ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যখন ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে নার্সিং-এর পাশাপাশির চিকিৎসাশাস্ত্রে পরিসংখ্যানতত্ত্বের ব্যবহারে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন, ঠিক তখনই খোদ লন্ডনের বুকে ঘটে চলেছে কলেরা মহামারী। অবশ্য কলেরা তখন নতুন নয়। ১৮৩১ সালে ব্রিটেনে প্রথম কলেরা মহামারী দেখা দিয়েছিল আর তার শিকার ছিল তেইশ হাজার মানুষ। ১৮৪৯ সালে আবার মহামারী, এবং মৃত্যু তিপান্ন হাজার।
তখনও পর্যন্ত চিকিৎসক মহলে ধারণা ছিল কলেরা বাতাসের মাধ্যমে কোনও অজানা বিষাক্ত গ্যাস হিসেবে ছড়ায় (মিয়াজমা তত্ত্ব)। ধাত্রীবিদ জন স্নো ১৮৪৯ সালের মহামারী খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেন, এবং তাঁর ধারণা হল, এই মিয়াজমা তত্ত্বের সঙ্গে কলেরার গতি-প্রকৃতি মিলছে না। জন স্নো ধাত্রীবিদ হলেও তাঁর তখনও পর্যন্ত বড় কাজ ছিল অ্যানাস্থেসিয়া বা অবেদন নিয়ে। তিনি স্বয়ং রাণী ভিক্টোরিয়ার ওপর ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করেছিলেন। কোনও গ্যাসীয় বিষাক্ত পদার্থ কেমন করে মানুষকে আক্রমণ করতে পারে সেটা তিনি ভালই বুঝতেন। কলেরা যদি গ্যাসীয় পদার্থ হিসেবেই মানুষের শরীরে ঢুকবে, তাহলে তা একটা এলাকার সমস্ত মানুষকে আক্রমণ করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটা এলাকাতে বেছে বেছে কিছু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, আর কিছু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন না। স্নো-র ধারণা হল, কলেরা হয়তো জলের মাধ্যমে বা নর্দমার মাধ্যমে ছড়ায়।
১৮৫৪ সালে লন্ডনে চলছে তৃতীয় কলেরা মহামারী। লন্ডনের সোহো অঞ্চলে জন স্নো তাঁর কাজ আরম্ভ করলেন। ক্যাম্ব্রিজ স্ট্রিট যেখানে ব্রড স্ট্রিটে মিশছে সেখানে দশদিনের মধ্যে ৫০০-জনের কলেরায় মৃত্যু হয়। স্নো লিখছেন, তিনি এটা শুনেই ভাবলেন যে ব্রড স্ট্রিটের জলের পাম্প এর উৎস হতে পারে।
ভাবলেন বটে, কিন্তু এটা প্রমাণ করবেন কী করে? সোহো অঞ্চলের একটি ম্যাপ নিয়ে, কলেরায় পাঁচশ’ মৃত্যুর প্রতিটিকে তিনি এই ম্যাপে একটি ছোট আয়তক্ষেত্র হিসেবে বসালেন। দেখা গেল যে পাম্পটিকে তিনি সন্দেহ করছিলেন, সেটা এই আয়তক্ষেত্রগুলির ঠিক মাঝখানে। তবে সেটাই চরম প্রমাণ নয়। একটা কফির দোকানের জল আসত ঐ পাম্প থেকে। সেখানে যারা কফি খেতে আসত তাদের ন’জনের কলেরায় মৃত্যু হয়, যদিও তাদের বাড়ি ছিল অন্য এলাকাতে। অন্যদিকে, ঐ অঞ্চলের মধ্যে একটা ছোটখাট ফ্যাক্টরিতে কোনও কর্মীর কলেরা হয়নি, এবং সেই ফ্যাক্টরির নিজস্ব পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল। আর একটা জোরালো প্রমাণ এল অন্য এক মহিলার মৃত্যুর ঘটনা থেকে। তিনি সোহো থেকে অনেক দূরে থাকতেন, কিন্তু ব্রড স্ট্রিটের ঐ পাম্পের জল তাঁর খুব প্রিয় ছিল বলে সেখান থেকে জল আনিয়ে খেতেন।
জন স্নো বেশ প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। তিনি লন্ডনের পুরকর্তাদের বোঝালেন, এবং তাঁর পরামর্শ অনুসারে ঐ জলের পাম্পটির হ্যান্ডেল খুলে রাখা হল যাতে কেউ আর ওখান থেকে জল না নিতে পারে। প্রায় ম্যাজিকের মতো ঐ অঞ্চল থেকে নতুন কলেরার খবর আসা বন্ধ হয়ে গেল। জলবাহী রোগের জন্য যে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেগুলো নেবার ফলে আস্তে আস্তে ১৮৬৬ সালে ব্রিটেনে কলেরা প্রায় উধাও হয়ে গেল।
জন স্নো ছিলেন প্রথম মহামারীবিদ (Epidemiologist)-দের মধ্যে অন্যতম। কেমন করে মহামারীর উৎস সন্ধান করতে হয়, পুরনো অপরীক্ষিত তত্ত্বকে কেমন করে পরীক্ষার সামনে ফেলতে হয়—এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি চিকিৎসাশাস্ত্রে যাদের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল, জন স্নো তাঁদের একজন।
বলা দরকার, এই জ্ঞান কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারতে প্রায় কোনও কাজেই আসেনি। কেবল রোগের উৎস জানলেই রোগ আটকানো সম্ভব নয়, সেই উৎসমূলে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেবার কাজটা করতে হয়। সেটা পরাধীন ভারতে করা হয়নি। স্বাধীন ভারতেও পুরো করা গিয়েছে এমন নয়।
চিত্র পরিচিতি
১) জন স্নো (চিত্রঋণঃ উইকিপিডিয়া)
২) জন স্নো-এর আঁকা সোহো অঞ্চলের ম্যাপ। ম্যাপের ওপর কালো ছোট আয়তক্ষেত্রের প্রতিটি হল এক-একটি কলেরাতে মৃত্যু। কিছু কিছু জায়গায় অনেকগুলি মৃত্যু ঘটেছে। (চিত্রঋণঃ উইকিপিডিয়া)
তথ্যসূত্র
১) Simon Singh & Edzard Ernst. Trick or Treatment? Corgi Books, 2008
২) David Arnold. Cholera: Disease as Disorder. in Colonizing the Body. University of California Press, 1993
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভালো থাকবেন।
আপনার ফোন নাম্বার টি পেলে ভালো হয়। মানুষ কে সঠিক লোকের কাছে পাঠানো যায় চিকিৎসা র জন্য।
Partha Das ধন্যবাদ নেবেন।
এখানে ডক্টর্স ডায়ালগ-এর নীতি হল, ব্যক্তি ডাক্তারের কোনোরকম বিজ্ঞাপন না করা।
সুতরাং ফোন নম্বর দিতে পারছি না, মার্জনা করবেন।
রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, এ দুটি বেসরকারি হলেও নন-প্রফিট সংস্থা, আমি বসি। কিন্তু আপাতত বন্ধ আছে আমার আউটডোর। রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানেরর চর্মরোগ বিভাগ খুললে আমাকে শুক্র শনি সকালে পাবেন।