সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বান্টিঙের ইংলন্ড যাত্রার সূচি জারি হলো। সে মতো, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে, স্ত্রী হেনরিয়েটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ১৬ই ফেব্রুয়ারি মন্ট্রিয়ল এসে পৌঁছলেন বান্টিঙ। এখানে এসে তাঁর সাথে দেখা করে যান কলিপ। কলিপ তাঁকে এক জোড়া দস্তানা উপহার দেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, সোমবার, সকাল ৯.৫০, মন্ট্রিয়ল থেকে হাডসন ৩ বিমানে নিউফাউন্ডল্যান্ডের গ্যান্ডার বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন বান্টিঙ। ঘন্টা পাঁচেক পর বেলা ৩ টা নাগাদ গ্যান্ডার বন্দরে অবতরণ করে বান্টিঙের বিমান। গ্যান্ডারে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ বাদেই ইংলন্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল বান্টিঙের। কিন্তু খবর পাওয়া গেল ইংলন্ডের আবহাওয়া বিমান অবতরণের উপযুক্ত নয়। ফলে সেদিনের মতো বাতিল করতে হয় বান্টিঙের ইংলন্ড যাত্রা। গ্যান্ডারে এখন অনবরত উঠা নামা করছে যুদ্ধবিমান। হ্যাঙ্গারেও তিল ধারণের জায়গা নেই। পরের দিনও ব্যস্ততা ও নিরাপত্তার কারণে গ্যান্ডার থেকে উড়ার অনুমতি দেওয়া হয় নি বান্টিঙের হাডসন ৩ বিমানকে। গ্যান্ডারের আবহাওয়াও তখন কিছুটা প্রতিকূল। ফলে, দু’দিন গ্যান্ডারেই আটকে থাকতে হলো বান্টিঙকে। ২০শে ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, বিমান ছাড়ার অনুমতি পাওয়া গেল। তিনিই একক যাত্রী এই বিমানে। সঙ্গে থাকছেন আরও তিনজন। পাইলট- যোসেফ সি. ম্যাকি, নেভিগেটর- উইলিয়ম বার্ড এবং রেডিও অপারেটর- উইলিয়ম স্নেলহাম। স্থানীয় সময় রাত ৭টা বেজে ৫৮ মিনিট, গ্যান্ডারের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়লো বান্টিঙের দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট বোমারু লকহিড এল-৪১৪ হাডসন ৩ বিমান। গন্তব্য ইংলন্ড।
গ্যান্ডার ছাড়ার আধঘন্টা পর, বিমান তখন গ্যান্ডার থেকে প্রায় ৮০ কিমি উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে, হঠাৎই বিমানের ডানদিকের [স্টারবোর্ড][৬১] ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে কারবুরেটরের তেল জমে যাওয়ায় এই বিপত্তি বলে মনে করলেন পাইলট ম্যাকি। ইঞ্জিনকে পুনরায় চালু করার চেষ্টা করতে থাকেন পাইলট ম্যাকি। কিন্তু কিছুতেই সেই ইঞ্জিনকে আর চালু করতে পারলেন না তিনি। অবস্থা অনুকূল নয় বুঝে, ফিরতি পথে গ্যান্ডারের দিকে বিমানের মুখ ঘোরালেন পাইলট ম্যাকি। ইতিমধ্যেই আবার শুরু হয় তুষারপাত। তুষারপাতের ফলে বিমান চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ালো ম্যাকির পক্ষে। বিপদ বুঝে সবাইকে প্যারাস্যুট পড়ে তৈরি থাকতে বললেন তিনি। অধিক উচ্চতায় বিমান চালাতে না পেরে বিমানকে অনেক নীচুতে নামিয়ে আনেন ম্যাকি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সামান্য উঁচু দিয়ে গ্যান্ডার বিমান বন্দরের দিকে এগোতে থাকল বান্টিঙের বিমান। আকাশপথে সমুদ্র থেকে স্থলে ঢোকার মুখেই বিমানের দ্বিতীয় [পোর্ট] ইঞ্জিনটাও বন্ধ হয়ে যায়, সম্ভবত যান্ত্রিক কারণে। সাথে সাথে তিনজন আরোহীকেই প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ মেরে বিমান ছাড়ার নির্দেশ দেন ম্যাকি। এই মুহূর্তে জরুরি অবতরণ করতে হবে তাঁকে। কিন্তু এই রুক্ষ পাহাড়ি বরফাচ্ছাদিত বনাঞ্চলে কি করে অবতরণ করবেন তিনি? নিউফাউন্ডল্যান্ডের উত্তর উপকূল জলাশয়াকীর্ণ, অসংখ্য ছোটো বড় পুকুর, হ্রদে ভর্তি এই অঞ্চলটা। এই রকমই কোনও হ্রদে বা পুকুরে ‘বেলি ল্যান্ডিং’ করবেন বলেই মনস্থির করলেন পাইলট ম্যাকি। রাত তখন আনুমাণিক ৯.