এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত তিরিশটা বেডে, প্রত্যেকটি মানুষ হাঁপাচ্ছে। একসঙ্গে এত মানুষকে এভাবে শ্বাসকষ্টে ভুগতে আগে দেখিনি। ফার্স্ট ওয়েভেও দেখি নি। একটা বেড খালি হলেই, আর একজন চলে আসছে ইমার্জেন্সি থেকে। এভাবে আর ক’দিন? এই কি মানবসভ্যতার শেষ? বাঁচবো তো এ যাত্রা? এইসব ভাবতে ভাবতে ডিউটি রুমের দিকে ফিরছি। পা টেনে টেনে হাঁটছি। আজকাল শুধু গলায় টিউব ঢোকাতে হলে PPE পরি। বাকী সময়টা একটা সার্জিকাল গাউন, মাস্ক আর ফেসশিল্ড, গ্লাভস, শু কভার এসব পরে থাকি। তাও এসব ধড়াচূড়ো খুলেই রুমে ঢুকতে হবে। আবার এই কুম্ভীপাকে ঢুকলে আবার ওগুলো পরতে হবে। ভাবলেই কান্না পাচ্ছে।
বাঁ দিকের সারির কোণার বেডটা থেকে ডাক এল -“এই যে ম্যাডাম, কি খবর?”
ইনি নিজে একজন ডাক্তার। আসাম থেকে এয়ার এম্বুলেন্সে করে আনা হয়েছে। স্বাস্থ্য ভবন, হাইকোর্ট, এবং আরো কয়েকটি বিশিষ্ট জায়গা থেকে এনার নামে সুপারিশ হয়েছে। তা এরকম সুপারিশ ওয়ালা ভি আই পি দেখতে আমরা অবশ্য অভ্যস্ত। আজ নিয়ে আঠেরো দিনের অসুখ। অক্সিজেনের ডিমান্ড অনেকটা। লাংসের অবস্থা দেখলে বুক কেঁপে ওঠে অজান্তে। এই ভদ্রলোকের ওপর আমার একটা চাপা রাগ আছে। ইনি নিজে ডাক্তার, আগে আসামের একটি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক ছিলেন। এখন প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করেন। বয়স পঞ্চাশোর্ধ, কিন্তু ভ্যাক্সিন নেন নি। কেন নেন নি জিজ্ঞেস করাতে একটা অদ্ভুত কথা বললেন, তাতেই রাগ হল।- “ভ্যাক্সিন দেশের সবাইকে দিক, তবেই নেব, ডাক্তার বলে কি মাথা কিনে নিয়েছি, যে আগে ভাগে নিয়ে নেব?”
ভ্যাক্সিন ব্যাপারটাই ভুয়ো এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে, কে আগে পাবে, ভ্যাক্সিন আশীর্বাদ না অভিশাপ – এই নিয়ে তর্ক করে করে অনেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে ডাক্তারও আছে। এবং কোভিড এসে আমাদের এতটাই মরিয়া করে দিয়েছে যে, প্যান্ডেমিক চলে গেলেও জ্ঞানত আর অ্যান্টি- ভ্যাক্সারদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবো না বলেই স্থির করেছি।
আমার রুগীর সঙ্গে তর্ক করার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু একেবারে চুপও থাকতে পারলাম না। বললাম- আমি এই কথাটা মানতে পারলাম না, স্যার, দুঃখিত।
ঐরকম অক্সিজেন ডিমান্ড থাকা সত্ত্বেও এর পর ভদ্রলোক আমাকে বিজ্ঞান থেকে পলিটিক্স, পলিটিক্স থেকে সোশ্যালিজম, তার থেকে নিও- সোশ্যালিজম সম্বন্ধে অনেক রকম জ্ঞানের কথা বললেন। আমি একটা দুটো হুঁ হাঁ করে হিস্ট্রি নিচ্ছি, ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল লিখছি। ওর মাঝেই ফেমিনিজমের ওপর বেশ কয়েকটা বইয়ের নাম মনে করে অবশ্যই আমায় পড়তে বললেন।
আজ নিয়ে চার দিন হল উনি আমাদের আই সি ইউতে। প্রথম দিন রাগ হয়েছিল বলে এঁকে আমি পারতপক্ষে দেখি না। আমাদের অবশ্য ethics হচ্ছে যে রুগীর ব্যাপারে অনুরাগ থাকলে ডাক্তারের তাকে দেখা উচিত না। রাগ থাকলে কি করা উচিত সেটা আর বলে না। মোদ্দা কথা, ডিউটিতে এঁকে আমি attend করি না। আমার কলিগ দেখে।
“কি খবর” জিজ্ঞেস করাতে আবার রাগ হয়ে গেল। নিজের তো দুটো লাংসই ঝাঁঝরা। হাতির শুঁড়ের মত একটা রিজার্ভয়ার মাস্ক ঝুলিয়ে বসে আছেন। আগে নিজের খবর ঠিক করুন না বাবা!
