যে জিজ্ঞেস করব কী হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অফিস ঘরে বসে রয়েছি আর মাঝেমাঝে পায়চারি করছি, হঠাৎ ছুটে এল শঙ্কর। উত্তেজিতভাবে হাত-পা নেড়ে বলল, “আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। আজ রাতে আমার বাড়িতে থাকবেন।”
রাত অনেক হয়েছে। গ্রাম কেন, শহরের পক্ষেও অনেক রাত। চারিদিক শুনশান। বললাম, “কিন্তু ডাক্তারবাবু যে আমাদের বললেন ওয়ার্ডে পেশেন্ট নেই…”
“আরে রাখুন তো!” উত্তেজনায় শঙ্করের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। “আপনাদের কোন ওয়ার্ডে রাখছিল জানেন? ওয়ার্ড বি।”
আমরা বললাম, “তাই তো বললেন। বললেন পেশেন্ট নেই…”
শঙ্কর বলল, “পেশেন্ট তো নেই। কিন্তু ওয়ার্ডটা টিবি ওয়ার্ড। ওপেন টিবি কেস রাখা হয়। ফিউমিগেট পর্যন্ত করা নেই। ওখানে আপনাদের রাখার বুদ্ধি ওই সিংজীর। মহা বজ্জাত লোক।”
ততক্ষণে আমরা হেলথ সেন্টারের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এসেছি।
জানতে চাইলাম, “সিংজী কে?”
শঙ্কর হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “সরকারি সোশ্যাল ওয়ার্কার। খুব বাজে লোক। ও নাকি উত্তরপ্রদেশে থাকত। ওর নামে নাকি দু-চারটে মার্ডার কেস ঝুলছে। তাই এখানে পালিয়ে এসেছে।”
আমরা তাজ্জব। এমনও হয় নাকি? তখন আমাদের বয়স কম। তাই কী হয় আর হয় না সে নিয়ে আমাদের আইডিয়া কম ছিল।
রাস্তার ধারে একটা বন্ধ কুঁড়েঘর দেখিয়ে শঙ্কর বলল, “এটা উদ্ধবের খাবার দোকান। তবে উদ্ধব ঘুমিয়ে পড়েছে। নইলে এখান থেকে আপনাদের খাইয়ে নিয়ে যেতাম। যা হোক, আপনারা আমার বাড়িতে খাবেন। গরিবের বাড়ি – বেশি কিছু দিতে পারব না…”
হাতে চাঁদ পেলাম।
শঙ্কর বাড়ি পৌঁছে হাঁকডাক করে লোকজনকে ঘুম থেকে তুলল, বাইরে দাওয়ায় একটা খাটিয়াতে মশারি টাঙিয়ে তিন-চারজন বাচ্চা ঘুমোচ্ছিল, তাদের টেনে তুলে, “যা, যা, ভেতরে গিয়ে ঘুমো…” বলে আমাদের বলল, “আপনারা এখানে বসুন।”
আমরা আপত্তি করে বললাম, “বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে কোথায় পাঠালে?”
শঙ্কর বলল, “ওদের শোবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাদের আর কোথায় শোয়াব? বসুন, বসুন… আমি দেখি খাবার ব্যবস্থা করি।”
আমরা বসে রইলাম, শঙ্কর চলে গেল। বেশ খানিকক্ষণ বাদে ফিরে এল – সঙ্গে একটা মস্তো গামলা ভর্তি মুড়ি। বলল, “রান্না করা খাবার আর কিছু বাকি নেই। মা তাই মুড়ি নারকোল দিল। খুব অসুবিধে হবে…”
আমরা আর কথা বাড়ালাম না। অদৃশ্য মা-কে মনে মনে নমস্কার করে হামলে পড়লাম।
**
পরদিন ভোর না হতে শঙ্কর আমাদের তুলে দিল। জোয়ার থাকতে থাকতে লঞ্চ ছাড়তে হবে। মুখেচোখে জল দিয়ে রওয়ানা হলাম। শঙ্কর সঙ্গে যাবে। লঞ্চ প্রায় সারাদিন চলে দুপুরের পরে পৌঁছবে একটা সাবসিডিয়ারি হেলথ সেন্টারে। সেখানে আজ আমাদের রাত্রিযাপন। শঙ্কর অবশ্য থাকবে না সঙ্গে। ও সোজা চলে যাবে বন্যাকবলিত গ্রামে। সে গ্রামের হেলথ ওয়ার্কার প্রদীপকে সঙ্গে নিয়ে আসবে – কাল সকালে আমরা প্রদীপের সঙ্গে ওর গ্রামে যাব। শুরু হবে বন্যাত্রাণ। ত্রাণ যে এত সময়সাপেক্ষ, কে জানত!
শঙ্করের বাড়ির কারওর সঙ্গে পরিচয় হল না। রাতে থাকতে দেওয়া, খেতে দেওয়ার জন্য কোনও আর্থিক সাহায্য নিতে রাজি হল না ও। আমরাও গৃহস্থর আতিথেয়তাকে সম্মান করে আর কথা বাড়ালাম না।
দুপুরের পরে এসে পড়লাম গন্তব্যে। জেটি থেকে একটুখানি গিয়েই হেলথ সেন্টার। সাবসিডিয়ারি হেলথ সেন্টারটার নাম মনে নেই, কিন্তু অত নয়নাভিরাম দৃশ্য আমরা দেখিনি কখনও। ঢলে পড়া রোদের আলোয় লাল বাড়িটা ঝকঝক করছে। দরজা জানলা সব বন্ধ। বাড়িটা যেন ঘুমিয়ে আছে। সামনে একটা বিশাল পুকুর। প্রায় সরোবর। আমাদের আসার শব্দে হেলথ সেন্টারের পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ওখানকার ফার্মাসিস্ট। হেলথ সেন্টারের ওপাশের কোয়ার্টার থেকে এলেন নার্স। তপাই ফিসফিস করে বলল, “আশাকরি ডাক্তারটা ওইরকম অভদ্র হবে না।”
নাঃ, এই হেলথ সেন্টারে ডাক্তার নেই। কারও পোস্টিং-ই হয়নি বহু বছর। ফার্মাসিস্ট বললেন, “আমিই ডিসপেনসারি চালাই – সকাল সন্ধে আউটডোর চলে। ওষুধ-টশুধ দিই। পাঁচটা বেড আছে। ডাক্তারের অভাবে সে বন্ধ। সিস্টার আছেন, তবে কাজ তো নেই। আউটডোরেই ইঞ্জেকশন-টিঞ্জেকশন দেন…”
মাইনে দিয়ে অ্যাকাউন্টস-এর লোকেরা চলে গেলেন, শঙ্কর তো আগেই রওয়ানা দিয়েছিল বন্যা-কবলিত গ্রামের দিকে। আমরা একা হয়ে গেলাম। নিজের এক-কামরার কোয়ার্টারের দরজা আমাদের জন্য খুলে দিয়ে ফার্মাসিস্ট বললেন, “আমি চা বানাচ্ছি।”
এমনই ছোট্টো একটা রান্নাঘর, যে সেখানে কাজ করতে গেলে এক পা শোবার ঘরে রাখতে হয়। আমরা দুজন চা খেয়ে, বিশ্রাম করে, বিকেলে পায়চারি করলাম হেলথ সেন্টারের চত্বরে। তারপরে পুকুরপাড়ে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা হল। কী কথা হয়েছিল মনে নেই, কিন্তু ওই পুকুরপাড়, হেলথ সেন্টারের বাড়িটা, জলের ধারে নুয়ে পড়া কৃষ্ণচূড়া গাছটা – শরতের নীল আকাশে সূর্যের আলো ফুরিয়ে এসে মলিন ধূসর হয়ে যাওয়া – সবটাই এখনও মাঝে মাঝে স্পষ্ট যেন দেখতে পাই।
অন্ধকার হয়ে গেল। ফার্মাসিস্টের বাড়িতে ইলেক্ট্রিক ডুম-টা মিটমিটে। তাতেই আড্ডা চলল দুজনের। মাঝে একবার ফার্মাসিস্ট এসে রাতের খাবার দিয়ে চলে গেলেন। বললেন, “সিস্টার বানিয়েছেন।”
খেয়েদেয়ে অপেক্ষা করছি, রাত বাড়ছে, ফার্মাসিস্টের দেখা নেই। তপাই বলল, “দাড়ি, ঘুমোবি না?”