২৫, কোথাও এতটুকু আলো দেখতে পাচ্ছেন না ম্যাকি। ঘন অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না নীচে কোথায় জল আর কোথায় স্থল। এদিকে বিমানের দুটো ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, দ্রুত বেগে মাটির বুকে নেমে
বান্টঙের শেষ ছবি, মন্ট্রিয়ল, ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ |
আসতে থাকে বোমারু বিমানটা। এবার সামনেই একটা হ্রদ দেখতে পাচ্ছেন ম্যাকি। ওখানেই বেলি ল্যান্ডিং করতে মনস্থির করলেন তিনি। মাটির কাছাকাছি নেমে আসার সময়ে একটা গাছের সাথে ধাক্কা লাগে বিমানের একটা ডানার। মুহূর্তের মধ্যে লাট খেয়ে বরফাচ্ছাদিত রুক্ষ প্রান্তরে সশব্দে আছড়ে পড়ে বিমানটা। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে বরফের উপর ঘষটে ঘষটে কিছুটা পথ গিয়ে অবশেষে থামল বান্টিঙের লকহিড এল-৪১৪ হাডসন ৩ বিমানটা। তারপর সব শান্ত। রাতের নিস্তব্ধতা আবার ঘিরে ধরল সেই প্রান্তরকে।
২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়, বান্টিঙের হাডসন ৩ বিমান রওনা দেওয়ার পর পরই আরও চারটে হাডসন ৩ টেক অফ করেছিল গ্যান্ডার বিমান বন্দর থেকে। তাদেরও গন্তব্য ইংলন্ড। তাদের প্রত্যেকের সাথেই বন্দরের রেডিও যোগাযোগ বহাল ছিল। আধঘন্টা পরে, বান্টিঙের বিমানের সঙ্গে গ্যান্ডার বিমান বন্দরের রেডিও যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটতে থাকে। খর খর শব্দে প্রায় কিছুই শোনা যাচ্ছিল না তখন। কিছুক্ষনের মধ্যেই বান্টিঙের বিমানের সাথে বিমান বন্দরের রেডিও যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনকার দিনে রেডিও ব্যবস্থায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা ছিল না। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ও আবহাওয়ার কারণে এই জাতীয় বিঘ্নের প্রায়ই সম্মুখীন হতেন বিমান চালকরা। সাধারণ রেডিও বিপত্তি ভেবে, অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না বন্দর কর্তৃপক্ষের। কিছুক্ষণ পর অন্য একটা হাডসন ৩ বিমান, বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানান, বান্টিঙের হাডসন ৩ বিমানকে বন্দরের দিকে ফিরে যেতে দেখেছেন তাঁরা।
খবরটা শোনা মাত্রই সতর্ক হয়ে উঠে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাঁদের অনুমান করতে অসুবিধা হয় নি যে বান্টিঙের বিমান বিপদে পড়েছে। কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন, বান্টিঙের বিমান গ্যান্ডারেই অবতরণ করবে। সেই মতো সমস্ত প্রস্তুতিও নিতে শুরু করলেন তাঁরা। কিন্তু সময় অতিবাহিত হয়ে যায় অথচ বান্টিঙের বিমানের দেখা নেই। চিন্তা বাড়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের। এদিকে প্রবল তুষার ঝড় শুরু হয় তখন গ্যান্ডারে। আবহাওয়া তখন সম্পূর্ণ প্রতিকূল। নতুন করে কোনও বিমান উঠা বা নামার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না তখন। তবে বান্টিঙের বিমানের জন্য রয়েছে জরুরি অবতরণের ব্যবস্থা। কিন্তু কই, বান্টিঙের বিমান কোথায়? দেখাই তো নেই বান্টিঙের বিমানের। বারবার চেষ্টা