ভুল করে এই ধারাবাহিকের তৃতীয় তথা শেষাংশ প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয়াংশের আগে। আজ তাই পরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ প্রকাশ করা হল।
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত উত্তর বঙ্গের এই শহরে কোভিড ১৯ এর প্রকোপ ছিলো সীমিত। এ শহরের প্রথম রোগী চেন্নাই থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফেরা এক ভদ্রমহিলা, বাঁচানো যায়নি তাঁকে। তাঁর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে প্রাণ কেড়ে নিলো তাঁর পাশের বিছানার ভদ্রলোকেরো। আক্রান্ত হলেন ঐ ভদ্রমহিলার পরিবারের এগারো জন সদস্য, দুটি শিশু সহ, তাদের গাড়ির চালক এবং গৃহভৃত্য মহিলা এবং হাসপাতালে ওনার চিকিৎসারতা দুই নার্স, এক নার্সের স্বামী, শিশুকন্যা ও শাশুড়ি। এনাদের চিকিৎসার ভার পরলো আমার উপরে। রোগী ও চিকিৎসক উভয়েরই সৌভাগ্যক্রমে কোভিড ১৯ এর করাল রূপ প্রকট হলো না এই রোগীদের মধ্যে। সকলকেই আমরা সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলাম। এরপরের দুই তিন সপ্তাহ বেশি লোক আক্রান্ত হলো না। তারপর মানুষ জন লক ডাউনকে আর পাত্তা দিতে লাগলো না। ট্রেন বোঝাই হয়ে ফিরতে লাগলো ভিন রাজ্য থেকে মানুষরা। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো আক্রান্তের সংখ্যা গুণোত্তর প্রগতিতে।
এই লড়াই এ আমাদের শস্ত্র বিষয়ে শিখতে হলো আমাদের। সারা শরীর বস্তায় (পি পি ই) ঢেকে ঝাড়া ছয় ঘণ্টা রোগী দেখা। না জল খাওয়া যাবে, না বাথরুম যাওয়া। কাজ শেষে বস্তা খুললে সারা শরীরের জমে থাকা ঘাম কুলকুল করে বইতে শুরু করে। এই ভাবেই চললো লড়াই। কোভিড ১৯ এর মারণ রূপ ও প্রত্যক্ষ্য করলাম। কেমন সে অভিজ্ঞতা? ধরুন আপনার সামনে একটি মানুষকে জলে ডুবতে দেখছেন, অথচ আপনি সাঁতার জানেন না। দূর থেকে কাঠের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। সামনে গেলেও বিপদ, মানুষটি তখন আপনাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচার শেষ চেষ্টা করবে এবং ডোবাবে আপনাকেও।
করোনার গ্রাসে
করোনা সাগরে সাঁতার শেখার চেষ্টা চালাতে লাগলাম পুরোদমে। চীন, ইটালি, ইংল্যান্ড, মার্কিন মুলুকের চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা পড়তে থাকলাম। তার উপরে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই-এর চিকিৎসকদের টিপ্পণী। প্রথম দিকে তো বাঁশবনে ডোম কানা দশা। লাখো তথ্যের ভিড়ে জ্ঞান কোথায়? অপবিজ্ঞানের আড়ালে বিজ্ঞান কতোটা? পড়তে পড়তে আলোচনা চলতে লাগলো। কিছু কিছু রোগী সেরে উঠতে লাগলেন, কয়েকজনকে কোনভাবেই বাঁচানো গেলো না। এর মধ্যেই হাসপাতালের আরও দুই সহকর্মী চিকিৎসকের সঙ্গে আমি নিজেও পরলাম করোনার খপ্পরে।
লক্ষ্মণ জানা থাকায় প্রথম মওকাতেই ওষুধ খাওয়া শুরু করে দিলাম, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই। পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে ভর্তি হতে হলো হাসপাতালে। সি টি স্ক্যান ছবিতে ফুসফুসে ছোপ পড়ায় পাঁচ দিন স্টেরয়েড ইনজেকশন ফুঁড়তে হলো শিরায়। তিন দিনের মাথাতেই করোনা পালালো আমাকে ছেড়ে। মোট বারো দিন ভুগিয়ে আট দিন হাসপাতালে রেখে মুক্তি দিলো আমাকে। সঙ্গে ভয় আর আশঙ্কা থেকেও মুক্তি এবং পরবর্তী রোগীদের চিকিৎসায় কাজে লাগানো যাবে এমন দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
কিছু অভিজ্ঞতা সবাইকে জানানো প্রয়োজন
১) ঘন ঘন নিয়ম মেনে কুড়ি সেকেন্ড ধরে হাতের প্রতিটি জায়গা সাবান দিয়ে ভালো ভাবে ধোয়া এবং নাক ও মুখ আঁটোসাঁটো ভাবে ঢেকে মুখোশ পরার কোনো বিকল্প নেই।
২) ভিড়, বাজার, সামাজিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক জমায়েত থেকে দূরে থাকুন।
৩) আক্রান্ত রোগী, এবং তাঁদের চিকিৎসারত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, পুলিশ কর্মী, পরিবহন কর্মী– এঁদের যথোপযুক্ত সামাজিক মর্যাদা দিন। সকলকেই এঁদের মুখাপেক্ষী হতে হয়, আপনাকেও হবে।
৪) করোনা রোগের লক্ষ্মণ প্রকট হলে তা কখনোই গোপন করবেন না। যতো দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। পরীক্ষা করান (নাক ও মুখের নিঃসরণ, যা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংগ্রহ করতে হয়, লালা বা থুথু নয়), রিপোর্ট পজিটিভ এলে ভেঙে না পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, বেশির ভাগ মানুষ বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছেন।
৫) সব মানুষের দেহ সমান নয়, এই ভাইরাসের আচরণও সবার ক্ষেত্রে এক নয়। কখন বুঝবেন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, তখন কোথায় ভর্তি হবেন, কিভাবে যাবেন সেই বিষয়ে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে আগাম পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পনা করে রাখুন ও আপনার নিকটাত্মীয়দের সেই রকম নির্দেশ দিয়ে রাখুন।
৬) করোনা থেকে সেরে উঠেছেন, অভিনন্দন। আরও লক্ষ মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে আপনার রক্তরস (প্লাজমা) দান করুন, সেরে উঠবার একমাস পরে।