বললাম, “আরে, কোথায় ঘুমোব? ফার্মসিস্ট আসুক!”
তপাই হেসে বিছানাটা দেখিয়ে বলল, “ও আসবে না। চল এখানেই ঘুমোব দুজনে।”
আমি বললাম, “এটা ওর বিছানা। এখানে আমরা ঘুমিয়ে পড়লে চলবে?”
তপাই বলল, “দাড়ি, তুই বড্ডো ছেলেমানুষ। এটা ওর বিছানা হতে পারে। কিন্তু এটাতে ও ঘুমোবে না। ও আছে ওই নার্সের বাড়িতে। বলল না – সিস্টার। হয়ত রোজই থাকে।”
ওরে বাবা! আমি সত্যিই অতশত ভাবিনি। শোবার জোগাড় করলাম।
[তখন ভাবিনি, পরেও না। কিন্তু এখন লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে পাথরপ্রতিমায় ডাক্তারবাবু নিজের ফ্যামিলি না থাকা সত্ত্বেও কেন আমাদের বাড়িতে ডাকলেন না? তাহলে কি সেখানেও…]
শুয়ে ঘুমিয়েছি কী ঘুমোইনি। তপাইয়ের ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙল। “এই শালা দাড়ি, মহালয়া কেন চালিয়েছিস?”
ঘুম ভেঙে শুনি মহালয়ার সুর। আজ মহালয়া? খেয়ালই ছিল না! কিন্তু এত জোরে মহালয়া বাজে কেন? খাটের পাশে টেবিলে তো ফার্মাসিস্ট-এর ট্রানজিস্টর মৌনই রয়েছে। ক্রমে বুঝলাম বাইরে গ্রামের লোকেরা লাউডস্পিকারে মহালয়া বাজাচ্ছে।
বাকি রাতটা কাটল আধো ঘুমে। সকালে চা জলখাবার নিয়ে এলেন ফার্মাসিস্ট (সিস্টার বানিয়েছেন)। তারও খানিক পরে এসে পৌঁছল শঙ্কর আর প্রদীপ। প্রদীপ বন্যাকবলিত গ্রামের হেলথ ওয়ার্কার। শঙ্কর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল পাথরপ্রতিমা, আর প্রদীপ আমাদের নিয়ে চলল তার গ্রামে।
*
উঁচু রাস্তায় ভ্যান-রিক্স থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম দু-দিকে আর জমি নেই। জলই জল। চতুর্দিকে শুধু জল, তাতে মাঝে মাঝে একটা দুটো কুঁড়েঘরের মাথা।
প্রদীপ বলল, “ওগুলো গ্রাম নয়। ক্ষেত পাহারা দেবার ছাউনি। এবারের ধান সবই জলের নিচে। কাটার সময় তো হয়েই এসেছিল। আমাদের গ্রামে তবু বেশ কিছু বাড়ি ডোবেনি। আমার বাড়ি যেমন। তবে খবর পেয়েছি যে আশেপাশের সব গ্রাম জলের নিচে। আমাদের গ্রামে না, তবে খবর আছে যে অন্যান্য গ্রামে আন্ত্রিক দেখা দিয়েছে। আপনারা সময়মতো এসেছেন। আসুন…”
ভ্যান থেমেছে। রাস্তার বাঁদিকে কিছু লোকজন বুক জলে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে চেয়ে। প্রদীপের হাতে একটা লম্বা লাঠি, তাতে ভর দিয়ে সে নেমে গেল। বুক সমান জলে পৌঁছে পেছন ফিরে বলল, “ব্যস, এই ম্যাক্সিমাম জল। চলে আসুন।”
আমরা আসছিলামই। দেখতে দেখতে পৌঁছলাম প্রদীপের লেভেলে। প্রদীপের চেয়ে আমি সামান্য লম্বা। জল আমার বুকের নিচে। তপাই আমার চেয়েও খানিকটা লম্বা। ওর কোমরের ওপর অবধি জল। ওষুধের বাণ্ডিল তপাইয়ের কাঁধে। খানিকটা গিয়ে ফিরে তাকাল প্রদীপ। বলল, “এখানটা সাবধানে আসবেন। দুদিকে পুকুর আছে।”
দিগন্তবিস্তৃত জলের মধ্যে কোথায় পুকুর, কী করে বুঝব? আমরা দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম, “তপাই, আমি সাঁতার জানি না।”
তপাই বলল, “জানলেও এই অকুল পাথারে করতি কী?”
প্রদীপকে বললাম, “কোনখানে পুকুর বুঝব কী করে?”