তাও রাগ চেপে বললাম, -এই তো, যা দেখছেন, আপনি কেমন আছেন?
-আমার তো আজ একটু ভালো বোধ হচ্ছে। কিন্তু জীবনে এত দুর্বল লাগে নি। পাশ ফিরতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছি। খাবার চিবোতে গেলে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অথচ এই আমি জানেন, গোটা নর্থ ইস্টে হেন জায়গা নেই যেখানে ঘুরে বেড়াই নি। পাহাড়ে চড়েছি। ঘোড়ায় চড়ি। ভালো সাঁতার জানি। ওয়েট লিফটিং করি। সেসব কি আর পারব?
-হুমম… এবারের ওয়েভে এটাই দেখছি, লাংসগুলো দিন সাতেকের মধ্যেই কি করে যে এমন ভয়ানক হয়ে যাচ্ছে!
– এটা কি আমার কথার উত্তর হল ডাক্তারবাবু? আমি কি আর ভালো হব?
– আমি জানি না ড.ভৌমিক (নাম পরিবর্তিত), এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমি আশা করব যে আপনি ভালো হয়ে যান।
এক সপ্তাহ আগে আমার বৌদিকে কোভিডে হারিয়েছি। আমার এখন কাউকে আশার বাণী বিশেষ শোনাতে ইচ্ছে করে না। বৌদি এঁর চেয়ে দশ বছরের ছোট ছিল।রক্তাল্পতা ছিল। এপ্লাস্টিক এনিমিয়া। পঁয়তাল্লিশের নীচে বয়েস বলে ভ্যাক্সিন পায় নি। আর ইনি হাতের কাছে ভ্যাক্সিন পেয়েও নেন নি।
– আচ্ছা একটা ছোট্ট অনুরোধ ম্যাডাম। একটা নাম্বারে একটু কথা বলিয়ে দিন।
আই সি ইউ-তে একটা মোবাইল আছে, যাতে রুগীর ইচ্ছে হলে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া হয়। আমি নার্সিং ইন চার্জকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়ে রুমে চলে এলাম।
খানিক পরেই কল। ড. ভৌমিকের পাশের বেডের রুগী কিছুতেই মোবাইল ছাড়ছে না। নার্সের অনুরোধ গায়ে মাখছে না। অগত্যা আবার গাউন পরে ভেতরে ঢুকলাম।
মোবাইল কব্জা করা ভদ্রলোক বললেন – আমি আমার রিলেটিভের সঙ্গে কথা বলছি, উনি একটু ধৈর্য্য ধরতে পারছেন না?
এদিক থেকে ড. ভৌমিক বললেন – কি রকম রিলেটিভ ওনার? আমিও আমার পরমাত্মীয়ের সঙ্গেই কথা বলতে চাইছি, পৃথিবীতে কি উনি একাই অসুস্থ?
আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, মানুষের কি অবস্থা। প্রাণ আইঢাই, কিন্তু ঝগড়া করা চাই! যাই হোক, পাশের ভদ্রলোক খোঁচা খেয়ে গজগজ করতে করতে ফোন ছেড়ে দিলেন।
ফোন হাতে পেয়ে ড. ভৌমিক মুচকি হাসলেন, তারপর নিজেই ডায়াল করলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম মস্তিষ্ক ঠিকই কাজ করছে। ফোন নাম্বার মনে রাখতে পারছেন যখন।
আমি যখন আবার বেরিয়ে আসছি ওয়ার্ড ছেড়ে, তখন শুনলাম উনি ও প্রান্তে থাকা মানুষটিকে বলছেন – এরা তো দেখা করতে দেয়, তুমি আসছ না কেন?
