একুশে জুন আমরা চিকিৎসা শিবির করে এলাম উত্তর চব্বিশ পরগনার মিনাখাঁর নিকটবর্তী গোয়ালদহ গ্রামে। আমরা অর্থাৎ শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ/ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সুজয় বালা, বিপ্লব সরকার, স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের পিয়ালী দে বিশ্বাস আর এম সি ডি এস-এর আপন সামন্ত। আর আমি শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম–এই তিনটে সংগঠনেই আছি। শিবিরের আয়োজন করেছিল সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন গার্ডেনরীচ প্রয়াসের স্বেচ্ছাসেবীরা।
গোয়ালদহ কৃষি প্রধান একটা গ্রাম, যার অনেক কৃষিজমি মাছ চাষের ভেড়িতে পরিণত হয়েছে অনেক বছর আগেই। ভেড়ির লবণাক্ত জল পাশের চাষের জমিকে নষ্ট করে। তাই কর্মহীন হন খেতমজুর আর ছোট চাষী।
বছর কুড়ি আগে থেকেই গ্রামের মানুষ কাজের খোঁজে মূলত বর্ধমানের পাথর খাদানগুলোতে কাজে যেতেন। কাজে যাওয়া বাড়ে 2009 এর আয়লা ঝড়ের পরে। পাথর খাদানে কাজ করে পয়সা পাওয়া যেত স্থানীয় মজুরির চেয়ে বেশি। সেই পয়সায় ঘর পাকা হয়। কিন্তু অল্প কয়েক বছর পর থেকেই শ্রমিকরা ঘরে ফিরতে থাকেন শ্বাসকষ্টের রোগ নিয়ে–সিলিকোসিস।
বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা থেকে যে রোগগুলো হয় তার অন্যতম সিলিকোসিস। সিলিকোসিস হয় পাথর খাদানে, ক্রাশারে, ইঁটভাটায়, নির্মাণ কাজে… যে ধূলিকণাগুলো নাকের লোমে আটকায় না, শ্বাসনালীর ঝাঁটা যাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারেনা, সেই সূক্ষাতিসূক্ষ ধূলিকণা ফুসফুসের হাওয়ার থলিতে গিয়ে ঘা তৈরি করে, ঘা যখন শুকোয় তখন হাওয়ার থলির দেওয়াল থেকে অক্সিজেন এপার ওপার করতে পারে না। তাই শ্বাসকষ্ট। এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই। হাঁপানির ওষুধে প্রথম অবস্থায় কিছুটা রিলিফ পাওয়া যায়। কেবল ওইটুকুই।
গোয়ালদহে দুই শতাধিক মানুষ পাথর খাদানে কাজে গেছিলেন। এখনো অব্দি সিলিকোসিসে মৃত 25 জন।
সিলিকোসিসের পাশাপাশি আমপানেও ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে গোয়ালদহে। প্রচুর গাছ ভেঙে পড়েছে, ঘর ভেঙেছে, উড়ে গেছে ঘরের চাল। তাই আমাদের চিকিৎসা শিবির।
উড়িষ্যার সুপার সাইক্লোন, বাংলার বন্যা বা আয়লার সময়কার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমপান-পরবর্তী চিকিৎসা শিবিরের অভিজ্ঞতা মিলছে না। ডাইরিয়াল ডিজিজ প্রায় পাচ্ছিনা, ওআরএস-এর প্যাকেট না খোলা থেকে যাচ্ছে, ব্যবহার করা যাচ্ছে না সিপ্রোফ্লক্সাসিন, সেফিক্সিম বা এজিথ্রোমাইসিন। সংক্রামক রোগ বলতে দাদ হাজা আর স্কেবিজ ইম্পেটিগো। বেশিরভাগ রোগী লকডাউনের রোগী অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী কোন রোগের রোগী যারা লকডাউনের কারণে সরকারি-বেসরকারি কোন চিকিৎসা পরিষেবাই পাচ্ছেন না। এদের মধ্যে বেশিরভাগ হলেন উচ্চ রক্তচাপের রোগী, ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগী, আছে স্ট্রোক, বিভিন্ন ধরনের আর্থ্রাইটিস, ইশ্চেমিক হার্ট ডিসিজ, ইত্যাদিও। আর গোয়ালদহে তার সঙ্গে সিলিকোসিস, সিলিকোসিস আর সিলিকোসিস…
আমাদের প্রস্তুতি ছিল, তাই সালবুটামল ট্যাবলেট, ডেরিফাইলিন রিটার্ড ট্যাবলেট, সালবুটামল ইনহেলার পর্যাপ্ত পরিমাণে সঙ্গে ছিল। কাজেও লাগলো।
সংক্রামক রোগের মধ্যে চর্ম রোগের কথা আগেই বলেছি। খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল আমাদের মাইকোনাজোল মলম, বেনজাইল বেনজোয়েট লোশনের স্টক। বাচ্চাদের মধ্যে কৃমি সংক্রমণ ছিল দেখবার মতো, শেষের দিকে অ্যালবেনডাজলও দেওয়া গেল না। মনে হচ্ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এসব রোগের কারণ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব অর্থনৈতিক কারণে নাকি শিক্ষার অভাবে–বুঝতে পারিনি।
মহিলারা অনেকে এলেন সাদা স্রাবের সমস্যা নিয়ে। পুকুরে কোমর ডুবিয়ে স্নান করা, মেনস্ট্রুয়াল হাইজিনের অভাব এসবই বোধহয় কারণ। কলকাতার এক মহিলা চিকিৎসাত্রাণে বিতরণ করার জন্য বেশ কিছু স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়েছিলেন। সেগুলোও ফুরিয়ে গেল।
আমরা রোগী দেখেছিলাম নাম লেখা হয়েছে এমন 211 জন। ওষুধ ফুরিয়ে আসছে, সময় শেষ, যখন গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে সব, তারপরেও দেখতে হলো আরো জনা পঁচিশেককে।
গোয়ালদহ থেকে ফিরে এসেছি আবার যাওয়ার ভাবনা নিয়ে। স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ সিলিকোসিস নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে বছর খানেক ধরে। উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং বীরভূমে সিলিকোসিস নিয়ে গবেষণাধর্মী মডেল কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে শ্রমদপ্তরের কাছে। তিনটি সংগঠনই আছে সিলিকোসিস ও অন্য পেশাগত রোগ বিরোধী কোঅর্ডিনেশন কমিটিতে।