প্রদীপ লাঠি উঁচিয়ে ডাইনে বাঁয়ে দেখিয়ে বলল, “ওই যে খেজুরগাছ দুটো, তার ঠিক মাঝ বরাবর আসুন।”
আমরা অবাক। খেজুরগাছ দুটোর মধ্যে অন্তত পঁচিশ ফুটের ব্যবধান। তাহলে এত সাবধানতা কেন? আমাদের অনভিজ্ঞ বোকামি দেখে প্রদীপ হাঁ-হাঁ করে উঠল। “না না, গাছদুটোর গোড়ার দিক কিন্তু শোয়া। দুটো পুকুরের ধার থেকে উঠেছে। খানিকটা গিয়ে তবে খাড়া হয়েছে। দুটো পুকুরের মাঝখানে এই এতোটার বেশি জায়গা নেই।”
হাত দিয়ে ফুট দুয়েক তিনেকের চওড়া বোঝাল প্রদীপ। আমরা স্থাণুবৎ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
“তুমি এসো, এসে আমাদের নিয়ে যাও।” তপাইয়ের ডাকাডাকিতে প্রদীপ এগিয়ে এসে ওর লাঠি বাগিয়ে দিল। তপাই ওর ওষুদের বাণ্ডিল আমার কাছে দিয়ে এক হাতে লাঠি ধরল। অন্য হাত ধরলাম আমি। এইভাবে পায়ে পায়ে পেরিয়ে গেলাম সলিল সমাধি।
জল পেরিয়ে তপাই বলল, “প্রদীপ, লাঠিটা আমাকে দেবে?” প্রদীপের খুব ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ডাক্তারবাবু চাইছেন… অগত্যা।
*
দিনচর্যার বিবরণ দেবার দরকার নেই। মনে-ও নেই অত, খুব ইন্টারেস্টিং-ও হবে না। প্রদীপের বাড়িতে ঠাঁই হয়েছিল। শঙ্করের বাড়ির মতোই বাইরের ঘরের কেউ তাঁদের নিজেদের বিছানা আমাদের দিয়ে তিন দিন কোথায় শুয়েছিলেন আমরা জানি না। সেই তিন দিন আমরা তিন জন সকাল থেকে সন্ধে অবধি আল ধরে ধরে কোমর থেকে বুক সমান জল ঠেলে ঠেলে ঘুরে বেড়ালাম গ্রামে গ্রামে। কোত্থাও কোনও বন্যাজনিত অসুখ নেই। আন্ত্রিক নেই, জ্বর নেই, এমনকি পেটখারাপ পর্যন্ত পেলাম না একটা।
যেটা পেলাম সেটা আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর। মাইলের পর মাইল যে জল পেরিয়ে পেরিয়ে আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরলাম – সেটা মোটেই বন্যার নয়, বৃষ্টির জল। সুন্দরবন অঞ্চলের নদীর জল নোনা। ফলে সেখানে চাষ হয় না। মানুষ বাঁধ দিয়ে নদীর পাড় উঁচু করেছে, যাতে জোয়ারের জল না আসে। ভেতরে যে জমি তাতে ধানচাষ হয়। কানা উঁচু বাটির মতো এই জমিতে তিন চার দিনের প্রবল বৃষ্টির জলই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমি খানিক ভেবে বলেছিলাম, “তার মানে বাঁধ কেটে দিলেই জল বেরিয়ে বন্যা শেষ হবে?”
প্রদীপ বলেছিল, “তা তো সম্ভব নয়। কারণ বাঁধ কাটলে জোয়ারের জল ঢুকে যাবে। তখন জমি নোনা হয়ে গেলে বছরের পর বছর চাষ হবে না।”
আমি বলেছিলাম, “তা হলে তোমরা কতদিন এ ভাবে থাকবে? রোদে জল শুকোন অবধি?”
প্রদীপ বলেছিল, “না, তা নয়। পাম্প করে জল নদীতে ফেলা হচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে। আরও পাম্প আসবে। কয়েক সপ্তাহর মধ্যেই জল নেমে যাবে।”
বাপরে!
প্রদীপ চলে যাবার পরে তপাই বলেছিল, “বুঝলি দাড়ি, সরকারের উচিত ছিল ডাক্তার না পাঠিয়ে অজস্র পাম্প পাঠানো। আর লং-টার্মে স্লুইস গেট তৈরি করা। ভাঁটার সময়ে খুলে, জোয়ারের সময় বন্ধ করে দিলেই প্রব্লেম সলভড।
প্রথম দু-দিন সারা দিন হেঁটে ফিরে এসে প্রদীপকে বললাম, “বন্যার জন্য কোনও স্বাস্থ্য সমস্যাই হয়নি দেখছি। এখানে থেকে লাভ নেই। অন্য কোনও সমস্যার জন্যও কেউ আসছে না। এমনিই তো লোকে আসতে পারে – ডাক্তার নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র কতো দূরে, কারওর ডাক্তারি কোনও সমস্যা নেই?”
প্রদীপ বলল, “না স্যার। এদের কাছে আপনারা আন্ত্রিকের ডাক্তার। এদের ড্রিপ চালানোয় ভীষণ ভয়। জল চালালে নাকি মানুষ মরে যায়।”
মানে?
তপাই বুঝিয়ে দিল। “আমার মনে হচ্ছে, এ সব জায়গায় তো গ্যাস্ট্রো এন্টেরাইটিস না হলে ড্রিপ চলে না, এবং তা-ও হয় খুব দেরিতে। ফলে লোকে বাঁচে না, আর দোষ হয় চিকিৎসার।”
হতেও পারে।
জানতে চাইলাম, “তোমরা এখানে ডাক্তার বদ্যি পাও কোথায়? তোমাদের সাবসিডিয়ারি তো দেখলাম। ডাক্তার নেই। পাথরপ্রতিমা তো অনেক দূর।
প্রদীপ বলল, “আমরা চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাই।”
আমরা অবাক! পাথর যেতে লাগে দেড় বেলা। পাথর থেকে কলকাতা যেতে আরও এক দিন… প্রদীপ হেসে বলল, “না, আপনারা ডায়ামন্ড হারবার থেকে দক্ষিণে পাথরে এসেছেন, কিন্তু তার পর থেকে উত্তরে চলে দেড় বেলা কলকাতার দিকেই এসেছেন। ওই দেখুন। আকাশের গায়ে ওই গাছগুলো দেখতে পাচ্ছেন? ভালো করে দেখুন, দেখবেন বাস চলছে।”
খুব মন দিয়ে দেখে বললাম, “তা বটে। এ বাস কোথায় যায়?”
