প্রতিবেশী স্বপন দার এটা অনেকদিনের অভ্যেস – সাত সকালেই ফুল ভলিউমে টেলিভিশন চালিয়ে গান শোনা, ধম্মো কথা শ্রবণের অপার পুণ্য অর্জন করা। এসবের মাঝে মাঝেই চ্যানেল বদলে সকালের স্কুপ নিউজেও কান পাততে ভোলেননা । আজ ঠিক তেমনই করছিলেন। আমাদের দুই বাড়ির মাঝের বারো – তেরো ফুটের ব্যবধান পার হয়ে উচ্চ গ্রামে বাজতে থাকা টিভির শব্দতরঙ্গ আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে থাকে। সংবাদ পাঠিকা খবর পড়ছেন – কলকাতায় জিবিএস সংক্রমণের কারণে প্রথম মৃত্যু । এই জটিল স্নায়ুরোগে সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১০০ জন আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সূত্রে জানা গেছে। মহারাষ্ট্রের পুনেতে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও একজন। খবরটা শুনে মনটা উৎকন্ঠিত হলো খানিকটা।
জিবিএস। পুরো কথাটা হলো Guillain – Barre Syndrome – এই মুহূর্তের অন্যতম আলোচিত বিষয়ের একটি। আগন্তুক এই রোগটির এমন নামকরণের পেছনে অবশ্য রয়েছে দুই ফরাসি স্নায়ুতন্ত্রের চিকিৎসক বা নিউরোলজিস্ট George Guillain ও Jean Alexandre Barre র অবদান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই রোগের সংক্রমণের বিষয়ে জানতে পারেন তাঁরা, চলে অনুসন্ধান, দীর্ঘ গবেষণা। পরবর্তীতে এই দুই চিকিৎসক ১৯১৬ সালে আরও এক ফরাসি বিজ্ঞানী তথা চিকিৎসক Strohl এর সহযোগিতায় তাঁদের গবেষণাসূত্রে পাওয়া তথ্যকে জনসমক্ষে প্রকাশ করলেন। চিহ্নিত করলেন জিবিএস কে একটি অটো ইমিউন ডিজিজ হিসেবে অর্থাৎ কোনো সংক্রমণের কারণে আমাদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আক্রান্ত হলে তা জীবাণুদের পরিবর্তে আমাদের শরীরকে, বিশেষ করে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকেই আক্রমণ করে।এর দরুণ শারীরিক দুর্বলতার পাশাপাশি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এই দিক থেকে দেখলে বলা যায় যে জিবিএস একটি আত্মঘাতী রোগ অর্থাৎ যেই ব্যবস্থাপনার ওপর আমাদের শরীরী নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্ব সেই একসময় ঘাতক হয়ে ওঠে। ফলে শরীরে এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করতে হবে যাতে বড়ো রকমের শরীরী বিপর্যয়ের শিকার না হতে হয় ।
প্রশ্ন হলো, শরীরে কী কী পরিবর্তন ঘটলে বোঝা যাবে যে জিবি সিনড্রোমে শরীর আক্রান্ত হয়েছে ? চিকিৎসা গবেষকেরা জানিয়েছেন যে এই রোগটি পা বা হাত থেকে ধীরে ধীরে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে পা থেকে এই বিশেষ ধরনের স্নায়ুরোগটি ছড়িয়ে পড়ে বলে এই রোগটিকে Ascending Paralysisও বলা হয়। অবশ্য কখনো কখনো মুখমণ্ডল সবার আগে আক্রান্ত হয়। যতদিন যায় রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে ততই শরীরের পেশির শিথিলতা বাড়তে থাকে এবং চরম অবস্থায় প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয় মানুষটি। দেখা যায় কিডনির সমস্যা। জিবি সিনড্রোমের প্রধান লক্ষণ বা সিম্পটমগুলো এ রকম —
- পায়ের আঙ্গুল, গোড়ালি, পায়ের পাতা অথবা হাতের কব্জিতে পিন বা সুঁই ফুটিয়ে দেবার মতো তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার অনুভূতি।
- পায়ের জোর কমে যায়। পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা রীতিমতো কষ্টের হয়ে ওঠে। এই অবস্থা ধীরে ধীরে শরীরের ওপরের অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
- পায়ের পেশিতে শিথিলতা দেখা দেওয়ায় চলার সময় স্বাভাবিকভাবে চলতে না পারা, এলোমেলো ভাবে পা ফেলা অথবা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে না পারা এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।
- আক্রান্ত মানুষ মুখের চেনা কাজগুলো যেমন কথা বলা, চিবিয়ে খাওয়া কিংবা গিলতে পারা , ঠিকমতো করতে পারে না। কথা জড়িয়ে আসে।
- এই রোগের ফলে আক্রান্ত হয় আমাদের দৃষ্টিশক্তিও। একসঙ্গে একাধিক বস্তুকে দেখা অথবা চোখের নজর স্থির হয়ে যায়।
- রাতের দিকে শরীর জুড়ে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করা যায়। কখনো কখনো ক্র্যাম্প বা খিঁচ ধরার ফলে যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়।
- হঠাৎ করে হৃদস্পন্দনের গতি অনেকটাই বেড়ে যায়।
- কখনো কখনো অসাড়ে প্রস্রাব অথবা মল ত্যাগ হয়ে যায়। এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে রোগী।
- রক্তচাপ কখনো অনেক বেড়ে অথবা কমে যায়। শ্বাসকষ্ট দেখা যায়।
