ভাষা আর কারেন্সির মধ্যে একটা মিল আছে। দুটোরই আন্তর্জাতিকতা নির্ভর করে দাদাগিরির ওপর। যে দেশ যত বড় যত উন্নত তাদের ভাষায় সারা পৃথিবীর লোক কথা বলে, তাদের কারেন্সি সারা পৃথিবীর কারেন্সি হয়ে যায়। রোম যখন পৃথিবীর দাদা ছিল তখন রোমান সোনার মুদ্রায় সারা বিশ্বের লেনদেন চলত। এখন আমেরিকা দাদা তাই সারা পৃথিবীতে সব বাণিজ্যিক লেনদেন ডলারে হয়। ভারতকে প্রচুর তেল কিনতে হয় রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো থেকে। ভারতকে তাদের পাওনা মেটাতে হয় ডলার দিয়ে। এটা শুধু ভারত নয় সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। এই যে সারা পৃথিবীব্যপী ডলার নির্ভরতা এটার মারাত্মক ফল হল আমেরিকার অর্থনীতি ডুবতে শুরু হলে ভারতের তথা বিশ্বের অর্থনীতিও ডুবে যায়। যেদিন ‘ন্যাশড্যাক’, ‘ডাও জোন্স’ নেগেটিভ রিটার্ন দেয় সেদিন আমাদের শেয়ার বাজারও ঝিমিয়ে পড়ে।
আর বেশ কিছু বছর ধরেই ডলারের অবস্থা ভালো না। তার মূল্যমান দিনকে দিন কমছে। সুইস ফ্রাঙ্ক বা জাপানি ইয়েনের সাপেক্ষে তার মূল্য গত পনের বছর ধরে কমেই চলেছে। তার প্রধান কারণ আমেরিকার বিপুল পরিমাণ ঋণ। আমেরিকার ‘ডেট টু জিডিপি রেশিও’ এখন ১২৯। ৭৭ এর ওপরে এই অনুপাত ভালো অর্থনীতির লক্ষণ নয়। অথচ বছর বছর লাগামছাড়াভাবে বেড়ে চলেছে তাদের ‘ফিসকাল ডেফিসিট’ ও বিদেশি ঋণের হার। আমেরিকা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই এই সমস্যা মেটাতে যা করে তা হল অনিয়ন্ত্রিত হারে ডলার ছাপাতে শুরু করে। আর এর ফলশ্রুতিতে বেড়ে যায় মূল্যবৃদ্ধি বা ইনফ্লেশন। এই সমস্যা শুধু আমেরিকার হলে আমাদের মাথাব্যথা হত না কিন্তু আগেই বলেছি ওদের কাছে আমরা ডলারের গাঁটছড়া বেঁধে রেখেছি। তাই সেই মূল্যবৃদ্ধি আমাদের মত গরীব দেশ সহ সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে।
২০০৮ সালে ওয়াল স্ট্রিটের বাঘ লেম্যান ব্রাদার্স ব্যাঙ্ক দেওলিয়া ঘোষণা করার কয়েক দিনের মধ্যে সারা পৃথিবীর ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়ে যায়। রানি এলিজাবেথ তার সহকারীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আচ্ছা এটা যে আসছে ওরা কী আগে কেউ বুঝতে পারে নি’? তাঁর এই কথাটা এখন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হল এখন কি পৃথিবীর অর্থনীতি বিপন্মুক্ত? একেবারেই নয়। আমেরিকার ফেডেরাল রিসার্ভের প্রাক্তন প্রধান পল ভোলকার বলেছেন, “ওপরে ঢেউটুকু শান্ত হয়েছে মাত্র। নীচে সমুদ্রের অশান্তভাব এখনো অব্যহত আছে”। এখন ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ, ইস্রিয়েলের সাথে প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ, তাইওয়ানের দিকে চিনের রক্তচক্ষু কোনোটাই কমার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। তাই আমার মনে হয় ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা এমন একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে আবার একটা আর্থিক অবনমন আমাদের ওপর নেমে আসতে পারে।