করেও বান্টিঙের বিমানের সাথে রেডিও যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলেন তাঁরা। রাত অনেক হলো তখন, স্পষ্টতই বোঝা গেল, বিপদের মুখে পড়েছেন বান্টিঙ। নড়েচড়ে বসলেন গ্যান্ডার বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ। রাতে আবহাওয়া খারাপ থাকায়, কোনও বিমানকে তল্লাসিতে পাঠানো সম্ভব হয় নি বন্দর কর্তৃপক্ষের। পরদিন সকালেও আবহাওয়ার কোনও পরিবর্তন না হওয়ায়, বিমান উঠা নামা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল গ্যান্ডার বিমান বন্দরে। বন্ধ রইল বান্টিঙের বিমানের তল্লাসির কাজও। বেলা ২টো নাগাদ আবহাওয়ার সামান্য উন্নতি হলে, একটা বিমানকে পাঠানো হলো তল্লাশিতে। সমুদ্র বা উপকূলবর্তী অঞ্চলে, তেমন কিছু নজরে না পড়ায় চক্কর দিয়ে ফিরে আসে বিমানটা। প্রমাদ গুনলেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। বেশ বুঝতে পারছেন খারাপ কিছুই ঘটেছে বান্টিঙের বিমানের। সাথে সাথে খবর পাঠানো হলো মন্ট্রিয়লে- বিমান ও যাত্রীরা নিখোঁজ। খবর পৌঁছে দেওয়া হলো বান্টিঙের স্ত্রী হেনরিয়েটার কাছে। বান্টিঙের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে, নিউফাউন্ডল্যান্ড আসার প্রস্তুতি নিলেন কলিপ। কিন্তু সুরক্ষার প্রশ্নে, মন্ট্রিয়লে আটকে দেওয়া হলো তাঁকে।
সেভেন মাইল পন্ডের পাশে ভেঙ্গে পড়া বান্টিঙের হাডসন ৩ বিমান। ১৯৪১ সালে তোলা ছবি। |
পরদিন সকালে, আবহাওয়ার সামান্য উন্নতি ঘটলে, নতুন উদ্যোগে তিনটে বিমান আটলান্টিক মহাসাগরে নজরদারি চালালো। কিন্তু না, কোথাও কোনও বিমান বা তার ধ্বংসাবশেষ নজরে এলো না তাঁদের। ঘন ঘন প্রতিকূল আবহাওয়ার দাপটে, টানা তল্লাশি জারি রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষের। মাঝে মাঝেই বন্ধ রাখতে হচ্ছিল তল্লাশি। ২২ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি, দুদিন ধরে বিক্ষিপ্ত ভাবে তল্লাশি জারি রাখা হয়। ইতিমধ্যে বান্টিঙদের বিমানের খোঁজে মন্ট্রিয়ল থেকে আরেকটা ‘হাডসন ৩’ বিমান এসে অবতরণ করে গ্যান্ডারে। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, আকাশ পরিষ্কার হলে, নতুন উদ্যমে তল্লাশি শুরু করে হাডসন ৩। নিউফাউল্যান্ডের উত্তরে, মাসগ্রেভ হারবারের ১৬ কিমি দক্ষিণে ‘সেভেন মাইল পন্ড’এর [৬২] পাশে একটা বিমানের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে উদ্ধারকারী হাডসন ৩ দলের ক্যাপ্টেন অ্যালিসনের। ক্যাপ্টেন অ্যালিসন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, একজন জীবিত আছেন তখনও। বরফের উপর পা ঘষে ঘষে হাঁটছেন তিনি। তাঁর যাত্রা পথের স্পষ্ট ছাপ পড়ছে বরফের উপর। না, না, শুধু হাঁটছেন না, হাঁটতে হাঁটতে লিখছেনও তিনি। বরফের উপর চলতে চলতে পা দিয়ে ঘষে ঘষে তিনি লিখলেন, ‘থ্রি ডেড’। নীচে লিখলেন ‘যো’। ‘যো’ মানে যোসেফ, ক্যাপ্টেন যোসেফ ম্যাকি, বান্টিঙের বিমানের চালক। দ্রুত তল্লাসি বিমানটাকে অনেকটা নীচ নামিয়ে আনলেন ক্যাপ্টেন অ্যালিসন। বিমান থেকে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ ফেলা হলো। দ্রুত বার্তা পাঠানো হলো গ্যান্ডার বিমান বন্দরে। দুর্ঘটনা স্থলের দিক নির্দেশ করে বলা হলো এখানে বিমান অবতরণ করানো সম্ভব নয়। স্থলপথই পৌঁছতে হবে এখানে। তল্লাশি বিমান দ্রুত উড়ে গেল নিকটবর্তী মাসগ্রেভ হারবারের দিকে। মাসগ্রেভ হারবার থেকেই স্থলপথ দিয়ে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি দুর্ঘটনাস্থল পৌঁছনো সম্ভব। মাসগ্রেভের একটা বসতিপূর্ণ এলাকা নজরে এলো ক্যাপ্টেন অ্যালিসনের। বিমানটা অনেক নীচে নামিয়ে আনলেন ক্যাপ্টেন। বসতির উপর দিয়ে নীচু হয়ে উড়ার পথে, দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছনোর বার্তা লেখা চিরকুট ফেলা হলো বিমান থেকে। তাতে লেখা ছিল, “মাসগ্রেভ হারবার, নীচের মানুষদের দুর্ঘটনা স্থলে পৌঁছতে অনুরোধ করছি”।