প্রদীপ বলল, “সন্তোষপুর। এখান থেকে দূর দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু ভ্যান রিক্সয় সময় নেয় ঘণ্টা দুয়েক। আর তারপর ওখান থেকে সন্তোষপুর আরও একঘণ্টা।”
আমরা থ। এই না হলে সরকারি ব্যবস্থা! বাঙ্গুর হাসপাতাল থেকে এখানে আসতে ঘণ্টা চারেকের বেশি লাগার কথা নয়, আর আমরা কী না…
প্রদীপ বলল, “না, তা হবে না। কারণ আপনাদের পাথর হয়ে আসতেই হত। এই পোস্টিং তো পাথর দিয়েছে আপনাদের।”
বললাম, “সে যা হোক, এখানে বন্যা তো হয়নি। বৃষ্টির জল ধরে রেখে লোকে নিজেরাই কষ্ট পাচ্ছে। কারওর আন্ত্রিক দূরের কথা, পেট পর্যন্ত খারাপ হয়নি। কারওর অন্য কোনও চিকিৎসা দরকার নেই। তাহলে আমরা কেন পড়ে থাকি? আমরা বরং ফিরে যাই।”
প্রদীপ বলল, “আপনাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে, তাই না?”
আমাদের অসুবিধের প্রশ্নই উঠছিল না। সারাদিন জল ঠেলে ঘুরে হাতে পায়ে খুব ব্যথা হত, কিন্তু এ বাদে প্রদীপের বাড়িতে আরামেই ছিলাম। ওর মায়ের হাতের রান্না চমৎকার। কিন্তু রোজ আমাদের ভালো ভালো খাওয়ান, নিজের বাড়িতে নিজেদেরই কারও বিছানা ছেড়ে দিয়ে কষ্ট করা… এ সব কেন?
প্রদীপ বলল, “কিন্তু খবর পেয়েছি ওমুক গ্রামে খুব আন্ত্রিক হচ্ছে। এমনকি মোড়লের বাড়িতেই জল চলছে দু’জনের। কাল একবার চলুন ওদিকে।”
অনেকটা রাস্তা। সবটাই প্রায় জলে ভরা। এবারে পথে জোঁক পেলাম। একটা জোঁক তপাইয়ের দিকে সাঁতার কেটে আসছে, আর তপাই (“এই, যা… এই, যা…” নির্দেশ সহযোগে) প্রাণপনে তাকে লাঠির ঝাপটা মেরে বিপথগামী করার চেষ্টা করছে, সে দৃশ্যের বর্ণনা দেবার ক্ষমতা আমার নেই। ভিডিও করার মতো সিন ছিল।
দুপুরের পরে গিয়ে পৌঁছলাম সেই গ্রামে। গ্রামটা জলমগ্ন নয়। এ রাস্তা ও রাস্তা হেঁটে ঘুরছি, জনপ্রাণী নেই। শেষে একটা বাড়ির দাওয়ায় এক মাঝবয়েসী বসে তামাক খাচ্ছেন, তাঁর কাছে গিয়ে প্রদীপ বলল, “এঁরা কলকাতা থেকে আসছেন।”
“হুঁ।”
“ডাক্তার।”
“হুঁ।”
“বন্যাত্রাণে এসেছেন।”
“হুঁ।”
কার পাল্লায় পড়লাম রে বাবা!
প্রদীপ আবার লম্বা করে শ্বাস নিয়ে শুরু করল। “সরকার এঁদের পাঠিয়েছেন। এখানে যে আন্ত্রিক হয়েছে, তার চিকিৎসা…”
কথা শেষ হল না, ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠলেন প্রায়। “আন্ত্রিক! আন্ত্রিক! কে বলেছে? কে বলেছে এ গাঁয়ে আন্ত্রিক হয়েছে? যত বাজে কথা!”
প্রদীপ বলল, “আমি হেলথ ওয়ার্কার। আমার কাছে খবর আছে এ গাঁয়ের মোড়লের বাড়িতেই আন্ত্রিক হয়েছে, জল চলছে!”
“আমার বাড়িতে আন্ত্রিক! জল চলছে!” এবারে প্রায় হুঁকোর বাড়ি মারেন আর কী! “তোমার সাহস কম না! আমি এ গাঁয়ের মোড়ল, আর তুমি বলছ আমার বাড়িতে আন্ত্রিক হয়েছে! দূর হয়ে যাও, দূর হয়ে যাও…”
বাধ্য হয়ে আমরা দূর হলাম। বলা বাহুল্য, সারা দিন খাওয়া হয়নি। তার ওপর জল ঠেলে জোঁকের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আসা। মেজাজ তিরিক্কি। ফিরে শরীর থেকে জোঁক ছাড়িয়ে চান-টান করে দুজনে প্ল্যান করতে বসলাম প্রদীপের সঙ্গে।
এখান থেকে কী ভাবে ওই সন্তোষপুরের বাস অবধি পৌঁছনো যায়?
প্রদীপ বলল, “না স্যার, আপনারা ও পথে যেতে পারবেন না। আপনাদের পাথর ফিরতে হবে। আপনাদের পাথর থেকে পোস্টিং দিয়েছে না? বি-এম-ও-এইচ রিলিজ দেবেন। তারপরে আর কোথায় যেতে হবে?”
খেয়াল হল, আর কোথাও অর্ডার দেয়নি। কেবল বাঙ্গুর হাসপাতাল। প্রদীপ বলল, “হ্যাঁ। তা-ই হয়। কাকদ্বীপ যেতে হবে না। পাথর থেকে সোজা চলে যাবেন ডায়মন্ড হারবার। সেখান থেকে কলকাতা।”
ডায়ামন্ড হারবার থেকে কলকাতার পথ জানি। পাথরপ্রতিমা থেকে ডায়ামন্ড হারবার যাব কী করে? লঞ্চ তো আর নেই। ভটভটি?
“না স্যার। বাস। পাথর থেকে নদী পেরোলেই বাস পাবেন ডায়ামন্ড হারবার যাবার।”
বেশ। তবে পাথর কী করে যাব এখান থেকে? ওই সাবসিডিয়ারি থেকে নদীপথ?
শুনলাম তিনবার ভটভটি বদলাতে হবে। সে নাকি আমরা পারব না। ভালো হবে যদি সোজা স্থলপথে পাথরপ্রতিমা যাই।
কী করে?
গ্রাম থেকে সোজা রাস্তা গেছে পাথরপ্রতিমার উলটোদিক অবধি। ভ্যানরিক্স যায়। সেটা ধরে গেলে একটু সময় বেশি লাগে, তবে পৌঁছে নদী পেরোলেই পাথরপ্রতিমা।
কতক্ষণ লাগে?