আক্রান্ত হবার দুই সপ্তাহের মধ্যে Guillain Barre Syndrome এর সমস্যাগুলো চরম অবস্থায় পৌঁছে যায়, ফলে আক্রান্ত মানুষটির শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। এ তো গেল সিম্পটম বা লক্ষণচিহ্নের কথা, কিন্তু কী কারণে আমাদের দেহের ভিতরের রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থা ভেঙেচুরে এক বিপর্যয় ডেকে আনে,সেই বিষয়টি কিন্তু এখনও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়নি । তবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে কোনো মানুষ যদি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া জনিত কারণে রেসপিরেটরি অথবা ডাইজেস্টিভ ট্রাক্টের সংক্রমণে আক্রান্ত হন তাহলে তার কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি জিবি সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে ঠিকঠাক রান্না না করা মাংস,ডিম জাতীয় পোল্ট্রিজাত খাবার খাওয়া হলে বা অপরিস্রুত পানীয় জল, পনীর ঠিকঠাক রান্না করা না হলেও বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বিশেষ করে Campylobacter jejuni সংক্রমণে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে যা পরবর্তীতে Guillain Barre Syndrome এর সৃষ্টি করতে পারে। পুনেতে আক্রান্ত মানুষেরা সংক্রমিত কুয়োর জল পান করার ফলেই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। আসলে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসেরা দেহ যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে অতি সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে দেহের আভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা একদম ভেঙে গিয়ে দেহকেই কুড়ে কুড়ে ক্ষয় করতে থাকে।
মনে রাখবেন যে এই রোগটি নতুন করে এসেছে তা কিন্তু মোটেই নয়। প্রতি বছরই বেশ কিছু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন এবং উপযুক্ত চিকিৎসার কল্যাণে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাহলে এখন আমাদের কী করণীয়? পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে প্রতিদিন সঠিকভাবে রান্না করা খাবার খেতে হবে। তাঁদের মতে –
১. পাস্তুরাইজড দুধ খুব ভালো করে ফুটিয়ে পান করতে হবে কেননা অশোধিত দুধের মাধ্যমে Campylobacter ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২. ১৫৬ ডিগ্রি+ ফারেনহাইট তাপমাত্রায় রান্না করা খাবার খেতে হবে। এরফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা ঠেকানো যাবে।
৩.প্রত্যেকবার খাবার সময় খুব ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। পোল্ট্রি বা ডেয়ারিজাত কোনো দ্রব্য যেমন ডিম বা মাংস ধরলে হাত খুব ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
৪. রান্নাঘরে মাংস ইত্যাদি কাটাকাটির সময় সাবধানে থাকতে হবে। এড়াতে হবে এক বাসনে ধোয়াধুয়ির বিষয়টি।
৫. কিছুদিন বাইরের খাবার খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। বাইরের কাটা ফল খাওয়া চলবে না।
কথায় বলে সাবধানের মার নেই। সজাগ থাকুন। অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে আগামীর কিছুদিন। নিজের চিকিৎসা নিজেই করবেন না। ভালো চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর বাতাবরণ ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াদের দ্রুত বেড়ে ওঠার পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল হয়ে উঠছে। মেরু অঞ্চলের বরফের গলন বাড়িয়ে তুলছে আরও বড়ো রকমের আশঙ্কা। তাই সতর্ক হতে হবে নিজেকে এবং প্রতিবেশের সকলকেই।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আলোচনা। খবরের কাগজে এই বিষয়ে লেখালেখি পড়ছি , তবে এখানে অনেক সুন্দর করে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ধন্যবাদ।
প্রথম মতামতকে স্বাগত। সুন্দর করে বলা হয়েছে কিনা জানিনা, তবে যেভাবে এই ঘটনাকে নিয়ে মিডিয়ায় ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা লক্ষ করছি সেই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির একটা সামান্য প্রচেষ্টা এই লেখাটি। ভয় পাবেন না।
খুউব সময় উপযোগি আলোচন ও পরামর্শ। ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ পার্থ বাবু। যেভাবে নানা জন নানান বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তাতে সন্দেহ হয় যে এর পেছনে অন্য কোনো গূঢ় রহস্য নেই তো? সহজ সরল করে লেখার চেষ্টা করছি, জানিনা কতটা কার্যকর হচ্ছে লেখাগুলো। ছড়িয়ে পড়ুক সচেতনতার জন্য।
Perfect ❤️🔥 treatment- supportive and steroids and IV immunoglobulin or Plasmapheresis…
I’m not a doctor nor even student of medicine. I honestly need the comments from you, the medical personnel. Thanks for your support. Please circulate the article for public awareness.
Very informativee. I adore the way of presenting the complicated disease pathology in simple and lucid form. Looking forward for more such contents. <3
Thanks Dr Sandipan Sen for your supportive appreciation. Your valuable comments inspire me a lot. Many many thanks.