এই গল্পটি ১৯৩৮ সালের! মানে আজ থেকে প্রায় তিরাশি বছর আগেকার ।
ব্রিটেনের একজন নাট্যাকার ছিলেন প্যাট্রিক হ্যামিল্টন। তিনি হঠাৎ একটি নাটক লিখে বসলেন। ব্রিটেন বলেই হয়তো তখনকার দিনে অদ্ভুত সব জিনিস নিয়ে নাট্যকাররা ভাবতেন!
এখানে পুরো নাটক তো আর লেখা যাবে না। সংক্ষেপে গল্পটা বলি।
স্বামী স্ত্রী থাকেন একসঙ্গে। স্ত্রী প্রায় নির্বিবাদী। স্বামীই তার ধ্যান জ্ঞান। হয়তো মৌলিক চাহিদা তথা অন্যান্য সব চাহিদা মেটানোর জন্য একমাত্র স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিলেন।.আবেগ অনুভূতি চাওয়া পাওয়া- সব স্বামীকে ঘিরে।এহেন স্ত্রী আজকালকার দিনেও দুষ্প্রাপ্য নয়। অস্বাভাবিকও নয়।
উল্টোদিকে স্বামীটি চুড়ান্ত ধূর্ত, অপরাধী। অবশ্যই ভাষণে ও অভিনয়ে ছিল চুড়ান্ত পারদর্শিতা!.নিরীহ স্ত্রীকে বশে রাখা তাঁর এক চুটকির কাজ!
এহেন স্বামীরত্নটি একজন মহিলাকে খুন করেন। এবং সেই মহিলার বাড়িতেই নিরীহ এই স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। খুনের উদ্দেশ্য- ওই বাড়িতে সেই মহিলার লুকানো ধনসম্পত্তি হাতানো।
কিন্ত স্ত্রী যতই নিরীহ হোক, স্বামীর এহেন অপরাধ কোনকালেই কেউ মানে না । আর বেশি নিরীহ হলে এই ভয় আরো বেশি। বলা যায় না কি থেকে কি করে বসবে।
স্বামী সেটি বুঝতে পারে। অথচ, জোর করে বলে মানতে বাধ্যও করা যাবে না। স্বামী পড়লো মহা ঝামেলায়! বউ সঙ্গে থাকলে সেই লুকানো সম্পত্তির খোঁজ করা যায় না। আবার এতো ভালো বউকে অকারণে তাড়ানোও যায় না!! ধূর্ত স্বামীদের নিরীহ গোবেচারা স্বামীসোহাগী স্ত্রী হলে এ এক মহা সমস্যা। না ডিভোর্স দিতে পারে, না সহ্য করতে পারে।
স্বামীদেবতাটি শুরু করলো মগজের খেলা। খেলাটি অদ্ভুত।
তখনকার দিনে ব্রিটেনে গ্যাস লাইট জ্বলতো ঘরে ঘরে । তার একটা চাবি থাকতো, যা দিয়ে গ্যাসের কম বেশি করে আলোর পরিমাণ ঠিক করা যেত। আমাদের দেশেও নাকি ছিল এমন গ্যাস বাতি। তো স্বামীটি কি করলো? আসছি সে গল্পে।
প্রথমতঃ স্ত্রীর মনে এটা ওটা নিয়ে কনফিউশন তৈরি করতে শুরু করলো। যেমন ধরা যাক, বাইরে কোকিল ডাকছে। স্বামী বললো- আরে ওটা তো ডাহুক! ধরা যাক, তরকারিতে ঝাল নুন বেশি হলো। স্বামী বললো – আরে এতো মিষ্টি , খেতে পারছি না! ধরা যাক, ঘরের সোফাটা ডান থেকে বাম দিকে ঘুরিয়ে রেখে দিয়ে বললো, এটা অনেক দিন ধরেই এমন আছে!! তুমি দেখোনি?
এই নিখুঁত অভিনয়ের সাথে সাথে মিষ্টি মুখে এটাও বলতে ভুললো না – ওহ মাই ডিয়ার বেবি, তোমার মাথায় বোধহয় কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে! ডাক্তার দেখানো দরকার। তুমি কোকিলের ডাক ভুল শুনছো, তুমি খাবারের টেস্ট ভুলে গেছ, তুমি ঘরের জিনিসপত্রের দিকে অব্দি খেয়াল রাখতে পারছো না!!!