সারাদিন।
আমাদের নির্দেশে প্রদীপ গেল ভ্যানরিক্সর ব্যবস্থা করতে।
*
পরদিন আবার জল ঠেলে রাস্তায় উঠলাম। তপাইয়ের হাতে প্রদীপের লম্বা লাঠি, আমার হাতে অব্যবহৃত ওষুধের পোঁটলা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের বাহন, তার চারপাশে বেশ কিছু গ্রামের লোক।
তপাই বলল, “এরা কি গ্রামের গণ্যমান্যরা? আমাদের বিদায় জানাতে এসেছেন?”
আমি কিছু বোঝার আগে তাঁরা এসে পথ আটকে দাঁড়ালেন। জানতে চাইলেন, “আপনারা চলে যাচ্ছেন?”
আমরা বললাম, “হ্যাঁ। তিন দিন আমরা এখানে সব গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি, কোথাও বন্যাজনিত কোনও অসুখের সন্ধান না পেয়ে আমরা চলে যাচ্ছি।”
একজন মুশকোমতন মুখপাত্র বললেন, “সে হবে না। যেতে পারবেন না।”
মানে?
মানে এই, বোঝা গেল, যে আমরা এসেছি বটে সরকারি ইচ্ছেয়, কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েতের ইচ্ছের ব্যতিরেকে যেতে পারব না। এখানে থাকতে হবে।
বটে! কে রে তুই হোটেল ক্যালিফোরনিয়া? যেতে নাহি দিব? আমরা বললাম, “আপনাদের এখানে অসুখের কোনও হদিস পেলে আমরা থাকতে রাজি ছিলাম, কিন্তু কোথাও যদি কোনও অসুখই না থাকে, আমরা থাকব কিসের জন্য?”
তাঁরা বললেন, যেতে আমরা পারি, তবে ওষুধগুলো নিয়ে যেতে পারব না। ওষুধের বাণ্ডিলটা রেখে যেতে হবে।
আমার বাবা হলে এইসময়ে বলতেন, “হ্যাঁ, আমি তো তোমার বাপের শ্বশুরঠাকুর!” আমরা সে সবে গেলাম না। বললাম যে এই সব ওষুধ খুব সাংঘাতিক, এগুলো ডাক্তার ছাড়া কেউ প্রেস্ক্রাইব করতে পারে না।”
তারাও নাছোড়বান্দা। আমরাও। ক্রমে রাগারাগি হতে শুরু করেছে। শেষে তপাইয়ের মাথায় বুদ্ধি খেলল। ফস্ করে আমাদের অর্ডারটা বের করে বলল, “দেখুন, আমরা কিন্তু সরকারি নির্দেশে আসিনি। আমরা নিজেদের তাগিদে এসেছি। এই দেখুন এই অর্ডারে আমাদের নাম টাইপ করা নয়। হাতে লেখা। ডিরেকটর অফ হেলথ সার্ভিস নিজে লিখেছেন। লোক্যাল কমিটির রেকমেন্ডেশনে…”
ওই সময়ে লোক্যাল কমিটি শুনে ঘাবড়াত না এমন লোক পশ্চিমবঙ্গে কম ছিল। দেখতে দেখতে আমরা ভ্যান চড়ে রওয়ানা দিলাম পাথরপ্রতিমা অভিমুখে।
সে এক যাত্রা বটে। সকাল সাতটায় রওয়ানা দিয়ে পাথরপ্রতিমা পৌঁছলাম সন্ধের অনেক পরে। সারাদিন ভ্যান চালাল একজন। মাঝে ওর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তপাই বলেছিল, “আমি চালাই?”
আমি তাড়াতাড়ি নেমে পড়েছিলাম। দু-বার পেড্যাল করতে না করতে ভ্যান প্রায় রাস্তা ছেড়ে পাশের ধানক্ষেতে হাজির হয়েছিল আরকি! তখনকার দিনে রিক্সভাড়া হিসেব হত একটাকা দু’টাকায়। আমরা ভ্যানচালককে না-চাইতেই ৫০ টাকা দিয়েছিলাম। সে-ও অত টাকা পেয়ে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিল, আমরাও পরে অনেকদিন পর্যন্ত গল্প বলতে পেরেছিলাম – পঞ্চাশ টাকা ভ্যানরিক্সভাড়া দিয়েছি জানিস। ভ্যা-অ্যা-অ্যা-ন রিক্স। বুঝলি? পঞ্চা-আ-আ-আ-আ-শ টাকা!
নদী পেরিয়ে পাথরপ্রতিমা পৌঁছে প্রথম জানলাম যে আমরা এত দেরি করে এসেছি, যে ওপারে যাবার আর মাত্র দুটো যাত্রী-ভটভটি আছে। সেটার পর আছে দুধ নিয়ে যাওয়া ভটভটি। ওটা গেলে সে রাতে পাথরপ্রতিমা ছেড়ে যাবার উপায় আর নেই।
আর দ্বিতীয় হল শঙ্কর পাথরপ্রতিমায় নেই। কাজে গেছে গ্রামে।
ছুটে ছুটে হেলথ সেন্টার গিয়ে প্রথম ধাক্কা, বি-এম-ও-এইচ নেই। কলকাতা গেছেন। তা বেশ, তিনি না থাকতে পারেন, ওঁর জায়গায় কে আছেন? দ্বিতীয় ধাক্কা – সোশ্যাল ওয়ার্কার সিংজী আসবেন আমাদের ব্যাপার বোঝার জন্য।
দেখতে দেখতে সিংজী এলেন। হাবে ভাবে চোয়াড়ে অহমিকা। আপনারা চলে এসেছেন? চলে এসেছেন? কার অনুমতিতে এসেছেন? বন্যার জন্য কোনও অসুখ হয়নি? কে বলেছে? আপনারা বলার কে? আমরা বলছি হয়েছে। আন্ত্রিক হয়েছে। আপনারা কাজ করেননি। আপনাদের রিলিজ দেওয়া হবে না। ফিরে যেতে হবে। কী করে যাবেন সে আপনাদের ব্যাপার। আমি বলে দিচ্ছি – রিলিজ দেওয়া হবে না।
কথায় আলোচনায় সময় পেরোচ্ছে। কে একজন ছুটে এসে জানাল – ডাক্তারবাবু, আপনারা যাবেন? দুধের ভটভটি এসে গেছে। দুধ লোড হলে চলে যাবে। আর সময় নেই।
হঠাৎ খেয়াল হল। তপাইকে বললাম, “শোন, এখন ডিক্লেয়ার্ড ফ্লাড চলছে। ফ্লাড রিলিফ অপারেশন হচ্ছে। এই সময়ে কোনও বি-এম-ও-এইচ ছুটি নিতে পারে না। ব্যাটা ফাঁকি মেরে পুজোর বাজার করতে কলকাতা গেছে। দাঁড়া, দেখাচ্ছি।”
আবার ঢুকলাম অফিসে। সিংজী ক্লার্ককে নির্দেশ দিচ্ছেন – কোনও ভাবেই যেন রিলিজ না দেওয়া হয়। ডিউটি ছেড়ে পালালে কী হয়, কলকাতার ডাক্তাররা বুঝে নিক।
আমি ক্লার্ককে গিয়ে বললাম, “আমাদের পোস্টিং অর্ডারটা আপনার কাছে আছে? একটু বের করবেন?”