দু-তিন দিন ছাড়া ছাড়া রোগী পিছু একজন বাড়ির লোককে PPE পরে দেখা করতে দেবার নিয়ম করা হয়েছে। আসছ না কেন আবার কেমন কথা হল, যে আসতে চায় না কোভিড আই সি ইউ-র মধ্যে তাকে ইনি জোর করে আনাবেন নাকি? সে যত আপনজনই হোক। কি অদ্ভুত লোক।
……
তিনদিন বাদে আবার যখন ফিরে গেলাম ডিউটিতে তখন ড. ভৌমিকের স্যাচুরেশন আরো খারাপ হয়েছে। রিজার্ভয়ার মাস্ক থেকে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা-তে দেওয়া হয়েছে। সারারাত বাইপ্যাপ মাস্ক-এ থাকেন। স্টেরয়েডের ডোজ বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়েই ভদ্রলোক খাবার দাবার খেয়ে নেন। ফিজিওথেরাপিটাও মন দিয়ে করেন। আজ সন্ধেবেলা ওঁর স্ত্রীকে দেখলাম। ছিপছিপে পাতলা গড়ন। PPE খুলে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। আমার কলিগ গেছে চা খেতে। আমি কোভিড জটিলতা নিয়ে বাঁধাধরা গতানুগতিক কথা বলেই যাচ্ছি।
ভদ্রমহিলা বললেন – একটা জিনিস আমি বুঝেছি, ও যখন বলছে আর ভালো হবে না, তাহলে আর হবে না।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। একদিক দিয়ে ভালো। খারাপ টাই ভেবে রাখা ভালো। ভালো হলে তো আর দোষ নেই। আমিও তর্কে গেলাম না, বললাম- দেখুন কি হয়।
-খুব জেদ। একটা কথা যদি কারো শোনে। সব ডাক্তার বন্ধুরা বলেছিল ভ্যাক্সিন নিতে। নিল না। ভেবে দেখুন, ওর কোন অসুখ ছিল না, কোন নেশা ছিল না, ম্যাডাম।
কথাটা শুনে ভাবলাম এ ব্যাপারটা আমাদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ভদ্রলোকের শুগার প্রেশার কিচ্ছু নেই। ফিট ছিলেন নিজেই বলেছেন।
এদিকে ভদ্রমহিলা বলেই চলেছেন। কথাগুলো বলার কাউকে পান নি নিশ্চয়ই। কখনো কখনো চুপ করে শুনতে হয়। আমি চুপ করেই রইলাম।
– একমাস আগে জন্মদিন গেছে। কত আনন্দ করল আমার ওখানে এসে। কেক বানালাম। আশ্রমের বাচ্চা গুলোকে নিজে হাতে খাওয়াল। দেখবেন?
এই বলে ভদ্রমহিলা মোবাইল খুলে গ্যালারি ঘাঁটতে শুরু করলেন। আমার এমনিতেই খিদে পেয়েছে, মাথা বিশেষ কাজ করছে না। ভাবছি আমার সহকর্মীটি কখন আসবে আমি এক কাপ চা খেয়ে আসি, এর মধ্যে আশ্রম টাশ্রম – কি সব বলছে !
