বিশ্বব্যাপী কোভিড – ১৯ এর সংক্রমণের সাথে বিশ্বায়নের বিপর্যয়, ভ্রমণশিল্প এবং স্বাস্থ্যে নব্য উদারপন্থার যোগ সুস্পষ্ট। সর্বোপরি সামাজিক দূরত্বের প্রচার সমাজের শিকড় খুঁড়ে লুকিয়ে থাকা প্রাচীন সংস্কারকে বের করে তাকে সামাজিক বর্জনের রূপদান করতে পারে।
ইরানের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা অজানা নয়। ব্যবসার তাগিদে ইরানকে চিনের শরণাপন্ন হতে হয়। ইরানের এক ব্যবসায়ী প্রথম উহান থেকে ফিরে করোনাতে আক্রান্ত হন। ইরানের শিয়া মুসলিমদের তীর্থস্থান কুম শহরে করোনা সংক্রমণের সর্বপ্রথম চক্রক্ষেত্র। পরবর্তী কেন্দ্র ছিল ইরান। ইরানের সাংসদদের কুম শহরে খুব ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। মার্চের ২৩ তারিখের মধ্যে ২৩ জন সাংসদ আক্রান্ত হন।বিশ্বায়ন দ্বারা চালিত আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্মীয় কারণেই ইরানে করোনা সংক্রমণের সূচনা এবং প্রসার দেখা দেয়।
কোরিয়াতে ৮৮ বছরের বৃদ্ধ, নিজেকে যীশুর অবতার হিসেবে দাবি করা, লী ম্যান হিকে কেন্দ্র করে করোনা ছড়াতে শুরু করে। তার ভক্তরা উহান থেকে দক্ষিণ কোরিয়াতে আসে।করোনা মহামারীর সময় আক্রান্ত জনসংখ্যার ৫০% ছিল এই ধর্মের অনুগামীরা। সেই দেশের জনসংখ্যার ১% এরও কম এই ধর্মের প্রান্তিক মানুষরা কলঙ্কিত হয়ে যান করোনা অতিমারীর দায়ে। সামাজিক দূরত্ব কোরিয়াতে সফলভাবে করোনা আটকাতে সক্ষম হলেও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের সমাজ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়।
শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের করোনার সংক্রমণ সরাসরি ভাবে ভ্রমণশিল্প, বিশ্বায়ন এবং ধর্মের সাথে জড়িত। দুই দেশই প্রথম আক্রান্তরা ছিলেন ইতালি এবং চীনের পর্যটক। তাঁদের থেকে আক্রান্ত হন তাঁদের পদপ্রদর্শকেরা, সেখান থেকে স্থানীয় জনতা। বিদেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কা এবং কেরলের বহু সংখ্যক শ্রমিকের দেশে ফিরে আসা এই অতিমারীর অন্যতম কারণ। শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষ ইতালিতে বৃদ্ধ মানুষের আয়ার কাজ করতেন। শ্রী লঙ্কার ৯০% ছিল ইমপোর্টেড কেস (মার্চ ২২) আর ২০.৫% ভ্রমণশিল্পের সাথে জড়িত মানুষ।
৭ ই মার্চ ইতালি এবং জার্মানি ভ্রমণ করে ফেরা শিখ ধর্মগুরুর মাধ্যমে আনন্দপুর সাহিবের উৎসবে আক্রান্ত হন বহু মানুষ। ২০ টি গ্রামের ৪০,০০০ গ্রামবাসীকে কোয়ারেন্টিন করা হয়।
নিজামুদ্দিনের ঘটনা আরো মারাত্মক। তাবলীঘী জামাতের ধর্মীয় সমাবেশ থেকে প্রচুর সংক্রমণ ঘটে। ৬৪৭ জন ( এপ্রিল ৪) আক্রান্ত হন। শুধু বিদেশি নয়, ভারতের ১৪ টি রাজ্যে সংক্রমণ ছড়ায় সেই সমাবেশ থেকে। মুসলিমদের একেই সমস্যার শেষ ছিল না, এবার পাওয়া গেল তাঁদের হেনস্থা করবার আরেক অজুহাত। তাঁদের থুতু দেবার ফেক ভিডিওতে এখন বাজার ছয়লাপ।
এই সবের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের দরকার ছিল সামাজিক সংহতি। সরকারের সদিচ্ছা স্বাস্থ্যের এই সংকটকে প্রশমিত করতে পারে। সততা এবং সচ্ছতার সাথে মানুষের সামনে সঠিক তথ্য এবং পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তাদের পাশে থেকে, শ্রমজীবী মেহনতী মানুষকে প্রয়োজনমত সাহায্য এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে সামাজিক সংহতির ভীত মজবুত হয়। সংহতি আমাদের যে কোনো সংক্রমণ এবং বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে উদ্বুদ্ধ করে, ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে জনস্বাস্থ্যের দাবিকে অগ্রসর করে। গোপনে খাদ্য, ওষুধ মজুদ করে রাখা, অসুস্থ সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানো এইসব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হোলো সামাজিক সংহতি। সর্বোপরি সামাজিক সংহতি আমাদের বাধ্য করে বৃদ্ধ প্রতিবেশীর যত্ন নিতে, নিরুপায় পরিযায়ী শ্রমিকদের , গরিব শ্রমজীবী মানুষ এবং কৃষকদের সাহায্য করতে।
সামাজিক সংহতি থাকলেই সরকার পুঁজিপতিদের স্বার্থ না দেখে সামাজিক মঙ্গলের কথা ভাববে। যেমন ধরুন “পেইড সিক লিভ”। যদি সরকার এই বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয় তবে আম জনতা উপকৃত হবে কিন্তু পুঁজিপতিদের লাভ কমবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এই সুবিধা দেয় নি। ফলস্বরূপ প্রচুর সংক্রমিত মানুষকে দুবেলা খাবার জন্য কাজ করতে হয়। অবাক হয়ে যাবেন এইটা জেনে যে এই সংক্রমিত মানুষদের অনেকেই আমেরিকার খাদ্যশিল্পের সাথেও জড়িত ছিল।
এইখানেই প্রশ্ন উঠছে যে ক্যাপিটালিস্ট নীতির অনুসরণ আমরা এতদিন করলাম তাকি এই অতিমারির হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে সক্ষম? এই অতিমারি কি ক্যাপিটালিজমের বিশ্বায়ন নীতির ফল? মানুষকে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে কীটনাশক স্প্রে করার যে চিত্র আমরা দেখলাম তা কি সামাজিক বৈষম্যের নগ্ন রূপকে অভিক্ষিপ্ত করে না? এই সামাজিক দূরত্বের নামে কোথাও খ্রিষ্টান, কোথাও হিন্দু, কোথাও মুসলিম ,কোথাও আদিবাসী শ্রমিক কৃষকদের কলঙ্কিত করার উদাহরণ কি আমাদের কাছে যথেষ্ট নয় সামাজিক সংহতি স্থাপনের জন্য?