প্রেগনেন্ট হবার পরে হবু বাবা মায়ের কাছে যে বিষয়ে সব থেকে বেশি ফোন আসে তার একটা হল বাচ্চার কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ। এর খরচও খুব কম নয়। এই নিয়ে বিভ্রান্ত বাবা মায়েদের মনে প্রচুর প্রশ্ন থাকে। তাই এই লেখা।
আমেরিকান সোসাইটি ফর ব্লাড অ্যান্ড ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন অনুযায়ী নিজের কর্ড ব্লাড থেকে কোনও শিশুর উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ০.০৪ থেকে ০.০০০৫%।
আমাদের দেশে ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট অ্যান্ড রুলস ১৯৪৫ এর অধীনে কেবলমাত্র ‘প্রাইভেট’ কর্ড ব্লাড ব্যাংক আছে। ইউরোপেও কর্ড ব্লাড ব্যাংক আছে তবে তা ‘পাব্লিক’ কর্ড ব্লাড। সেখানে বিভিন্ন দাতার থেকে কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করে তার টিস্যু অ্যান্টিজেনিক স্টেটাস (HLA status) অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হয়। আর তা লিউকোমিয়ার মতো বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসায় কাজে লাগানো হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই সব পাব্লিক ব্লাড ব্যাংকে কর্ড ব্লাড রাখার জন্য কোনও টাকাও দিতে হয় না এবং তা অন্য রুগীর প্রয়োজনে ব্যবহারও করা যায়।
কিন্তু আমাদের দেশে চিত্রটা একেবারেই আলাদা। চিকিৎসকদের বৃহত্তম সংস্থা ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিশিয়ান বা সংক্ষেপে আই.এ.পি. ২০১৮ সালে একটি বিবৃতিতে একথা জানিয়েছে। সেখানে সমালোচনা করে এও বলা হয়েছে, বেসরকারি কর্ড ব্লাড ব্যাংকের নজরকাড়া প্রচার ও লোকেদের বোকা বানিয়ে টাকা রোজগার করাটা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আর খানিকটা আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে অভিভাবকরা আর্থিকভাবে এই ধরনের সংস্থার কাছে প্রতারিত হতে থাকেন।
‘ভবিষ্যতে বহু রোগের চিকিৎসায় সাহায্য করবে’-বেসরকারি কর্ড ব্লাড ব্যাংকগুলি এভাবেই প্রচার করে।যদিও বাস্তবে সন্তানের সমস্যায় তা খুব কম ক্ষেত্রেই কাজে আসে। কাজেই প্রচারে যা বলা হয় তা একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়। একথা বলাই যেতে পারে যে বেসরকারি কর্ড ব্লাড ব্যাংকের বিজ্ঞাপন, যাকে ‘বায়োলজিক্যাল ইনসিওরেন্স’ বলা হয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তিকর।
কর্ড ব্লাড ব্যাংকের গুণগত মান এবং তার দেখাশোনা মোটেও ভালভাবে করা হয় না আর তার ওপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণও দেখা যায় না।বেশিরভাগ সংস্থার হেড কোয়ার্টার দেশের বাইরে আর সংস্থা যারা চালান তাদের যোগ্যতা নিয়েও সংশয় আছে।এই সংস্থাগুলো আমাদের দেশের জনগণকে শুধুমাত্র ব্যবসার জন্য কাজে লাগায়।
আসলে বেসরকারি সংস্থায় কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করার মানে হল কোনও কাজে না এলেও তার জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থ খরচ করা। আই.এ.পি. জানিয়েছে, জেনেটিক বা বংশগত রোগ নিরাময়ের জন্য নিজের কর্ড ব্লাড ব্যবহার করা যায় না, কারণ তাতে সেই একই মিউটেশন থাকবে।কর্ড ব্লাড কাজে লাগে হাই রিস্ক টিউমারের চিকিৎসায়। যদিও এক্ষেত্রে রোগীর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বা স্টেম সেল নিয়ে চিকিৎসা করলেও একই ফল পাওয়া যায়।সংগ্রহীত কর্ড ব্লাডের পরিমাণ অল্প হওয়ায় একটি পূর্ণ বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে এখনো বেশ কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়েছে।
ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিশিয়ান এই বিষয়ের ওপর পর্যালোচনা করে ২০১৮ সালে এক বিবৃতিতে জানান, প্রায় ৬০% ডাক্তার নির্ধারণ করতে পারেন না, কোন ধরনের চিকিৎসায় কর্ড ব্লাড সেল ট্রান্সপ্লান্ট করা উচিত। প্রকৃতপক্ষে, ৯০% ডাক্তার বিশ্বাসও করেন যে আমবিলিক্যাল কর্ড ব্লাড ব্যবহার করা যায় সেই শিশুরই থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে, যা আসলে সঠিক নয়।
ভারতে বেসরকারি কর্ড ব্লাড ব্যাংকের ব্যবসার পরিমাণ আনুমানিক ১০০০ কোটি টাকা। বাস্তবে ২০ বছর ধরে এই ধরনের ব্যাংকে কর্ড ব্লাড রাখার খরচ পড়ে এক থেকে তিন লাখ টাকা অবধি। এককালীন অথবা মাসিক কিস্তিতে টাকা দিতে হয়। যদিও ঠিক কজন রোগী তাদের কর্ড ব্লাড ভবিষ্যতে ব্যবহার করেছেন তার কোনও সঠিক তথ্য কর্ড ব্লাড ব্যাংকের কাছে নেই অথবা তারা দিতে চান না।কেউ নিজেই নাকি অন্য কোন রুগীর চিকিৎসায় সেই কর্ড ব্লাড ব্যবহার করা হয়েছে সেই বিষয়েও কোন স্বচ্ছ উত্তর পাওয়া যায়না। এভাবেই চলছে এই বৃহত্তর অসামাজিক ব্যবসা।
তথ্য-ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিশিয়ান-২০১৮ নিয়মাবলী