ততক্ষণে ছবি বেরিয়ে এসেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা সুদৃশ্য ছড়ানো বসার ঘর। ডাইনিং টেবিল ঘিরে তিনজন মানুষ । একজন ড. ভৌমিক। চেয়ারে বসে। সুদর্শন, সহাস্যমুখ ।একজন ওনার স্ত্রী। ভদ্রমহিলার মুখটা মাস্কে ঢাকা এখন। ছবিতে দেখলাম বেশ সুন্দরী। উনি দাঁড়িয়ে আছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আর একজন বৃদ্ধা। উনিও এককালে বেশ সুন্দর ছিলেন বোঝা যায়। হাসিমুখে টেবিলে রাখা কেকটার দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছবিটা দেখে কেমন একটা লাগলো। কেমন অলৌকিক। এই ছবির তিনজন মানুষ একমাস আগেও এত সুখী, প্রাণবন্ত ছিল। এখন এই এক ভাইরাস একটা আগ্রাসী, ক্রুদ্ধ মরুভূমির মত সব আনন্দ শুষে নিয়েছে।
মহিলা বললেন – আমার মা। কোভিডে মারা গেছেন। এই ছবি তোলার ঠিক আট দিন পরে। দু দিনের মধ্যে শেষ। মাকে দেখতে গিয়েই ওর হল।
আমি ধাক্কা খেলাম আবার। – আর আপনি?
-আমার কিছু হয়নি। কেন হয়নি জানি না। শিলচর থেকে ও গুয়াহাটি ফিরে গেল। আর তারপরই জ্বরে পড়ল।
ভদ্রমহিলা নিশ্চিত এসিম্পটোম্যাটিক। এঁর তখন টেস্ট করানো উচিত ছিল। করান নি। এখন তো অনেক দিন হয়ে গেছে। আমার মাথাটা আবার গরম হচ্ছে। তাই রাগ কমানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম – আপনি শিলচরে থাকেন?
– হ্যাঁ। আমার একটা স্কুল আছে। অনাথ আশ্রমের মত। আমার বাবার তৈরি। পলাশদা ওখানে প্রত্যেক মাসে একবার আসত। বাচ্চা গুলোকে ও নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আমার স্কুলের বাচ্চাগুলো খুব মন খারাপ করে আছে, ম্যাডাম!
এই রে, পলাশদা! ভুল ভাবছি, ইনি স্ত্রীই নন। একটা মস্ত বড় মিসটেক করেছি। ছোটবেলা থেকে বেডসাইডে পই পই করে বলা হয় যা, সবার আগে পরিচয় জেনে নেওয়া, এত বছর পরেও সেটা ভুলে যাই।
ভীষণ নির্লজ্জের মত জিজ্ঞেস করলাম – আপনি ওঁর কে হন?
মাস্কের আড়ালে মুখ ঢাকা। কিন্তু এই প্রশ্নে ওঁর চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল। – আমি ওঁর সব।
আমি কথা বলা বন্ধ করলাম এবার। ঠিক আছে, দেখা যাক, সাবধানে থাকুন এসব বলে রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। ভদ্রমহিলা ধীরে ধীরে মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেলেন।
যদিও অচেনা কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে কৌতূহল থাকা উচিত না, কিন্তু ঐ ছবিটা দেখার পর কোভিড রুগী ড. পলাশ ভৌমিক আর ঐ ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে আমার জিজ্ঞাসা অনেক টাই বেড়ে গেল। আমার সহকর্মীটিকে জিজ্ঞেস করলাম – হ্যাঁ রে ভাই, রোজ ড. ভৌমিকের কোন রিলেটিভকে আপডেট দিস?
– ওনার দাদা আছেন কলকাতায়। ওরই নাম্বার দেওয়া কনট্যাক্ট হিসেবে। উনি নাকি সায়েন্টিস্ট। হোমরা চোমরা কেউ। খুব জ্ঞান দেয় আর খুব প্রশ্ন করে, দিদি।
ভাবলাম সে আর নতুন কি! – ওঁর স্ত্রী ছেলেমেয়ে নেই?
– হ্যাঁ আছে তো। এক ছেলে। টিন এজার মনে হয়।
-ওরা কোথায় থাকে? কোন আপডেট নেয় না?
