-এ মা ! তুমি টি শার্ট পরে আছো কেনো?
রাতুলের রিনরিনে গলার খিল খিল হাসি যেন একটা পাহাড়ি ঝর্ণার মত উপচে বেড়িয়ে এলো কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে! আর সে হাসির ছোঁয়াচ লেগে গেলো আমার পেশাদারিত্বের মুখোশ পরা আপাত গোমড়া মুখেও!
কোনো মতে মুখ থেকে সেই হাসির গুঁড়ো মুছে নিয়ে বললাম -কেন? তাতে কি হয়েছে?
-তুমি তো ডাক্তার! তুমি তো জামা পরো, টাই পরো, আমি জানি, আমি দেখেছি!
-ডাক্তারবাবু নমস্কার, ভালো আছেন? সরি কিছু মনে করবেন না!
রাতুলের মা এলেন এবার স্ক্রিনে।
ওঁদের আমি চিনি। রাতুলের বাঁ চোখের নিচে একটা সাদা দাগ হয়েছিল, সেটার জন্য ওঁরা আসতেন আমার কাছে।
-না না মনে করার কি আছে? আপনারা ঠিক আছেন তো?
-হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, আমরা ঠিক আছি, আমাদের এদিকে এখনো ওসব হয় নি, কিন্তু ছেলেটার স্কুল বন্ধ, সারাদিন বাড়িতে ওর দস্যিপানা আর বলবেন না! ওর বাবার অফিস তো খুলে গেছে, ট্রেন নেই, তাও কষ্ট করে যেতেই হচ্ছে, আমি একা আর পেরে উঠছি না! কবে যে সব খুলবে!
একটা কোকিলের অস্পষ্ট ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম মা-ছেলের কথার মাঝে মাঝে !
বর্ষাকাল, তবুও কোকিল ডাকছে! আশ্চর্য!
রাতুল আর ওর মা’র মত এইরকম বহু মানুষের সঙ্গে দৈনন্দিন আমাদের দেখা হয়, কথা হয়, চিকিৎসার প্রয়োজনেই।
একতরফা দূর-দর্শন নয়!
ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভার্চুয়াল দ্বিপাক্ষিক আলাপচারিতা!
টেলিমেডিসিন ব্যাপারটা যে খুব নতুন তা নয়, তবে প্রথম দিকে সেটা সীমাবদ্ধ ছিল উন্নত দেশেই অথবা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলির উদ্যোগে পৃথিবীর কিছু প্রত্যন্ত প্রান্তে বা কিছু কর্পোরেট হাসপাতালের রোগীদের জন্য!
খুব সম্প্রতি ব্যাপারটার আমূল পরিবর্তন হয়েছে আমাদের দেশে!
বিশেষ করে এই লকডাউনের সময়!
আরো নিখুঁত ভাবে বললে এই 2020 সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে!
যেদিন থেকে সরকারি এবং আইনি শীলমোহর পড়লো এই ভার্চুয়াল ডাক্তারখানায়!
কোভিডের জন্য আর পাঁচটা অসুখ তো আর উবে যায় নি!
মানুষের ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, ক্যান্সার, সোরিয়াসিস, শ্বেতী, হাইপারটেনশন, মানসিক অসুখ, আর্থ্রাইটিস, দাদ, হাজা, চুলকানি, ব্রণ, চুল উঠে যাওয়া, কিডনির সমস্যা, লিভারের অসুখ এই সবগুলি কিন্তু রয়েই গেছে!
বরং লকডাউনের কারণে হাসপাতালে, ডাক্তারখানায় না যেতে পেরে, নিয়মিত চিকিৎসার অভাবে এর অনেকগুলিই জটিল আকার নিচ্ছে!
এই পরিস্থিতিতে আশীর্বাদের মত কাজ করছে টেলিমেডিসিন!
নিজের বাড়িতে বসেই রোগাক্রান্ত মানুষটি সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছেন চিকিৎসকের সামনে!
