আচ্ছা এমন হলে কেমন হবে? ধরুন কোনো অ্যাক্সিডেন্টে আপনার হাত বা পা কোনো একটা বাদ গেছে। ডাক্তারবাবুরা আপনার এমন চিকিৎসা করা শুরু করলেন যাতে আপনার কাটা যাওয়া হাত বা পা নতুন করে গজাতে শুরু করল। অথবা ধরুন আপনার হার্টের অবস্থা এমনই খারাপ যে ডাক্তারবাবুরা বলেছেন যে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট না করলে আপনার আয়ু খুব বেশি হলে এক বছর। আপনার নতুন পদ্ধতিতে চিকিৎসা শুরু হল। দেখা গেল আপনার নষ্ট হয়ে যাওয়া হার্ট আবার নতুন করে আগের মত হয়ে যাচ্ছে। যে কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল তারা আবার পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। তাহলে কেমন হবে?
আপনার বয়স হয়ত নব্বই ছুঁই ছুঁই করছে। মেরুদন্ড বেঁকে গেছে। হাঁটুতে জোর নেই। সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না। জোরে হাঁটতে পারেন না। কোনো রকমে দিন গুজরান করে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন। এমন সময় একদিন হঠাৎ রাস্তায় আপনার ছোটবেলার বন্ধুর সাথে দেখা। আপনি শুনেছিলেন তিনি প্রচুর পয়সাকড়ি করেছেন। বেশিরভাগ সময়ই বিদেশে থাকেন। তাঁকে দেখে আপনি ধন্দে পড়ে গেলেন। এই আপনার ছেলেবেলার বন্ধু তো? তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি হলে তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়স। কলকাতায় এসেছে ম্যারাথনে নামবে বলে। ঋজু সুঠাম দেহ। নির্মেদ। আপনার মনে হতে লাগল এ কী ভোজবাজি নাকি!
এই ঘটনাগুলো কোনো সায়েন্স ফিকশনের বিষয় হতে পারে। কোনো হলিউডি সিনেমার থিম হয়ে যেতে পারে অবলীলায়। কিন্তু বাস্তবে কী এমন হতে পারে? কয়েক বছর আগেও বিজ্ঞানীরা বলতেন, এ অসম্ভব ব্যাপার। এখন বলছেন এ অবশ্যই সম্ভব। সেদিন আর বেশি দূরে নেই যখন মানুষ এই ধরনের চিকিৎসায় নিজের ভোলবদল করতে পারবে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পারবে। নিজের আয়ুকে অনেকটাই দীর্ঘায়িত করতে পারবে অনায়াসে।
আমাদের জীবপ্রজাতির সব ঠিকুজি-কুষ্ঠি লেখা আছে আমাদের ডিএনএ তে। এই ডিএনএ ক্রোমোজোমের মধ্যে জড়িয়ে পাকিয়ে আছে আমাদের প্রত্যেক কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে। হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট হবার পরে বিজ্ঞানীরা আমাদের মানুষের দেহের সমগ্র জিনোমের সিকোয়েন্সিং করে ফেলেছেন। আমাদের মানুষের দেহে মোটামোটিভাবে ৩০,০০০ জিন আছে। এদের মধ্যে অনেকগুলো আমাদের দেহের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট নিয়ন্ত্রণ করে। কখনও যদি এই জিনে কোনো মিউটেশন ঘটে তার জন্য সেই লোকটির দেহে সাঙ্ঘাতিক কিছু সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে যে সমস্যাকে আমরা ওষুধ দিয়ে ঠিক করতে পারি না। সেই সমস্যার সমাধানে দরকার হয় জিন থেরাপির।
এই জিন থেরাপি মুখের কথা নয়। এই পদ্ধতি খুব জটিল এবং বিজ্ঞানীরা এর ফলাফল নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না। কিন্তু জেনিফার ডাউডনা এবং এমানুয়েল শারপেন্টিয়ার ক্রিসপার ক্যাস 9 (CRISPR Cas 9) এক বিশেষ প্রোটিন আবিষ্কার করলেন যার সাহায্যে খুব সহজে মিউটেশন ঘটা জিনটিকে কেটে বাদ দিয়ে তার জায়গায় স্বাভাবিক জিনটিকে প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব। পদ্ধতিটা অনেকটা আপনার ওয়ার্ড ফাইলে কাট-পেস্ট করার মত। কোনো অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে বাদ দিয়ে তার যায়গায় নতুন শব্দ বা লাইন ঢোকানোর মত ব্যাপার। তাঁদের এই আবিষ্কারের জন্য দুই মহীয়সী বিজ্ঞানীকে ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে।
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব সাঙ্ঘাতিক। আগে জিন থেরাপির পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল ছিল কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব সহজেই জিন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা সম্ভব। এই পদ্ধতিটির সমস্যা তার সহজতার কারণে। এই পদ্ধতি খুব সহজেই যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে। আমি আপনি যারা ধরুন বিজ্ঞানী নই তাদের পক্ষেও একে ব্যবহার করা অসম্ভব নয়। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তাই এই পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে প্রমাদ গুনছেন। খুব সাধারণভাবে এর ব্যবহার শুরু হলে এর অপপ্রয়োগ হতে বাধ্য।