ক্লার্ক আর সিংজী মুখ তাকাতাকি করে ফাইল খুলে কাগজ বের করল। আমি পেন দিয়ে লেখা আমার আর তপাইয়ের নামদুটো দেখিয়ে বললাম, “দেখেছেন, এই দুটো নাম পেন দিয়ে লেখা? পেনের কালি, হাতের লেখা মিলিয়ে নিন ডি-এইচ-এস এর সইয়ের সঙ্গে। আমরা অর্ডার পেয়ে রিলিফে আসিনি। আমরা ভলান্টিয়ার করেছি, তাই কালীদা নিজে হাতে আমাদের নাম লিখে দিয়েছেন। আমরা দুধের ভটভটিতে চলে যাচ্ছি। ডি-এইচ-এস আমাদের জানিয়েছেন কলকাতা ফিরে রিপোর্ট দিতে, তাই রাইটার্সে জানিয়ে দেব কেন আমরা পাথরপ্রতিমা থেকে রিলিজ আনতে পারিনি।”
ঘর থেকে বেরোতে না বেরোতে সিংজীর গলা এল। “ডাক্তার সাব, এক মিনিট। আপনারা রিলিজ নিয়ে যান।”
দেখলাম ড্রয়ারে এক তাড়া সাদা কাগজে জায়গামত বি-এম-ও-এইচ সই করে রেখেছেন। ফটাফট টাইপরাইটারে চালিয়ে ক্লার্ক আমাদের রিলিজ অর্ডার বানিয়ে দিল। আমরা কোনও রকমে পড়িমরি করে দৌড়লাম দুধের ভটভটি ধরতে।
নদীর ওপারে বাসস্ট্যান্ডে ডায়ামন্ড হারবারের শেষ বাস দাঁড়িয়ে আছে। অনেক রাত, তাই ভীড় নেই, তবে সেই জন্যই ড্রাইভারের তাড়া আছে। আমরা বসার আগেই বাস দিল ছেড়ে। টাল সামলাতে না পেরে তপাই প্রায় পড়ে যায় আর কী! ভাগ্যিস প্রদীপের লাঠি ছিল! লাঠি দিয়ে সাপোর্ট নিয়ে কোনও রকমে সামলে বসল। তবে সে লাঠির আগার কাদা লেগে গেল সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকের প্যান্টে – হাঁটু থেকে কুঁচকি অবধি।
তিনি ভয়ানক রেগে গেলেন। এই রকম কেউ বাসে কাদামাখা লাঠি নিয়ে ওঠে? উঠলেও সে কাদা সহযাত্রীর গায়ে মাখায়? এই সব লোকেদের বাসে উঠতে দেয় কেন?
তপাই দেখলাম বিচলিত হল না। বলতে লাগল, “আরে দাদা, জানেন আমরা কোথা থেকে আসছি? আমরা আসছি সে-এ-এ-এ-ই ইন্টিরিয়র সুন্দরবন থেকে। জানেন, বন্যা হয়েছে? জানেন, মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম জলে ডোবা? জানেন, গত তিন দিন ধরে আমরা কোমর জল ঠেলে ঠেলে সেখানে বন্যাত্রাণ করেছি? জানেন, আজ সকালে সাড়ে সাতটা থেকে রাত প্রায় ন’টা অবধি আমরা ভ্যান রিক্স চড়েছি…” এই সব তপাই হযবরল-র ন্যাড়ার মতো বার বার নানা সুরে বলতে লাগল, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল এই, যে আমরা বন্যাত্রাণে গিয়ে এত কষ্ট করলাম, আর আপনি না-গিয়ে এইটুকু কাদা মাখতে পারছেন না?
ভদ্রলোক খানিক বাদে নিরস্ত হলেন। তপাই আর আমি নির্বিঘ্নে ডায়মন্ড হারবার পৌঁছলাম।
*
তখনকার ডায়ামন্ড হারবারে এত থাকার জায়গা ছিল না। রাত কাটাতে হলে সাকুল্যে ওই একটি নামই ভরসা, সাগরিকা ট্যুরিস্ট লজ। শুনশান রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমরা যতক্ষণে সাগরিকায় পৌঁছলাম, তখন রাত সাড়ে দশটা।
সেদিনের রাত সাড়ে দশটা ঠিক কী, আজকের লোককে বোঝানো কঠিন। টিভি বন্ধ হত রাত দশটায়। রেডিওতে দিবারাত্রি এফ-এম চলত না, আর স্টেশন বলতে ছিল কলকাতা ক, খ আর বিবিধ ভারতী। তিনজনেই লক্ষ্মী ভাই-বোনের মতন রাত এগারোটায় চাদর টেনে ঘুমোতে যেত। ফলে আমরা যখন সাগরিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন সেখানে কেউ নেই, কাচের দরজার ওপারে দূরে একটা টিউব-লাইটের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে কাউন্টার – সেখানে কেউ নেই, দরজার বাইরে কোনও ঘণ্টি নেই, ভেতরের লোককে জানানোর কোনও উপায় নেই যে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি – আমরা, যারা কি না গত তিন দিন ধরে কোমর জল ঠেলে ঠেলে বন্যাত্রাণ করেছি…
কাঠের ফ্রেমে কাচ লাগানো দরজায় টকটক করলাম, চিৎকার করলাম – ‘কেউ আছেন? কেউ আছেন?’ রাস্তার কুকুররা ঘেউ ঘেউ করে উঠল। মনে হল বিল্ডিং-এর পেছনে একটা আলো জ্বলছে না? ডায়ামন্ড হারবারের রাস্তা উঁচু, ফলে বিল্ডিং-এর পেছনে যেতে গেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে হেঁটে যেতে হয়। গেলাম। আলো-টালো নেই, ভুল হয়েছিল। তা-ও, ‘কেউ আছেন? কেউ আছেন?’ বলে খানিকক্ষণ হাঁকডাক করে আবার ফিরে এলাম সামনে। রাত এগারোটা বাজতে চলেছে। মরিয়া হয়ে এবারে কাচের দরজাতেই তপাই দমাদ্দম মারতে শুরু করল, সঙ্গে পরিত্রাহী ‘কেউ আছেন? কেউ আছেন?’ চিৎকার।
এবারে আস্তে আস্তে কাউন্টারের পেছন থেকে কম্বল-মোড়া এক অবয়ব জেগে উঠল। তিনি ওখানেই সারক্ষণ ঘুমোচ্ছিলেন। দরজা খুলল, আমি যতক্ষণ নাম ধাম লিখছি, তপাই ওঁকে আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের সামারি দিল – উনি খুব পাত্তা দিলেন না। বললেন, “কী রকম ঘর চাই? সিংগিল? ডাবেল? অ্যাটাচ টয়লেট? এসি? সিংগিল রুম খালি নেই কিন্তু।”
তপাই ভাবতে লেগেছে, আমি বললাম, “রাত্তিরটা শুতে চাই। যা হোক হলেই হল। এসি চাই না। অ্যাটাচ টয়লেট দিন। সিংগিল না থাকলে ডাবেল দিন।”
“ডাবেল রুম অ্যাটাচ টয়লেট নেই।”
“দুত্তোর! যা আছে দিন তো…”
রাত্তিরে একবার ঘুম ভাঙল তপাই খাটের মাথার দিকের দেওয়ালে দুমদুম শব্দ করছে। বললাম, “কী হল?”