তাঁরা যে সবাই শহরের মানুষ তা কিন্তু নন!
ময়নাগুড়ি, রায়গঞ্জ, হিলি, কান্দি, আমোদপুর, আদ্রা, ঝাড়গ্রাম, ঘাটাল, সোনামুখী, হিঙ্গলগঞ্জ, পূর্বস্থলী, বাদু, গোবরডাঙ্গা, ক্যানিং…
এমনকি অন্য রাজ্য থেকেও
পুনে, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ,ব্যাঙ্গালুরু, সুদূর রাজস্থানের ঝুনুঝুনু থেকেও মানুষ চলে আসছেন কম্পিউটার স্ক্রিনে!
সবাই যে এই ভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত তা নন, কিন্তু শিখে নিচ্ছেন চটপট!
আগের প্রেসক্রিপশন, রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট বা আক্রান্ত অংশের চমৎকার ছবি আপলোড করতে তাঁদের আর ভুল হচ্ছে না!
মহামারীর বিপদ এড়িয়ে ডাক্তারখানায় যাওয়ার ঝক্কি থাকছে না আর যাওয়া আসার খরচাটাও বেঁচে যাচ্ছে!
ফলে ক্রমেই বেড়ে চলেছে অনলাইন ডাক্তার দেখানোর জনপ্রিয়তা!
তবে সব সময়ে ব্যাপারটা এমন জলবৎতরলং নয়!
টেলিমেডিসিনে ডাক্তারবাবু রোগীর পালস বা ব্লাডপ্রেশার নিজে মাপতে পারেন না, নির্ভর করতে হয় রোগীর দেওয়া তথ্যের ওপর! জিভ, চোখ যে ঠিক ঠাক দেখা যায় তাও না!
রোগীকে ছুঁয়ে বা প্যালপেট করে দেখা যায় না, এমনকি স্টেথো দিয়েও দেখা যায় না!
আর নড়বড়ে নেট তো আছেই!
প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে একদিন হয়তো এ বাধাও অতিক্রম করা যাবে!
তবে ডার্মাটোলজি যেহেতু প্রধানত একটি ভিস্যুয়াল ডিসিপ্লিন বা দৃশ্যগ্রাহ্য বিষয় আর যেহেতু বেশির ভাগ অসুখ চোখে দেখেই নিশ্চিত ভাবে নির্ণয় করা যায়, সে জন্য টেলিডার্মাটোলজির সম্ভাবনা সীমাহীন!
যেখানে ডারমোস্কোপি বা বায়োপ্সি র প্রয়োজন সেসব ক্ষেত্রে রোগীকে ক্লিনিকে ডেকে নেওয়াই যায়!
অজস্র অসুস্থ মানুষ দূর দুরান্ত থেকে এসে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত , বিষণ্ণ এবং হয়তো বা বিরক্ত হয়ে যান।
সর্বশেষ সরকারি হিসেবে জানা যাচ্ছে ১৩৫ কোটির এই দেশে প্রতি ১৪৪৫ জন নাগরিক প্রতি মাত্র একজন চিকিৎসক! যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাপকাঠিতে আদৌ কাম্য নয়! বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই আরো অপ্রতুল!
সারা দেশে এই মুহুর্তে প্রায় ১১ হাজার নথিভুক্ত ত্বক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, আর তাঁদের সকলেই যে সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম তাও নয়!
অর্থাৎ প্রায় পনেরো হাজার দেশবাসী পিছু একজন ত্বক-চিকিৎসক!
ফলে যা হবার তাই হয়েছে!
দিন ঢলে পড়ে, অথচ অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না !
ক্ষুধার্থ, বিরক্ত,এবং স্বাভাবিক ভাবেই ক্রুদ্ধ রোগিনী বা তার পরিজন কিন্তু জানতেও পারেন না বন্ধ দরজার ওপারে চিকিৎসকটিরও খাওয়া হয় নি!
