কুকুর ৪১০-এর উপর পরীক্ষা প্রাথমিক একটা ধাক্কা খেলেও, বান্টিঙ আর বেস্ট কিন্তু মোটেও মুষড়ে পড়েন নি সেভাবে। কমে তো ছিল, ৪১০-এর সুগারের মাত্রা কমে তো ছিল। এটাই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এটাই তাঁদের আশার আলো। সেই আশায় বুক বাঁধলেন নাছোড় বান্টিঙ ও বেস্ট। ৪১০-এর উপর পরীক্ষা প্রসঙ্গে বেস্ট পরে লিখেছেন, “এই নির্যাস প্রাণীর ব্লাড সুগার ও মূত্রের সুগারের সামান্যই অনুকূলে এলো। এই পরীক্ষা আদৌ অকাট্য ছিল না, তবে আমাদের কাছে চূড়ান্ত উৎসাহের ছিল এবং শীঘ্রই [সেই পরীক্ষার] পুনরাবৃত্তি হলো”।
দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবার পরীক্ষায় নামলেন বান্টিঙ আর বেস্ট। ৪ঠা অগস্ট ১৯২১, কুকুর নম্বর ৪০৮-এর প্যানক্রিয়াস কেটে নিলেন তাঁরা। প্যানক্রিয়াস না থাকায় দু’দিনের মধ্যেই ডায়াবিটিস ধরা পড়ল ৪০৮-এর। ৬ই অগস্ট ১৯২১, আজই ৪০৮-এর উপর ইতিপূর্বে প্রস্তুত করে রাখা ‘প্যানক্রিয়াস নির্যাস’ প্রয়োগ করতে চান বান্টিঙ ও বেস্ট। তবে নিজেদের তৈরি ওষুধকে আর ‘প্যানক্রিয়াস নির্যাস’ নামে ডাকতে চান না তাঁরা। ‘প্যানক্রিয়াস নির্যাস’-এর নতুন নাম স্থির করলেন বান্টিঙ। আইলেটিন। হ্যাঁ, এবার থেকে আইলেটিন নামেই ডাকবেন এই নির্যাসকে। বান্টিঙ ও বেস্ট ঠিক করলেন আজ রাতেই ৪০৮-কে আইলেটিন ইঞ্জেকশন দেবেন তাঁরা।
রাত ১২টা, অর্থাৎ হিসাব মতো দিনটা হলো ৭ই অগস্ট। কুকুর ৪০৮-এর ব্লাড সুগার মাপা হলো। দেখা গেল রাত ১২টায় ৪০৮এর ব্লাড সুগারের মাত্রা ০.৪৩। গত পরীক্ষায়, ৪১০ নম্বর কুকুরকে ৫ সিসি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল। সেই ইঞ্জেকশনে বিশেষ কাজ হয় নি সেবার। বান্টিঙ আর বেস্টের অভিজ্ঞতা বলছে, এবার আর ৫ সিসি নয়, এবার ৮ সিসি আইলেটিন দেওয়া প্রয়োজন ৪০৮-কে। সেই মতো ৮ সিসি ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো ৪০৮-কে। দেখা যাক ৪০৮-এর ব্লাড সুগার এবার কমে কিনা। ইঞ্জেকশনটা রক্তে মিশে কাজ করতে শুরু করুক, তারপর মাপা হবে ব্লাড সুগার। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাঁদের। রাত জেগে অপেক্ষা করছেন বান্টিঙ আর বেস্ট। ঘড়ির কাঁটা ঘুড়তে ঘুড়তে রাত ১টায় পৌঁছাল। এবার দেখা যাক ৪০৮-এর ব্লাড সুগার কত দাঁড়ালো। ৪০৮-এর ব্লাড সুগার মাপলেন বেস্ট। কমেছে! সুগার কমেছে! ৪০৮-এর ব্লাড সুগার এখন ০.