সারা পৃথিবীর নেতারা তাই ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছেন। যেহেতু ডলারের রবরবা আগের মত নেই তাই আমেরিকাও কিছুটা ব্যাকফুটে। তাই শুনবেন কিছুদিন আগেও ভারত রাশিয়াকে ইন্ডিয়ান রুপিতে তেলের দাম মিটিয়েছে। যদিও সেই নীতিতে কাজ হয় নি। কিছুদিন আগে মোদিমশাই ভুটানে গিয়ে বললেন যে ভুটানে বিনিময় ইন্ডিয়ান রুপিতে করা যাবে। আর বড় বড় দাদারা এর হাত থেকে বাঁচতে যেটা করছেন তা হল তারা সমানে তাদের ফেডারেল সোনার রিসার্ভ বাড়িয়ে চলেছেন। এদের মধ্যে প্রধান হল আমেরিকার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ, রাশিয়া আর চিন।
সারা পৃথিবীতে যত সোনা খনি থেকে তোলা হয় তার মধ্যে প্রথমে আছে চিন। অনেকদিন আগেই তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এই উত্তোলিত সোনার খুব সামান্য খোলা বাজারে ছেড়ে সেই সোনা অপরিমিত হারে তারা তাদের নিজেদের তিজোরিতে জমা করে রাখছে। রাশিয়াও একই কাজ করেছে। বাজার থেকে তারা বিপুল পরিমাণে সোনা কিনে চলেছে। আপনার কী মনে হয় তারা বোকা? আমার মনে হয় এই দুটো দেশ বহুদিন ধরে ডলারের দাদাগিরির বিরুদ্ধে বলে এবার আসন্ন সমস্যার কথা ভেবে নিজেদের আস্তিনের শেষ তাসটা বের করছে। চিন যেমন সবচেয়ে বেশি সোনা উৎপাদন করে, ভারত তেমনি সবচেয়ে বেশি সোনা আমদানি করে। তার প্রধান কারণ আমরা ভারতীয়রা ফিবছর প্রচুর সোনার গয়না বানাই। তাই সোনার দাম বাড়লে সরকারের খরচ বাড়ে কারণ আমদানিশুল্ক বাড়ে। যেটা এখন হয়ে চলেছে। সামনেই বিয়ের মরশুম, ভোট অথচ সোনার ১০ গ্রামের দাম ৭১,০০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
প্রশ্ন হল সোনার দাম বাড়ে কেন? দেখা যায় ব্যাঙ্কের সুদের হার কমলে সোনার দাম বাড়ে। ব্যাঙ্কের সুদের হার কমলে লোকে আর ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে চায় না, তারা টাকা তুলে নেয় ফলে মূল্যবৃদ্ধি বাড়ে। লোকের হাতে যেহেতু অনেক টাকা তাই তারা সোনা কেনে কারণ এফ ডি, বন্ড কিনে লাভ নেই যেহেতু সুদ কমে গেছে। তাই চাহিদা বাড়ার জন্য সোনার দাম বাড়ে। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। ব্যাঙ্কে সুদের হার কমলে যেহেতু ব্যাঙ্কে টাকা রেখে লাভ নেই তাই অনেক লোক ইকুইটি বা শেয়ার বাজারে টাকা ঢালেন। তাই শেয়ার বাজারও ফুলে ওঠে। তার মানে কিন্তু এমন ভাববেন না যে শেয়ার বাজার উঠলে সোনার দামও বাড়ে। বরং উলটো। শেয়ার বাজার পড়লে যখন লোকে আর ইকুইটির ওপর ভরসা রাখতে পারে না তখন সোনার দাম বাড়ে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমীকরণের মতই সোনার দামও একটা জটিল ম্যাট্রিক্স। তবে এখন শেয়ার বাজার ‘অল টাইম হাই’, বুল রান চলছে। আমেরিকান ফেড বা ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেউই সুদের হার কমায় নি তবু সোনার দাম বাড়ছে। তার একটা কারণ অবশ্যই বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অধুনা লোহিত সাগরে সোমালি দস্যুদের বাড়বাড়ন্ত। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে শেয়ার বাজার বা অর্থনীতি পড়তে শুরু করলে লোকে সোনা কিনতে থাকে। তাই সোনার বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি কি কোনো আসন্ন অর্থনৈতিক ডিপ্রেসনকে ইঙ্গিত করছে?