– তা জানি না কোথায় থাকে। ছেলেটা ফোন করেছে এক দু বার।
আমি আর ভাবতে পারলাম না। মাথা টিপটিপ করছে। “আসামের কোথাকার কোন ড. ভৌমিকের পরিবারের কথা জেনে তোমার কিছু লাভ হবে না” – নিজেকে এই কথা শুনিয়ে চা খেতে চলে গেলাম।
চা খেতে খেতে ফোন পেলাম আমাদের মেডিকেল সুপারিন্টেনডেন্ট-এর। ড. পলাশ ভৌমিকের দাদাকে রাতে একটা আপডেট দিতে হবে। সেটা যেন আমি দিয়ে দিই। দাদা নাকি ফিডব্যাক দিয়েছেন ডাক্তাররা ঠিক করে কথা বলে না। কড়া চায়ে যে রাগ টা কমে গেছিল, আবার চড়াৎ করে বেড়ে গেল। দুই / তিন জনে মিলে তিরিশটা বেড সামলাই। প্রতিদিন রাউন্ড-এর শেষে নিয়ম করে প্রত্যেক রুগীর বাড়ির লোককে আপডেট দেওয়া হয়। আই সি ইউ রুগীর ঘন ঘন অবস্থা, চিকিৎসা সবই বদলাতে থাকে। সেকেন্ড ওয়েভে এখন রুগীর ঝড় বইছে। সারারাতই প্রায় জেগে থাকি আমরা। এমন অবস্থা যে কেউ কাউকে একা ওয়ার্ডে ছেড়ে পালা করে রেস্ট নেব সেটাও পারি না। কোন রুগী কখন খারাপ হবে কেউ জানে না। তার মধ্যে এই অযাচিত দাবী আর অভিযোগ গুলোতে ক্ষোভ হয়, অপমানিত লাগে খুব।
আমি ঠিক করলাম নিজে থেকে তো আমি এত্তালা দেবই না। ফোন করুক তারপর দেখাচ্ছি। রাত্রি এগারোটা নাগাদ আই সি ইউ এক্সটেনশনে ফোন এল। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় ভদ্রলোক বললেন- নমস্কার। আমি পলাশের দাদা। পঙ্কজ ভৌমিক। (নাম পরিবর্তিত)
শুরু হল চাপান উতোর। ডালে ডালে, পাতায় পাতায়। “তুমি যেমন কংস মামা, আমিও ভাগনে কেষ্ট আছি”। উনি চাইছেন আমি বেফাঁস কিছু বলি। আমি একটা পদক্ষেপ ও বাঁধাধরা গতের বাইরে নেব না। আমার, কনসালট্যান্টের, আমার হাসপাতাল আর আমার সহকর্মী ও নার্সদের কাজে কোন গাফিলতির অজুহাত যাতে উনি তুলতে না পারেন সেটা দেখতে হবে। তারপর ওঁর ভাইয়ের সিভিয়ার কোভিড নিউমোনিয়া আর তার থেকে হওয়া জটিলতা নিয়ে যত রকমের জিজ্ঞাসা আছে, সব কিছুর উত্তর দিতে হবে।
আমাদের শিক্ষকরা আমাদের শেখান – যত রকমের চিকিৎসার উপায় আছে, সে যত খরচই হোক- সব জানিয়ে দাও রুগীর আত্মীয়কে। লোকে অনেক সময় দেখবে, আপনজনের জন্য ঘটি বাটি বেচে ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এমন না হয়, যে বাড়ির লোক পরে বলল – আমায় কেন এই চিকিৎসা পদ্ধতির কথা আগে বলা হয়নি।
আধ ঘন্টা ধরে কথা বললাম। আমি একমো পেরিয়ে লাং ট্রান্সপ্লান্ট অবধি পৌঁছে গেছি।
পঙ্কজ ভৌমিকের গলার স্বর এবার সহজ হয়েছে। শেষে বললেন – দেখছি আমরা তাহলে সমস্ত যোগাযোগ করে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তারপরই ভদ্রলোকের ডিফেন্স নড়বড়ে হয়ে গেল। ভাঙা গলায় বললেন – অদ্ভুত লাগছে। পিঠোপিঠি আমরা। আমি একটু আতুপুতু ছিলাম। জ্বরজারিতে ভুগতাম। ও খুব ডানপিটে ছিল। ছোটবেলাটা আসামে কেটেছে। আমাদের বাবা রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আসামের অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে থেকেছি। ভাই, জানেন, এক শ্বাসে চড়াই ভেঙে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে যেত। ডুব সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন। ওর যে এরকম অবস্থা হবে! এত জেদ! এত জেদ! অনায়াসে কলকাতায় কাজ করতে পারত। আসামেই ফিরে গেল। নিজের সব সঞ্চয়, সব উপার্জন একটা গুড -ফর -নাথিং অনাথ আশ্রমের পিছনে ঢেলে দিয়েছে। একটা আঠেরো বছরের ছেলে আছে। নিজের সন্তানের কথা একটুও ভাবল না!