নিউফাউন্ডল্যান্ডের উত্তর উপকূলে ছোট জনপদ মাসগ্রেভ হারবার। মূলত মৎসজীবী সম্প্রদায়ের বাসে এখানে। বন্দর থেকে ছোটো-বড় হরেক নৌকায় সমুদ্রে মাছ ধরতে যান জেলেরা। শিকারের খোঁজে, পাহাড়ি জঙ্গলের ভিতরেও মাঝে মাঝেই হানা দেন তাঁরা। ২০ তারিখ রাত্রে, অত্যন্ত নীচু দিয়ে একটা বিমান ডাঙ্গার দিকে উড়ে যেতে দেখেছিলেন দু’একজন মাসগ্রেভবাসী। তুষারপাতের কারণে বাড়ির বাইরে বড় একটা লোকজন ছিল না সেদিন। ফলে বিষয়টা সেভাবে নজরে পড়ে নি আর কারও। এখন বিমান থেকে চিরকুট পেয়ে গ্রামে জটলা তৈরি হয়। জঙ্গলের গভীরে দ্রুত প্রবেশ করতে উদ্যোগী হলেন তাঁরা।
২০শে ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ নিউফাউন্ডল্যান্ডের ‘সেভেন মাইল পন্ড’এর পাশে মাটিতে আছড়ে পড়ে বান্টিঙের লকহিড এল-৪১৪ হাডসন ৩ বিমান। প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠে বিমানটা। তারপর সব শান্ত, জনমানবহীন প্রান্তরে আবার নেমে আসে রাতের নীরবতা। কতক্ষণ পর কে জানে, ধীরে ধীরে জ্ঞান ফেরে বিমানের পাইলট যোসেফ ম্যাকির। আহত বিধ্বস্ত শরীরটা নিয়ে আচ্ছন্নের মতো বসেই রইলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারেন, ভেঙ্গে পড়ার পর বিমানে কোথাও আগুন লাগে নি। এমন কি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিমানটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় নি। ক্ষয়ক্ষতি হলেও বিমানটাকে মোটামুটি নামতে পেরেছেন তিনি। আরও কিছুক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারেন তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও বিমানের তিন যাত্রীর কেউই বিমান থেকে প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ মারেন নি। বিমানের ভিতরে তিন জনকেই দেখতে পান ম্যাকি। তিন আরোহীর নাম ধরে ডাকাডাকি করেও কারও সাড়া পেলেন না তিনি। ককপিট ছেড়ে বিমানের ভিতরে ঢুকে দেখেন তিনজনের দেহ পড়ে আছে বিমানের মেঝেতে। দ্রুতহাতে দেহগুলোকে পরীক্ষা করতে লাগলেন তিনি। পরীক্ষা করে বুঝলেন, নেভিগেটর উইলিয়ম বার্ড এবং রেডিও অপারেটর উইলিয়ম স্নেলহাম- দু’জনেই মৃত। কিন্তু বান্টিঙের শ্বাস প্রশ্বাস চলছে তখনও। বুকের বাঁদিকের পাঁজরের দু’টো হাড় ভেঙ্গে গিয়ে গেঁথে গেছে বান্টিঙের ফুসফুসে [পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তাই দেখা যায়]। বাঁ হাতটাও ভেঙেছে বান্টিঙের। মাথার বাঁ দিকে জোরালো আঘাতের চিহ্ন। যন্ত্রণায় অচেতন তখন বান্টিঙ। আঘাত দেখে বোঝাই যাচ্ছে বান্টিঙের শরীরের বাঁদিকটা সজোরে ধাক্কা খেয়েছে কোথাও। কাপড় দিয়ে বান্টিঙের ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন ম্যাকি। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে প্যারাস্যুটটাই ভালো করে জড়িয়ে দিলেন বান্টিঙের গায়ে। ততক্ষণে সম্বিত ফিরেছে বান্টিঙের। কিন্তু বান্টিঙ বুঝে উঠতে পারছেন না যে তিনি কোথায় আছেন। পাইলট ম্যাকিকেও চিনতে পারলেন না তিনি। আপন মনে বক্বক্ করলেন কিছুক্ষণ। ‘দায়িত্ব’ ‘ডিউটি’ জাতীয় কিছু কথা বলতে চাইছেন বান্টিঙ। তারপর আবার নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। মাঝে মাঝে জ্ঞান আসছে তাঁর, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার ঝিমিয়ে পড়ছেন তিনি। পাইলট ম্যাকি অবশ্য তুলনামূলক ভাবে কিছুটা সুস্থ আছেন এখন। আঘাত আছে তাঁর শরীরেও, তবে এখন তিনি অনেকটাই সামলে নিয়েছেন নিজেকে। এই ঝড়ের রাতে কোনও রকম সাহায্যের আশা নেই বুঝে, সারা রাত বিমানের ভিতরেই বসে রইলেন ম্যাকি।
পরদিন, ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, ভোরের দিকে বান্টিঙকে পরীক্ষা করেন ম্যাকি। কোনও জ্ঞান নেই বান্টিঙের। অচেতন হয়ে পড়ে আছেন বিমানের মেঝেতে। তবে শ্বাস চলছে তখনও। ভোরের আলো ফুটলে বিমান থেকে বেরোলেন ম্যাকি। আবহাওয়ার সামান্য উন্নতি হয়েছে, তবে আকাশ মেঘলা তখনও, বইছে ঝড়ো বাতাসও। তারই মধ্যে, ত্রাণের আশায় লোকালয়ের সন্ধানে বেরোলেন তিনি। নিকটবর্তী কোনও জনপদে এক্ষুনি পৌঁছে দিতে হবে সাহায্যের বার্তা। বাঁচাতে হবে বান্টিঙকে, বাঁচাতে হবে নিজেকেও। কিন্তু এখন তিনি ঠিক কোথায় আছেন, আর কোন দিকে কতদূর গেলে জনপদ পাবেন তার কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না তিনি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ক্ষত বিক্ষত দেহটাকে বরফের উপর দিয়ে টানতে টানতে এগিয়ে চললেন ম্যাকি। অনেকক্ষণ ঘুরলেন এদিক ওদিক। নাহ্, জনপদ তো দূরের কথা কোথাও কোনও জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পেলেন না তিনি। দেখতে দেখতে অনেকটাই বেলা হলো। আকাশ একটু পরিষ্কার হয়েছে এখন। মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝ আকাশে একটু উঁকি দিয়েছে সূর্যটা [আনুমানিক ১২টা]। এভাবে আর কতক্ষণ খুঁজবেন তিনি? ভোর থেকে এক নাগাড়ে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। এখন বরং প্লেনের কাছাকাছি থাকাটাই উচিৎ বলে বিবেচনা করলেন ম্যাকি, যদি সাহায্য এসে পৌঁছয় ইতিমধ্যে। অগত্যাই বিমানের ধ্বংসাবশেষের দিকে ফিরে চললেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর, বিমানের কাছাকাছি পৌঁছতেই বান্টিঙকে দেখতে পেলেন ম্যাকি। বিমানের বাইরে বরফের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন বান্টিঙ। মানে বান্টিঙ বিমান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন! উনার জ্ঞান এসেছিল! কিন্তু এভাবে বরফের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন কেন তিনি? তবে কি …? বিপদ অনুমান করে বান্টিঙের কাছে দৌড়ে গেলেন ম্যাকি। হ্যাঁ, ঠিকই অনুমান করেছেন তিনি। প্রাণ নেই বান্টিঙের দেহে। নিথর হয়ে গেছে বান্টিঙের দেহ। নাহ্, পারলেন না ম্যাকি, কানাডার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে বাঁচাতে পারলেন না তিনি। বান্টিঙের প্রাণহীন দেহটার কাছে বসে রইলেন তিনি। বিমান দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হওয়ার পরদিন, ২১শে ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলায় মারা যান ডা. ফ্রেডরিক গ্রান্ট বান্টিঙ।
(চলবে)
[৬১] বিমানের ডানদিকের ইঞ্জিনকে স্টারবোর্ড ইঞ্জিন ও বাঁদিকের ইঞ্জিনকে পোর্ট ইঞ্জিন বলা হয়।
[৬২] বান্টিঙের দুর্ঘটনার স্মরণে, এই ‘সেভেন মাইল পন্ড’ বর্তমানে ‘বান্টিঙ লেক’ নামে পরিচিত।