৩৭। অর্থাৎ, ০.০৬ একক সুগার কমেছে ৪০৮-এর! আনন্দে আত্মহারা বান্টিঙ আর বেস্ট। কাজ হয়েছে, তাঁদের আইলেটিনে কাজ হয়েছে। এখন দেখতে হবে সুস্থ থাকে কি না ৪০৮। চরম উৎকণ্ঠায় রাত কাটছে তাঁদের। ৪০৮ সুস্থ আছে তো? মনে মনে ভেবে চলেছেন বান্টিঙ। রাত ২টো, ফের কুকুর ৪০৮-এর ব্লাড সুগার মাপলেন বেস্ট। এবার ব্লাড সুগারের পরিমাণ ০.৩৩। আগের থেকে ০.০৪ পরিমাণ কমেছে ব্লাড সুগার। চাপা হাসি নিয়ে একে অপরের দিকে চাইলেন বান্টিঙ আর বেস্ট। সাফল্য! সাফল্য দেখতে পাচ্ছেন দুজনেই।
প্রথম সাফল্য। কুকুর ৪০৮-এর সাথে বেস্ট (বাঁদিকে) ও বান্টিঙ। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কনট ল্যাবের ছাদে। অগস্ট ১৯২১ সালের এই ছবিটা তুলেছেন, বেস্টের শ্যালক হেনরি ম্যাক্লাউড মাহোন। |
কিন্তু ৪১০ নম্বর কুকুরের অভিজ্ঞতার কথা মনে আছে বান্টিঙ-বেস্টের। দু’তিনবার ইঞ্জেকশন দিয়েও কোনো কাজ হয় নি সেবার। তাই অতিরিক্ত আনন্দ পাওয়ার মতো কিছুই ঘটে নি এখনও তাঁদের। এবার আর কোনো ঝুঁকি নিতে চান না তাঁরা। রাত ২টোর সময় ৪০৮কে আরো ৮ সিসি আইলেটিন ইঞ্জেকশন দিলেন বান্টিঙ। এইবারই আসল পরীক্ষা তাঁদের। দেখতে হবে এবার তাঁরা বাঁচাতে পারেন কী না কুকুরটাকে। উত্তেজনায় ঢিপ ঢিপ করছে তাঁদের বুক। অপেক্ষার রাত যেন কাটতেই চাইছে না আর। বাইরে তখন নিকষ আঁধার জড়িয়ে রয়েছে ঘুমন্ত শহরটাকে আর এদিকে কনট ল্যাবের এক কক্ষে বসে এক রাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন বান্টিঙ আর বেস্ট। নিস্তব্ধ রাতে টিক টিক শব্দ তুলে ঘুরে চলেছে ল্যাবের ঘড়িটা আর ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে বান্টিঙ আর বেস্টের হৃদস্পন্দন। উত্তেজনায় আজ ঘুম নেই তাঁদের চোখে। রাত ৩টে, মাপা হলো ৪০৮-এর ব্লাড সুগার। এবার ব্লাড সুগার দাঁড়িয়েছে ০.২৯। চরম উত্তেজনার মধ্যেও জয়ের হাসি চেপে রাখতে পারছেন না তাঁরা। কিন্তু না এখনই আনন্দে আত্মহারা হলে হবে না। আরো অপেক্ষা করতে হবে তাঁদের। দেখতে হবে শেষ পর্যন্ত কী আছে তাঁদের ভাগ্যে। সারা রাত জেগে রইলেন বান্টিঙ আর বেস্ট। অপলক ভাবে চেয়ে আছেন অচেতন ৪০৮-এর দিকে। ঠিক মতো শ্বাস চলছে তো কুকুরটার? কুকুরের বুকটা ঠিক মতো উঠা নামা করছে তো? কুকুর ৪০৮-এর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন তাঁরা। বাঁচবে তো কুকুরটা শেষ পর্যন্ত?