এইবার আমার চুপ থাকার পালা। ভদ্রলোক সামলে নিলেন। আর খুব মৃদুস্বরে গুড নাইট বলে ছেড়ে দিলেন। আমি বুঝলাম দাদা যতই মুখে পিঠোপিঠি বলুন না কেন, একমো বা লাংস ট্রান্সপ্লান্ট করার মত আর্থিক অবস্থা যদি থাকেও, ড. ভৌমিকের শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা বিশেষ নেই, কয়েকটা অনাথ আশ্রমের বাচ্চা ছাড়া বোধ হয়।তারা এইসব সিদ্ধান্ত নেবার মত জায়গায় নেই।
….
তিন দিন পরের ডিউটিতে ড. পলাশ ভৌমিকের দায়িত্ব আমার ওপরেই পড়ল। আমার রাগটা ততদিনে উধাও হয়ে গেছে। এখন টানা বাইপ্যাপে রাখতে হচ্ছে। মাঝে এক দু ঘন্টার জন্য, খাওয়ার সময়, হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলাতে রাখা হচ্ছে। গাল ভেঙে গেছে। চোখের কোনে কালি। সকালে আমাকে রাউন্ডে দেখে ঐ অবস্থাতেই বললেন – ভার্জিনিয়া উল্ফের একটা লেখা অন্তত জীবদ্দশায় পড়া উচিত, তাই না ডাক্তারবাবু?
বললেন বটে, কিন্তু ওঁর চাহনি আমার ঠিক প্রকৃতিস্থ লাগলো না। এবার মনে হচ্ছে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। বিকেলের দিকে হঠাৎ খুব ছটফট করে বললেন – “তুলি, পড়ে যাবি! পড়ে যাবি!” বলতে বলতে নিজেই বেড থেকে নেমে পড়লেন প্রায়৷ এক পা মেঝেতে। এক পা বেডে। (তুলি নামটিও, অবশ্যই পরিবর্তিত)
ঠিক এই সময়ে সেই ভদ্রমহিলা আবার এলেন। ইনি যে কোথায় কার কাছ থেকে “পারমিশন” নেন মা গঙ্গাই জানেন। এসেই বললেন – না আমি পড়ব না। আমাকে সামলানোর জন্য তুমি সবসময় থাকো না।
ফ্যালফেলে চোখে তুলি নামে এই মহিলাটিকে দেখতে থাকলেন ড. ভৌমিক। নার্সদের তৎপরতায় আবার বিছানায় উপুড় করে শোয়ানো হল। ঐটুকু পরিশ্রমেই স্যাচুরেশন ষাটের কোঠায়।
আমি ভদ্রমহিলাকে বললাম- ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন লাগবে। আর টানতে পারছেন না।
উনি বললেন- আমি সই করে দিয়ে যাচ্ছি।
আমি কঠিন গলায় বললাম – সই করাই আছে। ওঁর দাদা বা ওঁর স্ত্রী বা ছেলের সঙ্গে আগে কথা বলতে হবে সিচুয়েশনটা এক্সপ্লেন করে।
রক্তের সম্পর্ক আর স্বামী -স্ত্রী বা লিগ্যাল গার্জেন/কেয়ারটেকার ছাড়া অন্য কারো সই গ্রাহ্য নয়। উনি মৃদু স্বরে বললেন – আচ্ছা তাহলে তো আর কথা নেই।
সই করাতে একটা প্রচ্ছন্ন অধিকারবোধ কাজ করে। আর তাতে যে সম্মতির দায়িত্বটাও নিতে হয়, এটাও বোঝে সবাই। তাই লোকে সাধারণত হাসপাতালে এসে সেই দায় এড়িয়ে যেতে চায়। এরা দেখছি বেশ অদ্ভুত লোক।
….
