১
আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহ। ধূসর মেঘ আকাশের মাঝামাঝি নীচু হয়ে ঝুলে রয়েছে। একটু আগেই ফুলবাগানের নার্সিংহোমে একটা অপারেশনে বক্সী স্যারকে সাহায্য করে বাড়ী ফিরেছি। জামাকাপড়, দরকারি কাগজপত্র, টুকিটাকি গোছানোই ছিল। দুটো বই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে স্নান করতে গেলাম। খেয়েদেয়ে মায়ের সাবধানবাণী, বাবার উপদেশ ইত্যাদি পেরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ট্রেন ধরতে। ভ্যান-রিক্সায় বারাসাত ষ্টেশন অবধি গিয়ে লোকাল ট্রেনে শিয়ালদা।
শিয়ালদায় পৌঁছে দুটো জিনিস হল। পকেটে খুচরো সত্তরটি টাকা ছিল, এটা ওটা কেনার জন্য। ষ্টেশনে নেমে আবিষ্কার করলাম যে সেটা কোনো এক মহাপুরুষ হস্তগত করেছেন। এসটিডি বুথ থেকে শুচিশ্মিতাকে কটকে ফোন করলাম এবং অবাক কান্ড, পেয়েও গেলাম! সেটা ১৯৯৯ সাল। মোবাইল ফোন সবে এই দেশে ল্যান্ড করেছে। আমাদের মত হোষ্টেলবাসীদের কাছে হোষ্টেলের সবেধন নীলমনি ল্যান্ডলাইনই ভরসা। ষ্টাইপেন্ডে দিন চালাই। খরচ বাঁচাতে তাই দু-মিনিটের কথা। ওর এমডি ফাইনালে নাকি কড়া এক্টারনাল এক্সামিনার আসছে। সঙ্গে আমার এই সরকারী চাকরীর অগস্ত্যযাত্রা। দু-য়ে মিলিয়ে সে খুব চিন্তিত।
এক কাপ চা খেয়ে উঠে পড়লাম তিস্তা-তোর্ষা এক্সপ্রেসে। শেষ মুহুর্তে আর কোনো ট্রেনের কনফার্মড টিকিট জোটেনি। আশেপাশে লোকজন কম। একে তিস্তা-তোর্ষার উপর লোকের ভরসা নেই। তারপর বর্ষাকাল। তাই ট্যুরিষ্টের ভীড় কম। এই ট্রেন নিজের খেয়ালে চলে। কখন পৌঁছবে তা কেউই জানে না। আমার অবশ্য কোনো তাড়াহুড়ো নেই। অজ্ঞাতবাসে যেতে কার আর তাড়া থাকে!
এম এস অর্থোপেডিকসের থিয়োরি পরীক্ষা দিয়েই সরকার বাহাদুরের চিঠির প্রাপ্তিযোগ হয়েছিল। মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয় খুশী হয়ে আমায় তৎকালীন দার্জিলিং জেলার কালিম্পং মহকুমার সামতাহার নামক স্থানে চাকরীতে নিয়োজিত করেছিলেন। মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়াররা, কলকাতায় আমার কোনো পরিচিত মানুষ, এমনকি স্বাস্থ্য দপ্তরের কেউই ‘সামতাহার’ নামের জায়গাটা ঠিক কোথায় এবং কেমনভাবে সেখানে পৌঁছতে হবে সে ব্যপারে বিন্দুমাত্র আলোকপাত করতে পারল না। সবাই নাকি এমন জায়গার নাম জীবনে প্রথম শুনল। এমনকি, এই হতভাগ্য গিয়ে কোন সৌভাগ্যবানকে রিলিজ করবে- তাও বোঝা গেল না।
প্রথম প্রজন্মের ডাক্তার, এই আমি, কিন্তু হাল ছাড়িনি। ততদিনে এম এস পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। বরাতজোরে পাশ করে গেছি। এমনকি সেই মাগ্গিগন্ডার বাজারে এক টুকরো সোনাও বগলদাবা করে ফেলেছি। কিন্তু প্র্যাকটিস করে কিছু করে উঠতে পারব- এমন আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে না পারায় সরকারি চাকরির খোঁজে সেদিন ভুষুন্ডি মাঠের ওপারে অজ্ঞাতবাসে চলেছিলাম।
ভোর ভোর নেমে পড়া গেল এনজেপি ষ্টেশনে। সেখান থেকে এক কাপ চা খেয়ে রিকশা নিয়ে শিলিগুড়ির বিখ্যাত জ্যাম পেরিয়ে তেনজিং নোরগে বাসষ্ট্যান্ড। দার্জিলিংয়ের বাসের টিকিট কেটে গোটা ছয়েক লুচি আলুর দম সহযোগে ধ্বংস করতে উদ্যত হলাম।
আকাশটা ভারী হয়ে আছে। জানলার ধারে বসে আছি। হু হু করে বাস চলেছে শুকনার চা বাগান আর পাহাড়ি জঙ্গলের গা ঘেঁষে। মাঝে বৃষ্টি নামল অনাবিল ধারায়। বৃষ্টির জল ঝর্ণা হয়ে পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে। পাশের জঙ্গলের সবুজ পাতাগুলো বৃষ্টি আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে এক মায়াবী জগত সৃষ্টি করে রেখেছে।
তিনধারিয়া, গয়াবাড়ি, কার্শিয়াং, টুং পেরিয়ে বাস হঠাৎ থেমে গেল সোনাদা-র আগে। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, সামনে অসংখ্য গাড়ির লম্বা লাইন। আগে নাকি ধ্বস নেমেছে রাস্তায়। আর এগনোর কোনো উপায় নেই। বাধ্য হয়ে একহাতে সার্টিফিকেটগুলো সামলে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়া গেল বাস থেকে।
(ক্রমশঃ)
বাঃ
এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। বাকিটা কবে পাব?