ভোর ৪টের সময় আবার মাপা হলো ৪০৮-এর ব্লাড সুগার। এবার আরো কমেছে সুগারের মাত্রা। এখন সুগার কমে দাঁড়িয়েছে ০.২১। ভোর ৪টের সময় আরো ৮ সিসি আইলেটিন দেওয়া হলো ৪০৮-কে। দেখা যাক, এবার কতো থাকে ৪০৮-এর সুগার। অধীর আগ্রহে ৪০৮-এর দিকে চেয়ে অপেক্ষা করছেন বান্টিঙ আর বেস্ট। ভোর ৫টা, ফের ব্লাড সুগার মাপা হলো ৪০৮-এর। এবার সুগার কমে দাঁড়াল ০.১৫। নিশ্চিত, হ্যাঁ নিশ্চিত ভাবে সফল আজ তাঁরা। খুশি আর ধরে রাখতে পারছেন না বান্টিঙ আর বেস্টের। সফল, সফল হয়েছেন তাঁরা, ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছেন তাঁরা। রাতের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে ফুটছে ভোরের আলো, বান্টিঙ আর বেস্টের সামনেও ভেসে উঠছে সাফল্যের এক নতুন দিগন্ত। তৃপ্ত, দারুণ তৃপ্ত আজ তাঁরা। এই তৃপ্তিকে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তাঁদের মুখের মৃদু হাসির রেখাই বলে দিচ্ছে কতটা তৃপ্ত আজ তাঁরা।
কিন্তু একি! আচমকাই তাঁদের চোখের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ৪০৮! ছুটে এলেন বান্টিঙ আর বেস্ট। তড়িঘড়ি পরীক্ষা করলেন ৪০৮-কে। নাহ্, নেই, প্রাণ নেই ৪০৮-এর দেহে। সাফল্যের খুশি নিমেষে হারিয়ে গেল ব্যর্থতার আঁধারে। ভোরের আলো যেন ফুটেও ফুটলো না তাঁদের জীবনে। থমথমে মুখে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। একরাশ ব্যর্থতা আর বেদনার বোঝা নিয়ে নত মস্তকে বসে রইলেন তাঁরা কুকুরটার পাশে। ল্যাবের মধ্যে তখন শ্মশানের স্তব্ধতা। সম্ভবত অতিরিক্ত মাত্রায় দেওয়া হয়ে গেছে আইলেটিন, মনে মনে বিশ্লেষণ করে চলেছেন বান্টিঙ। বিমর্ষ মনে উঠে দাঁড়ালেন বান্টিঙ আর বেস্ট। শূন্য দৃষ্টিতে ল্যাবের চেয়ারেই বসে রইলেন তাঁরা। চুপচাপ। কেউ কারও সাথে কথা বলছেন না। ভীষণ হতাশ লাগছে এখন তাঁদের। ব্যর্থতার বোঝা আর রাত জাগার ক্লান্তিতে কখন যে ঘুম জড়িয়ে এলো দু’জনের চোখে তা কেউ জানে না। ল্যাবেই ঘুমিয়ে পড়লেন দুজনে। সকাল হলো। হাতটা কেমন ভিজে ভিজে মনে হচ্ছে ঘুমন্ত বান্টিঙের। মনে হলো কে যেন হাতটা চেটে দিচ্ছে তাঁর। চোখ মেলে বান্টিঙ দেখেন কুকুর নম্বর ৪০৮! ৪০৮ বেঁচে আছে! ৪০৮ তাঁর হাত চেটে দিয়ে আদর করে ডাকছে তাঁকে! ‘চার্লি, চার্লি’, চেঁচিয়ে ওঠেন বান্টিঙ [বেস্টকে চার্লি নামে ডাকতেন বান্টিঙ]। চার্লি উঠে দেখেন ৪০৮ জীবিত! তার মানে ভোরবেলায় সুগার কমে গিয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল ৪০৮!
“উই গট ইট” খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলেন বান্টিঙ। খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠলেন বান্টিঙ আর বেস্ট। তাঁদের সমস্ত পরিশ্রম, পরিকল্পনা সফল আজ। সফল, নিশ্চিত ভাবে সফল তাঁরা। পেরেছেন, পেরেছেন তাঁরা, ডায়াবিটিসের ওষুধ আবিষ্কার করতে পেরেছেন তাঁরা।
(চলবে)