ড. ভৌমিকের পরিবার একমো বা লাং ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে কোন মতামত বা সম্মতি কিছুই দিলেন না। সেদিন রাতেই ওঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হল। তারপর ও কেটে গেল প্রায় সাত দিন। কেউ আসে না আর। না স্ত্রী, না ছেলে, না দাদাটি।
আসেন যিনি, তিনি একজন সম্পর্ক বহির্ভূতা মহিলা। সমাজ নির্দিষ্ট সম্পর্ক বহির্ভূতা। নিঃশব্দে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। ড. ভৌমিককে ঘুম পাড়িয়ে অবশ করে রাখা হয়। উনি যাবার আগে নিঃসাড় রোগীর কানের কাছে কিছু কিছু কথা বলে যান।
আমরা ফোনে তিন বেলা আপডেট দিই তাঁদের, যাঁরা কোনদিনই PPE পরে আই সি ইউ-র ভিতরে আসার টান অনুভব করেন না।
জুনের শুরুতে এক সকাল বেলায় প্রথম বার হৃদপিন্ডের ছন্দ বিগড়ে গেল। CPR দিয়ে ফেরানো হল ছন্দ। কিন্তু পড়ে গেল রক্ত চাপ। কিডনি বিকল।
এই প্রথম ছেলেটিকে দেখলাম। আই সি ইউ-র বাইরে দাঁড়িয়ে গোলগাল, চশমা পরা একটি দিশাহীন হতভম্ব কিশোর।
সে এসেই বলল- মা বলেছেন এর পর যখন হার্টের সমস্যা হবে আমাদের যেন জানানো হয়। আমরা ভেতরে আসতে চাই। পারমিশন দিয়েছেন কনসালটেন্ট। আর যদি এখন একটা কোভিড টেস্ট করা যায়,যদি নেগেটিভ আসে, তাহলে আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো।
কোভিড টেস্ট নেগেটিভ এল না। আর টি পি সি আর পজিটিভ-ই এল। কেন জানি না আমি বেশ শান্তি পেলাম এতে। একা যাওয়াই ভাল।
সারাদিন কোমরভাঙা কাজের শেষে সন্ধের চাটা বিশল্যকরণীর মত লাগে। সেটা এক চুমুক পেটে পড়তেই হঠাৎ খেয়াল হল – সেই তুলি নামের মহিলার কি হল কে জানে।
আর যেই এটা ভাবলাম, শিউরে উঠলাম। কারণ দেখলাম, চায়ের স্টলের ঠিক উলটো দিকের প্যাসেজের শেষটায় তুলি দাঁড়িয়ে আছেন। আর আমার দিকেই দেখছেন। এরকম প্রাণহীন, ধূসর চোখ জ্যান্ত মানুষের হতে পারে, ভাবা যায় না।
উনি পায়ে পায়ে আমার দিকে এসে বললেন- আর বেশিক্ষণ নেই। আমি একবার আই সি ইউ-তে যাচ্ছি। পারমিশন পেয়েছি।
এ আবার কি? কে যে ওঁকে অনুমতি দিয়ে দেন দেখা করতে, তাও এইরকম সময়ে!
উনি লিফটের দিকে গেলেন। আমি আমার সহকর্মীকে ফোন করলাম। শিগগির বেডসাইডে যা। এক এক লাফে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে তিন তলায় গেলাম। এঁর সামনে কার্ডিয়াক এরেস্ট হলে অবস্থা সামাল দিতে লাগবেই।
যতক্ষণে উনি PPE পরলেন ততক্ষণে আমরা গাউন পরে আই সি ইউর ভেতরে চলে এসেছি। তুলি এসে বিছানার পাশে দাঁড়ানোর দু মিনিটের মাথায় আবার কার্ডিয়াক এরেস্ট হল।
এবার আমরা স্ক্রিন টেনে CPR এর তোড়জোড় করছি, তুলি হঠাৎ আমার দুটো হাত চেপে বললেন – একটু শান্তিতে যেতে দেবে না ওকে? একটু শান্তিতে যাক না। এত শব্দ না করে একটু শান্তি দাও না৷
আমি নার্সিং ইন চার্জ-কে বললাম ওঁকে বাইরে নিয়ে বসাতে। শান্তিতে যেতে দিতে গেলেও তাতে পরিবারের সম্মতি লাগে।
টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট CPR দিয়েও ফেরানো গেল না হৃদস্পন্দন। স্ত্রী ছেলে দাদা খবর পেয়ে এলেন। এসে বললেন – আমরা শেষ সময়ে থাকতে চেয়েছিলাম, আপনি তো ডাকতে পারতেন!