সোনা সবসময় আমাদের বিপদের অবলম্বন। এই কথাটা ভুলে যাবেন না। তাই আপনার পোর্টফোলিও যাই হোক জমি-বাড়ি বাদে আপনার সঞ্চয়ের ১০ থেকে ২০ শতাংশ সোনায় বিনিয়োগ করুন। এটা আমার উপদেশ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘মানি ম্যানেজার’ হলেন সুইস মানি ম্যানেজারেরা । পৃথিবীর সকল বিচ্ছিরি রকমের বড়লোকদের মানি ম্যানেজমেন্ট তারাই করেন। এটা তাদের উপদেশ। সোনা হল আদর্শ ‘হেজফান্ড’। যদি কোনোদিন শেয়ার বাজার ধ্বসে যায় (যা কোনো একদিন যাবেই), ব্যাঙ্কের সুদের হার অত্যন্ত কমে যায় বা ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যায়- তখন একমাত্র যা আপনাকে বাঁচাতে পারে তা হল সোনা। তাই আপনার রোজগারের কিছুটা অবশ্যই সোনায় নিবেশ করা উচিত।
তবে এই সোনা কিন্তু সোনার গয়না নয়। গয়না কিনে লাভ নেই কারণ গয়নায় যে প্রায় ৩০% মেকিং চার্জ থাকে তা আপনি কোনোদিনই ফেরত পাবেন না। আর ফ্যাশন এমন একটা জিনিস যা বছর বছর পুরনো হয়ে যায়। আজকাল মেয়েরা অনেকেই পুরনো ডিজাইনের বলে তাদের বিয়ের গয়নাও পরতে চায় না। তাই বিনিয়োগের সোনা কিনতে হলে আপনি ‘বুলিওন গোল্ড’ কিনবেন। অর্থাৎ সোনার কয়েন বা বার। আপনি যদি আমীর হন তবে বার কিনতে পারেন তবে বারের সমস্যা হল সেটি যখন আপনি বিক্রি করে দরকারে টাকা চাইবেন তখন আপনার ক্রেতা রাসায়নিক পরীক্ষা না করে আপনাকে টাকা দেবেন না কারণ বারে সোনার পরিমাণ অনেক। তাই আমাদের মত সাধারণ লোকের সোনা কিনতে হলে বিভিন্ন ওজনের ‘বুলিওন কয়েন’ কেনাই শ্রেয়। সোনার কয়েন কিনতে হলে আপনি অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানি থেকেই কিনবেন।
সোনা হয়ত আপনাকে শেয়ার বাজারের মত রিটার্ন দেবে না কিন্তু সোনা আপনার বিপদাপদের অবলম্বন যা খুব খারাপ আর্থিক অবস্থার সময়েও আপনাকে রক্ষা করবে। আর রিটার্ন খুব কম দেবে তাই বা বলি কিভাবে? ২০১৪ সালে দশ গ্রাম সোনার দাম ছিল ২৪,০০০ টাকা। আজ তার দাম ৭১,০০০ টাকা। সোনা প্রায় এখন ১১.৪৬% চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দিচ্ছে। ব্যাঙ্ক আপনাকে ৬.৫% সুদ দেয়। খুব শিগগিরি সুদ আরো কমতে চলেছে। তাই সোনাতে লাভের পরিমাণ কি খুবই কম? এর সাথে নিরাপত্তাটুকু যোগ করুন। দেখুন সেটা মোটেই এলেবেলে নয়। ভীষণ রকমের অনিশ্চিত এই সময়ে সোনার থেকে ভালো ‘লং টার্ম সিকিওরড ইনভেস্টমেন্ট’ এই মুহূর্তে কিছুই নেই।
সোনার দাম এখন খুব বেশি। একটু স্থিতিশীলতা এলে দাম নিশ্চই কমবে তখন পারলে কিছু কিনে রাখুন। নিজের পোর্ট ফোলিওকে ডাইভার্সিফাই করুন। শেয়ার, সোনা, কিছুটা এফ ডি, কিছুটা জি পি এফ বা ই পি এফ (যারা চাকরি করেন), কিছুটা পি পি এফ এসবে ভাগভাগ করে টাকা রাখুন। অবশ্যই শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে সবচেয়ে বেশি টাকা, বাড়তিটুকু বাকিগুলোতে ভাগ করে রাখুন। কখন ঝড় আসবে কেউ জানে না। গরীবের আর বিত্তবানদের জন্য সরকার আছেন আমাদের মধ্যবিত্তদের জন্য আমরাই আছি। অনৈতিক ট্যাক্সের বোঝা আমাদের ঘাড়ে। ঝড় ঝাপটা এলে আমরা যদি আমাদের নিজেদের বাঁচার উপায় না করে রাখি কপালে আমাদের অশেষ দুর্ভোগ আছে।
(আরো অনেক পান্ডিত্য ফলানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি এই কদিনে বুঝেছি আমাদের সকলেরই ধৈর্য কমে আসছে। আর ফেসবুক একদম পান্ডিত্য দেখানোর জায়গা নয়। তার সাথে গরম পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ইকোনমির কচকচি বাড়িয়ে লাভ নাই। তাই আলবিদা।)
(শেষ)