“আরে শালা, পাশের ঘরে হানিমুনিং কাপ্ল্! ঘুমোতে পারছি না।”
আমি বললাম, “কই, আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম।”
“তুই হারামজাদা ভূমিকম্প হলেও ঘুমোতে পারিস।”
আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে ট্রেনে ফিরতে ফিরতে আমরা ঠিক করলাম আমি বাড়ি গিয়ে চান-টান করে বাঙ্গুর যাব রিলিজ নিতে। আমি তখন থাকতাম রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর পাশে। তপাই থাকত উল্টোডাঙা/কাঁকুড়গাছি অঞ্চলে (আমাদের সময়ে সেটা কলকাতার ‘কাছে’ বলে গণ্য করা হত – বিশ্বাস না হলে সত্যজিৎ রায়ের ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্প দ্রষ্টব্য)। ওর পক্ষে অতটা গিয়ে আবার ফিরে আসা পোষাবে না।
যথাসময়ে গিয়ে হাজির হলাম সেই ক্লার্কের সামনে যিনি আমাদের বিদায় দিয়েছিলেন। কাগজপত্র সামনে দিয়ে অব্যবহৃত ওষুধের পোঁটলা ফেরত দিয়ে রিলিজের আর্জি জানালাম।
তিনি প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন।“রিলিজ? রিলিজ? ফাজলামো হচ্ছে? রিলিফ ছেড়ে ফিরে এসেছেন কেন? জানেন, ডেরিলিকশন অফ ডিউটি? পাথর থেকে রিলিজ করিয়ে আনুন আগে।”
কাগজটা টেনে বের করে বললাম, “এই যে।”
এবার তিনি তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন। “এ কী! ফ্লাডের সময়ে পাথরের বি-এম-ও-এইচ আপনাকে রিলিজ দিয়ে দিল? সব্বোনাশ করেছে! শো-কজ হবে।” বলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “রিলিজ হবে না। সরকারি খাতায় একবার যখন নাম গেছে, অত সহজে মুক্তি নেই। বসুন। আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে আসি। দেখি, আপনাদের আর কোথায় পাঠানো যায়…”
ভদ্রলোক চলে গেলে বুঝলাম পাথরপ্রতিমায় ‘কালীদা’র হাতের লেখা দেখিয়ে যে রেজাল্ট হয়েছিল, রাইটার্সের এত কাছে সে রেজাল্ট পাব না। তাই ভদ্রলোক আসার আগেই চুপচাপ বেরিয়ে ট্রামে চড়ে বাড়ি চলে গেলাম।
*
পরদিন গেছি মেডিক্যাল কলেজ। কাজ শুরু করার আগে প্রফেসর বসু বললেন, “দাও, তোমার রিলিজ অর্ডার দাও।” সব শুনে বললেন, “এ কী কাণ্ড করেছ! বাঙ্গুর হাসপাতাল থেকে রিলিজ না নিয়ে এসেছ! এটা ঠিক করনি। ওটা না হলে তো তুমি রাইটার্সের রিলিজ পাবে না। আর সে না হলে তো এখানকার সুপারিন্টেন্ডেন্ট তোমাকে এখানে জয়েন করতে দিতে পারবেন না। তুমি যাও, যাও। বাঙ্গুর যাও। আমি এখানে তোমাকে কাজ করতে দিতে পারব না।”
কী ঝঞ্ঝাট! আমি চুপচাপ ক্যান্টিনে গিয়ে বসে আছি। তপাই এল। ওরও একই অবস্থা। বললাম, “চল, যাই গিয়ে টি-এ ডি-এর উদ্বৃত্ত টাকাটা ফেরত দিয়ে আসি।”
সেখানেও বলে, রিলিজ অর্ডার?
আমরা যত বলি, রিলিজ আসবে ’খন, আপনি বাড়তি টাকাটা রাখুন। আমরা ২ সপ্তাহের টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি ৬ দিনের মাথায় – কে কার কথা শোনে। বিফলমনোরথ হয়ে বেরোতে গিয়ে শুনলাম অ্যাকাউন্টস সেকশনে হাসির হররা! পাগলা কোথাকার! টাকা ফেরত দিতে এসেছে। অর্থাৎ অঙ্কণ ফেরা অবধি আর কোনও উপায় নেই।
অঙ্কণ ফিরেছিল আরও কয়েকদিন পরে। ওদের দু-তিন জায়গায় পাঠিয়েছিল কাকদ্বীপের বি-এম-ও-এইচ। সর্বত্র একই অবস্থা। বন্যা নয়, বৃষ্টির জল। মানুষের সৃষ্ট ইকোলজিকাল ডিজাস্টার। ওরা যেখানেই গেছে, পঞ্চায়েতের হাতে উদ্বৃত্ত ওষুধ দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবারই বি-এম-ও-এইচ নতুন ওষুধের পোঁটলা দিয়েছে।
বললাম, “তুই এবারে কালীদাকে ধরে রিলিজ নিয়ে আয়।”
অঙ্কণ অভয় দিয়ে চলে গেল।
*
উপসংহার আছে। অঙ্কণের মধ্যস্থতায় আরও দু-সপ্তাহ পরে আমরা রিলিজ পেলাম। ততদিন আমরা রোজ মেডিক্যাল কলেজে আসি আর যাই। কাজ করতে পাই না। এর মধ্যে আমি সাত পাতা লম্বা রিপোর্ট লিখে পাঠালাম অঙ্কণের হাতে। বন্যা হয়নি। বৃষ্টি হয়েছে। জল কেন দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোনও অসুখের লক্ষণ নেই – সবই লিখলাম, লিখলাম না বি-এম-ও-এইচের না থাকার কথা। সিংজীকে বলেছিলাম রিলিজ না পেলে লিখব। রিলিজ পেয়েছি, তারপরে লোকটা ছিল না বলার প্রমাণ আমার হাতে নেই।
অঙ্কণ রিলিজ অর্ডার এনে দিয়ে বলেছিল, “কালীদা বলেছে, ‘এই না হলে মেডিক্যাল কলেজের ছেলে? বন্যাত্রাণেও গেল, রিপোর্টও লিখে দিল।’ আচ্ছা, ভালো কথা, আরও দু-সপ্তাহের টি-এ ডি-এ অ্যাকাউন্টস থেকে তুলে নিস।”
তুলে নিস? ফেরত দেব না? আবার কিসের টি-এ ডি-এ?