আমার রাগটা আবার ফিরে এল। আমি বললাম – শেষ সময়ে ওঁর একজন শুভানুধ্যায়ী পাশেই ছিলেন। আর যখনই এরেস্ট হয়েছে আপনাদের ফোন করা হয়েছে। চল্লিশ মিনিট ধরে চেষ্টা করেছি। আপনারা তার মধ্যে এসে পড়লেও দেখতে পেতেন না। CPR এর সময় থাকার নিয়ম নেই।
মিসেস ভৌমিক বললেন- তুলিই দেখতে পেল? শেষটাও দেখল?
আমি বললাম- হ্যাঁ ওঁর সামনেই হার্ট বন্ধ হয়েছে।
ড. ভৌমিকের পরিবার আর কোন কথা বললেন না। শেষবারের মত ওঁকে দেখার জন্য PPE পরতে চলে গেলেন।
আমি তুলিকে আর আশেপাশে দেখতে পেলাম না।
ডেথ সার্টিফিকেটের দলিলপত্র এসে পৌঁছলো প্রায় তিন ঘন্টা পরে। ড. ভৌমিক তখন প্লাস্টিকে বন্দী। কজ অফ ডেথ – সিভিয়ার কোভিড নিউমোনিয়া উইথ একিউট রেস্পিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম।
আর কিচ্ছু না। কোন ডায়াবেটিস না। কোন হাইপারটেনশন না। কোন হার্টের অসুখ না।
কি করলেন আপনি, ড. ভৌমিক! কার লাভ হল, আপনার এই জেদে? না আপনার রুগীদের। না অনাথ আশ্রমের বাচ্চা গুলোর। যারা আপনার আত্মীয় বলে নিজেদের দাবী করল, তারাও আপনাকে কোনদিন নিজের করে পেল না। যাকে সব টা দিলেন, সে যে আপনার অবর্তমানে একেবারে নিঃশূন্য হয়ে যাবে, এটাও ভাবলেন না। আর একটু লড়তে হত। লড়াই করার শক্তিটা ভ্যাক্সিন থেকে পেলেও পেতে পারতেন। বারাক উপত্যকার, হাফলঙের পাহাড়ের, ডিমা হাসাও-এর যে দূষণমুক্ত আবহাওয়ার কথা এত বার করে বলেছেন, সেখানে সেই অক্সিজেনের প্রাচূর্যের মধ্যে ফিরে যেতে হত। বেঁচে থাকলে সব হত। আপনি থাকলে সব সামলে নিতেন নিশ্চিত। একটা আঠেরো বছরের ছেলে, আপনি যার পিতা, যার সব থেকে বড় আশ্রয় আপনি – আর কিছুদিন তার পাশে থাকা উচিত ছিল তো! দেশের মানুষের কথা পরে ভাবতেন স্যার।
রাগের একটা ব্যাপার থাকে। কোন একজন মানুষ বা একটা কোন ঘটনা বা নিদেন পক্ষে একটা দৃশ্যমান সিস্টেম থাকতে হয় যার ওপর রাগ করা যাবে। এক অদৃশ্য আণুবীক্ষণিক জীব আর জড়ের মাঝামাঝি একটা প্রোটিনের দলা, আর কত প্রাণ, আর কত স্বপ্ন, আর কত ভালোবাসা,আর কত সম্ভাবনা নষ্ট করবে?
ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে বসে ডাক্তার কাঁদছে, ভাগ্যিস গগলস, মাস্ক আর ফেসশিল্ডের আড়াল থেকে বোঝা যায় না ব্যাপারটা!