এবার বেচারী স্ত্রী কিছুতেই বুঝতে পারছে না যে – আসলে কি হচ্ছে! সে কিছু গোলমাল হলেই প্রশ্ন করছে। আর এরকম প্রত্যেকটি সহজ সাধারণ ঘটনায় স্বামী যা বলছে, সেটি যে কেন মিথ্যা হতে যাবে, এটাই সে ভেবে পায় না! অতএব, স্ত্রীর মনে ক্রমশঃ টক ঝাল নুন, কোকিল ডাহুক, চেয়ার টেবিল উল্টো এইসব জিনিসগুলো নিয়ে নিজের এতোদিন কার আত্মবিশ্বাস চুরমার হয়ে যেতে থাকে! সে আয়নায় তাকিয়ে ভাবে, প্রেমে পাগল বুদ্ধিমান স্বামী নিশ্চিত তাঁর মাথার গণ্ডগোলটা ঠিকই বুঝতে পারছে!! হয়তো ভালোর জন্যই জিনিসগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে!! ক্রমশঃ সে স্বামীর কথায় বিশ্বাস করতে থাকে।
স্বামীটি এই সুযোগে কি করছে? একবারে সব উল্টেপাল্টে দিলে ধরা পড়বেই! তাই একটু একটু পাল্টায় স্ত্রীর ধারণা, আর একটু একটু করে ঘরের কোনায় কোনায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে খুন হওয়া মহিলার সম্পত্তি! কিন্ত সমস্যা বাঁধলো গ্যাস লাইট নিয়ে। ওটি জ্বলতে থাকলে তো আর বউয়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না!!
হঠাৎ স্বামী একটা আলমারি সরিয়ে দিচ্ছে, এটা সবাই বোঝে! তাই সে প্রতিদিন গ্যাস লাইট জ্বললেই একটু একটু করে আলো কমিয়ে দিতে থাকে। স্ত্রীকে বোঝায় – আলো কমছে না তো! তোমার মাথায় কম আলো নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে! যেমন হচ্ছে – টক ঝাল নুন চেয়ার টেবিল সোফা কোকিলের ডাক ইত্যাদি নিয়ে!!
কম আলোতে স্বামী খুঁজতে থাকে। সেখানে শব্দ হয়, সে নিজের সাথে কথা বলে। আর স্ত্রীকে বলে – এই গুলো বাস্তব নয়! বিভ্রম।
স্ত্রী ঘরের কোনে বসে ভাবে – তাঁর সত্যিই অসুখ করেছে! সে শব্দ, আলোও বুঝতে পারছে না আজকাল!!!
একদিন তো স্ত্রীকে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মানসিক রোগীদের হাসপাতালেই ভর্তি করে দিল! এবং পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি করে তার সম্পত্তিও হাতিয়ে নিল!!! সুস্থ স্ত্রী বেচারী পড়ে রইলো হাসপাতালে। সব দিনের জন্য!!
****
এই রে, এতোক্ষণ ডাক্তারির গল্প বলবো বলে, অন্য গল্প বলে ফেললাম। যাকগে, এবার সংক্ষেপে বলি।
উপরের এই নাটকের নাম থেকেই এসেছে ডাক্তারির একটি শিক্ষা । যাকে সাইকিয়াট্রির ভাষায় বলে গ্যাস লাইটিং এফেক্ট!! মোদ্দাকথা হলো, সুস্থ মানুষকে সাইকোলজিক্যালি ম্যানিপুলেশন করার জন্য একটি মারাত্মক অস্ত্র। মানে চাইলেই, সুস্থ সবল সুন্দর চিন্তা ভাবনার অধিকারী মানুষকে আস্তে আস্তে তার আত্মবিশ্বাসকে চুরমার করে দিয়ে রিয়েলিটিকে মিথ্যা বা ডিলিউশন বলে চালিয়ে দেয়া যায়!! এমনকি পুরানো আমলের একটি অর্ধসত্য বা মিথ্যাকেও সত্য বলে চালিয়ে দেয়া যায়!!
না, এটি ঠিক গোয়েবলসীয় পদ্ধতি নয়, যেখানে মিথ্যাকেই বারবার বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সত্য রূপে। এটি আরো ভয়ানক এই কারণেই যে, এটি যার বা যাদের উপর করা হবে, সেই ভিকটিম কোন ভাবেই বুঝতে পারবে না যে, ভিক্টিমাইজার আসলে আস্তে আস্তে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করছে! বরং মনে হবে, আরে! এতো আমার ভালোর জন্যই সব করছে! তাহলে এর কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনে চলাই আমার একমাত্র কর্তব্য!!
আরো ভয়ানক হয় তখন, যখন ভিকটিম নিজে এই মিথ্যাগুলোকে সত্যি বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে!!
এবার এ গল্প থেকে কি পাওয়া গেল?? কাঁচকলা, তাই তো??
একটু ভাবুন। আশেপাশের ফেসবুকের অগুণতি পোস্ট নিয়ে ভাবুন। লাফিয়ে উঠে তর্ক করার আগে ভাবুন, আপনি ও কি শিকার হচ্ছেন না এই গ্যাস লাইটিং এর??
হচ্ছেন। এবং হয়েও আপনি বুঝতে পারছেন না সেটা।
কারণ, আলো কমছে … ক্রমশঃ … সেটা আপনার চোখে ধরা পড়ছে না। আপনি ভাবছেন – হয়তো এই কম আলো বুঝতে না পারাই আপনার অসুখ।