করোনার ধাক্কা সারা পৃথিবী এখনও মোকাবিলা করে চলেছে। অন্যান্য অনেকের মতে আমিও বিশ্বাস করি করোনা ভাইরাস উহান ল্যাবের থেকেই বাইরে এসেছে। সাধারণভাবে কোনো ভাইরাস মিউটেশন ঘটিয়ে পরিবেশে এলে তার সারা পৃথিবীব্যাপী এমন মারণ ক্ষমতা দেখানো খুব সহজ কথা নয়। যদি আমাদের অনুমান সত্যি হয় তবে এই করোনা ভাইরাসকেও এমনিই কোনো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে উহান ল্যাবে তৈরি করা হচ্ছিল। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে সেটাকে ‘বায়ো ওয়েপন’ বা ‘জৈব অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয় নি তবুও সেটা তো ল্যাবের বাইরে এল, এসে সারা পৃথিবীকে তুর্কিনাচন নাচিয়ে ছাড়ল।
একটা ভাইরাসেই যদি এই অবস্থা হয় অন্য যে কোনো জীবপ্রজাতিকে বিশেষভাবে পরিবর্তিত করে বাইরে ছেড়ে দিলে তারা আমাদের জীবনযাত্রায় কী মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে একবার ভেবে দেখুন। অথচ ক্রিসপার-এর মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটা করা কোনো ব্যাপারই নয়। আগামি কয়েক বছরের মধ্যেই এই নিয়ে গবেষণা যদি সরকারি ফান্ডিং পায় তবে কোথায় যেতে পারে এই নিয়ে আপনার কোনো ধারণাই নেই।
বায়ো হ্যাকিং বা অসৎ উদ্দেশ্যে এর ব্যবহারের কথা ছেড়েই দিলাম, খুব সাধারণভাবে যদি বলি আমাদের কি সত্যিই কোনো অধিকার আছে আমাদের চারপাশের অন্য জীবেদের বা আমাদের নিজেদের জিনের পরিবর্তন করার? প্রশ্নটা নৈতিকতার এবং সেই কারণে বিশেষভাবে ভেবে দেখার মত।
চার্লস ডারউইন যেদিন তার ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ এই মহাগ্রন্থটি প্রকাশ করলেন তারপর প্রাথমিক ঝড়ঝাপটা সামলে সেই অভিযোজনবাদের তত্ত্ব সারা পৃথিবীর মানুষ মেনে নিল। আমাদের ছোটবেলায় পড়া সেই লম্বাগলা জিরাফের ছবি সকলেরই মনে আছে। সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট বা যোগ্যতমের উদ্বর্তন। সামান্য কথা কিন্তু মুখের কথা নয়। আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বকেই মেনে নিয়েছেন কারণ এখনও পর্যন্ত এই তত্ত্বকে বাতিল করার মত অন্য কোনো তত্ত্ব আমাদের হাতে আসে নি।
কোনো প্রজাতি পরিবেশে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংগ্রাম খুব নিষ্ঠুর। যে এই লড়াইয়ে জয়ী হতে পারবে পৃথিবীতে সেই টিঁকে যাবে। অন্যরা হারিয়ে যাবে। যে প্রজাতি টিকে গেল তার যে বিশেষ বৈশিষ্টটি তাকে জিতিয়ে দিল সে সেটিকে তার পরবর্তী সন্ততির মধ্যে বজায় রাখবে। অন্যভাবে বলা যায় ধীরে ধীরে সেই বৈশিষ্টটি জিনের পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রজাতির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হবে। এই ঘটনা যত সহজে বলা হল তত সহজে ঘটে না। বহু হাজার বছর ধরে এই পরিবর্তন আসে।
পৃথিবীতে প্রথম সম্ভবত ৪.২ বিলিওন সাল আগে প্রথম প্রাণের উন্মেষ ঘটেছিল। যদিও আমরা খুব নিশ্চিত নই কিভাবে সেই প্রাণের সৃষ্টি হয়। অনেকে এও বলেন যে অন্য গ্রহ থেকে কোনো উল্কা প্রাণ নিয়ে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। তার থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। এখন অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই মনে করেন আমাদের পৃথিবীর বাইরে যে কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাই অন্য গ্রহাণু উল্কার আকারে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ায় প্রাণের সৃষ্টি হতেই পারে। অনেকে বলেন এমনিতে স্বাধীনভাবেও পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হতে পারে। তবে যেভাবেই হোক না কেন প্রথম প্রাণ যে এককোষী জীবেরাই ছিল এবং সমুদ্রের তলদেশেই যে প্রথম প্রাণের বিকাশ ঘটেছিল তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
এরপর সেই এককোষী প্রাণ থেকে কিভাবে জীবপ্রজাতির উদ্ভব হল তা আলোচনার জায়গা এটা নয় তবে দুই একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমাদের অনেকের বাড়িতেই নারায়ণ শিলায় পুজো হয়। সেই শিলাকে আপনারা অনেকেই দেখে থাকবেন। যদি বলা হয় সেটি আসলে অ্যামোনাইট বলে এক সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল যারা আজ থেকে ৩০০ মিলিওন বছর আগে পৃথিবীতে সমুদ্রের তলায় ঘুরে বেড়াত। নারায়ণ শিলা প্রায় সবই পাওয়া যায় পাহাড়ি নদীর উপত্যকায়। হিমালয় পর্বত যে আগে টেথিস নামে এক সমুদ্রের তলদেশ ছিল এই নারায়ণ শিলারাই তার প্রমাণ।
ভেবে দেখুন তিনশ মিলিওন বছর। মুখের কথা নয়। কতকাল আগে এই প্রাণীরা অবলুপ্ত হয়ে গেছে আজও তাদের দেহাবশেষ ফসিলের আকারে আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চই আপনার চোখ এড়ায় নি যে এককোষী সেই ব্যাক্টিরিয়া থেকে সমুদ্রের তলায় ঘুরে ঘুরে খুঁটে খুঁটে খাওয়া এই অ্যামোনাইট প্রাণীটির আসতে সময় লাগল ৩৯০০ মিলিয়ন বছর!
(চলবে )