যে বৃদ্ধা, বা যে শিশুটি সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি অপেক্ষা করে সাড়ে তিন মিনিটের জন্য ক্লান্ত চিকিৎসকটিকে দর্শন করতে পারেন, কিংবা যে অশক্ত গ্রাম্য দম্পতি ফেরার ট্রেন মিস করে কি করে রাত্রে ক্যানিং, লক্ষীকান্তপুর, বারুইপুর, গাইঘাটা, হাসনাবাদ, রামপুরহাট বা কাঁথি ফিরবেন সেই ভাবনায় আকুল হয়ে যান, ভিন রাজ্যের যে মানুষটি রাতের চেম্বার থেকে বেরিয়ে কি ভাবে এই অচেনা শহরটির অন্য প্রান্তে তাঁর আধা-আত্মীয়ের বাড়ি পৌঁছাবেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না, তাঁদের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে যাই!
কিন্তু কিছু করতেও পারি না, মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করা ছাড়া!
চিকিৎসক হিসেবে আমার অসহায় ব্যাস্ততার বহুমাত্রিকতা কোনো রোগীর আরোগ্যের পথে যেন অন্তরায় না হয়, এতদিন এই কামনা করে এসেছি!
এখন টেলিমেডিসিনের এই ক্রমাগত বাড়তে থাকা গ্রহণযোগ্যতা একটা নতুন আশা জাগাচ্ছে!
চিকিৎসক আর রোগী দুপক্ষের কাছেই আশীর্বাদ
রোজ রোজ প্রযুক্তিনির্ভর এই নতুন মাধ্যমে ভর করে কত মানুষের ঘর গেরস্থালি ছুঁয়ে আসা হয়ে যাচ্ছে!
কাল গোসাবার তরুণ টি ওর তছনছ হয়ে যাওয়া বাগান থেকে কথা বলল, বাড়িতে নেট আসে না!
বললো, আম্ফানে বাড়ির টিনের চাল উড়ে গিয়েছিলো, আবার লাগানো হয়েছে।
রাতুলের গল্পটা কিন্তু শেষ হয় নি!
ওকে দেখার পালা শেষ হওয়ার সাথে সাথে মায়ের হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় লাগলো, মোবাইলে অনোন্যপায় ঝোঝুল্যমান আমি!
-লাইন ছাড়বে না কিন্তু! তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো!
হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি দিয়ে ছুটছে ছেলেটা!
-একটা না একটা না, দুটো জিনিস! দুটো!
এই দ্যাখো এটা প্রথম জিনিস!
বোধহয় চিলেকোঠা!
রাতুলের মোবাইল-বাহনে চড়ে অতখানি উঠে এসে আমারই তখন একটু হাঁফ ধরেছে!
আলো আঁধারিতে চোখ সয়ে গেলে দেখলাম তিনটে খুদে খুদে বেড়ালের বাচ্চা!
– আর একটা হয়েছিল, মরে গেছে!
দাঁড়াও আর একটা জিনিস দেখাবো!
আবার ছুট।
রাতুল এবার খোলা ছাতে!
আর ওর সঙ্গে সঙ্গে ওর মোবাইলে চড়ে,আমিও, অগত্যা!
কোকিলের ডাকটা এখানে আরো স্পষ্ট আর জোরালো!
-ওই দ্যাখো, দেখেছো? আম্ফানে সব আম পড়ে গেছে, শুধু একটা আছে! এই দ্যাখো!
দেখলাম,একটা ঝাঁকড়া গাছ,তাতে একটা কাটা ঘুড়ি আটকে আছে!
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রাতুলের মোবাইল ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে দিয়ে সেই আমফানজয়ী
আমটিকে ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না!
রাতুলের ফোনটা কেটে যাওযার সময় শুধু সেই কোকিলটার ডাক শোনা যাচ্ছিলো!
কোকিল সারাবছরই ডাকে, আমাদেরই শোনার সময় নেই শুধু!