অঙ্কণ অবাক হয়ে বলল, “কেন? বন্যাত্রাণের? রিলিজ পাওয়া অবধি তো তোরা বন্যাত্রাণ করেছিস। তার অ্যালাওয়েন্স নিবি না?”
আমরা অবাক! কলেজের ক্যান্টিনে বসে চা খেয়েছি, আড্ডা মেরেছি। কাজ না-করে মাইনেও পেয়েছি। তার জন্য ডেলি অ্যালাওয়েন্স? ট্র্যাভেল অ্যালাওয়েন্স?
অঙ্কণ বুঝিয়ে বলল, এই নাকি সরকারি নিয়ম। আমি ক’ দিন কী কাজ করেছি বা করিনি, তাতে সরকারের কিছু আসে যায় না। রিক্রুটমেন্ট থেকে রিলিজ – এ ক’দিনের অ্যালাওয়েন্স আমার নামে বরাদ্দ হয়ে গেছে। সে নিতে হবে আমাকেই। এত বন্যাত্রাণী, সবাই নিয়েছে।
বয়ে গেছে।
কিন্তু বয়ে তো অত সহজে যাওয়ানো যায় না। কিছুদিনের মধ্যেই আমার আর তপাইয়ের নামে ডাক এল, “এই শোন, অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক বলেছেন তোদের নাকি কিছু টাকা পাওনা আছে? তোরা গিয়ে নিয়ে নে।”
মাসের শেষে মাইনে তুলতে গেলে ক্লার্ক বলতেন, “শুনুন, টাকাটা নিয়ে যাবেন, কেমন?”
“আ-আ-আ-আ-চ্ছা, ঠি-ই-ই-ক আছে,” বলে পালাতাম। কাজ না করে টাকা নেবার অভ্যেস আমার অন্তত হয়নি কোনও দিনই। আশা করি তপাইয়েরও হয়নি এখনও।
কিন্তু মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আর ডাক নয়, একেবারে সমন এল। খোদ সেকশন ইনচার্জের কাছ থেকে। ডাকতে এলেন ডিলিং ক্লার্ক নিজে। গেলাম আমি আর তপাই, সেকশন ইনচার্জকে বুঝিয়ে বললাম, “আমরা এক মাস বন্যাত্রাণ করিনি। এ টাকা আমাদের প্রাপ্য নয়।”
মাথা নেড়ে উনি বললেন, “সে আমি জানি না। আমার সিন্দুকে টাকা পড়ে আছে। আপনাদের নামে টাকা। এ টাকা এখান থেকে আর কোথাও যেতে পারবে না। আপনারাই নেবেন। ৩১শে মার্চের পরে এই টাকা এই সিন্দুকে পাওয়া গেলে অডিট আমার নামে শো-কজ করবে, চার্জশিট হবে। তারচে’ নিয়ে যান। যা খুশি করুন তার পরে। আমাকে ফাঁসাবেন না।”
অগত্যা! বেরোতে বেরোতে আলোচনা করছি কোন দাতব্য সংস্থাকে দেওয়া যায়, পথ আটকে দাঁড়াল… আচ্ছা থাক, কে দাঁড়াল আর না-ই বা বললাম। এখনও সে আমার বন্ধু। আজকাল দুর্গাপুজো-টুজো করে অবশ্য।
রণং দেহি মূর্তি।
“এই, টাকাটা তুলেছিস, এখানে দে।”
কোনখানে?
“বাজে বকিস না। আমাকে দে।”
তোকে? কেন তোকে দেব? তুই কে?
“ওই টাকা পার্টি ফান্ডে যাবে। ও টাকা তোদের না। পার্টির। আমরা বলেছিলাম বলেই তোরা পেয়েছিস। এক্সট্রা ক’হাজার টাকা পেয়েছিস? আমাদের হিসেবে … টাকা। ও টাকা আমাদের।”
ঘণ্টা (অ্যাকচুয়ালি এই কথাটা বলিনি, তবে এই লেখার জন্য ওটাই থাক) দেব। পার্টির টাকা না হাতি! শালা, তোমরা সারা স্টেট-টাকে লুটে খাচ্ছ, এখন এই টাকা নেবার জন্যেও এসেছ!
“বাজে কথা বলবি না। চাইছি, দিয়ে দে। নইলে…”
নইলে কী করবি? কর দেখি। এই ঢোকালাম টাকা পকেটে।
“এই, এই, পকেটে রাখিস না! আচ্ছা, কিছু অন্তত দে। ফিফটি পার্সেন্ট?”
ঘণ্টা (অ্যাকচুয়ালি অন্য কথা) দেব, বললাম না? যা ফোট্।
“এই মাইরি, আচ্ছা, একশো টাকা দে। পঞ্চাশ? দশটাকা দিয়ে যা চাঁদা…”
আমি আর তপাই হাসতে হাসতে ক্যান্টিনের দিকে রওয়ানা দিলাম। পেছনে শুনতে পেলাম, “এঁইঁ মাঁইঁরিঁ, কিঁছুঁ দিঁয়েঁ যাঁ, এঁইঁ দেঁখ, কিঁচ্ছুঁ নাঁ দিঁয়েঁ চঁলেঁ গেঁলঁ যেঁ, মাঁইঁরিঁ বঁলছিঁ, কিঁছুঁ দেঁ, নঁইঁলেঁ আঁমিঁ কিঁ উঁত্তঁর দেঁবঁ…” গলাটা মিলিয়ে এল।
দুর্ধর্ষ! তপাই আমার ক্লাসমেট। আমি ইন্দিরা।
শেষে প্রদীপ জ্বলল না!