যারা ম্যাক্সিম গোর্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদার’ পড়েছেন তারা পাভেল এবং তার মা আনাকে চেনেন। পাভেলের বাবা মাইকেল ভলাসব ছিল কারখানার শ্রমিক।
ভোর হতে না হতেই কারখানার বাঁশি বেজে ওঠার সাথে সাথে ঢুকে যেত কারখানার ভেতরে। হাতে তুলে নিত হাতুড়ি। সারাদিন সে কারখানার আগুনে কয়লার মত জ্বলে পুড়ে সন্ধ্যার সময় ছাইয়ের মত রাস্তায় এসে পড়ত। সেখান থেকে সোজা চলে যেত ভাটিখানা। হাড়ভাঙা খাটুনি, জীবনের সব হাহাকার, যন্ত্রণা ভুলে থাকতে সারাদিনের রোজগার দিয়ে সস্তার মদ খেত। বাড়ি ফিরে অভুক্ত স্ত্রী আর পুত্রকে ঠ্যাঙাত। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত। পরের দিন ভোররাত্রে আবার কারখানা। অত্যাধিক মদ খাওয়ার ফলে অসুস্থ হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেল সে।
শ্রমিকদের এই দুর্দশার চিত্র শুধু রাশিয়ার একটি শহরের খণ্ডচিত্র নয়। সেই সময় পৃথিবীর যেখানে যেখানে পুঁজিপতি শ্রেণী ও কলকারখানার উদ্ভব হয়েছে, সেই সব অঞ্চলের সামগ্রিক চিত্র।
বাবার মৃত্যুর পর পাভেলও হয়ে গেল কারখানার শ্রমিক। সেও মদ খেয়ে রাতে ফিরতে আরম্ভ করলো। কিন্তু সমাজতন্ত্রী শ্রমিক আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে সে বদলে গেল। বুঝতে পারল কারখানার কাজের বাইরেও একটি সুস্থ জীবন শ্রমিকদের প্রাপ্য। বুঝতে পারল ফল থেকে যেমন রস নিংড়ে ছিবড়ে ফেলে দেয়, তেমনি মালিক শ্রেণী তাদের জীবন থেকে সমস্ত আনন্দ নিংড়ে বার করে নিচ্ছে। তারপর ছিবড়ের মতো পড়ে থাকছে জীবন। মে দিবস পালন করতে গিয়ে গ্রেফতার হলো পাভেল। তার নিরক্ষর মা আনা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে গেল। তাকে নিয়েই ‘মাদার’ উপন্যাস।
যদিও রাশিয়ায় নয়, মে দিবসের সূচনা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ধনতান্ত্রিক দেশে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় কলকারখানা এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর দ্রুতহারে প্রসার ঘটতে থাকে। সাথে সাথে বাড়তে থাকে শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যা।
‘সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত’ – এই ছিলো তখনকার দিনে কাজের ঘণ্টা। ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়াতে জুতো শ্রমিকদের নেতাদের বিরুদ্ধে যখন ষড়যন্ত্রের মামলা চলছিল, তখন প্রকাশ পায় যে, শ্রমিকদের দিনে উনিশ থেকে কুড়ি ঘণ্টাও খাটানো হচ্ছিল।
১৮২০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কাজের সময় কমিয়ে দশ ঘণ্টা করা এবং শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতির জন্য কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট হয় ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। এর ফলে স্থানীয় ভাবে কিছু সফলতা পাওয়া যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে ১৮৬৬ খ্রীস্টাব্দের ২০ শে আগস্ট ৬০ টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করেন। সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা হলো “এই দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে পুঁজিবাদীদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য এই মুহূর্তে প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন হলো এমন একটি আইন পাশ করা- যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যেই সাধারণ কাজের দিন হবে আট ঘণ্টার। এই মহান লক্ষ্য পূর্ণ করার পথে সমগ্র শক্তি নিয়োগ করার সংকল্প আমরা গ্রহণ করছি।”
একই সঙ্গে ঐ বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে সদস্যরা উক্ত দাবীর সমর্থন করেন। ১৮৭২ সালে লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে সদর দপ্তর স্থানান্তরের পরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রথম আন্তর্জাতিক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৮৭৬ সালে সরকারি ভাবে একে ভেঙে দেওয়া হয়।
যে সমস্ত সংগ্রাম মে দিবসের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত তার সূচনা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবার’ নামে একটি শ্রমিক সংগঠন তাদের সম্মেলনে ঘোষণা করে যে – ‘১৮৮৬ সালের ১লা মে তারিখ থেকে দৈনিক আটঘন্টাকেই কাজের দিন বলে গণ্য করা হবে। আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা আমোদ প্রমোদ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম। সারা দেশ জুড়ে শ্রমিকদের মধ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়। ধর্মঘট করার ফলে যে সমস্ত সদস্যকে দীর্ঘকাল কর্মস্থান থেকে বাইরে থাকতে হবে তাদের জন্য ধর্মঘটকালীন সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। ধর্মঘটের দিন ১লা মে ঘোষণার সাথে সাথে সংগ্রামের ব্যাপকতা বেড়ে যায়। ১৮৮১ সাল থেকে ৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৫০০টি ধর্মঘট হয়। ১৮৮৫ সালে দাঁড়ায় ৭০০টি। ১৮৮৬ সালে ধর্মঘটের সংখ্যা আগের বছরের দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়, সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫৭২টি।
১৮৮৬ সালের ১লা মে সমস্ত আমেরিকা জুড়ে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। ধর্মঘটের কেন্দ্র ছিল শিকাগো। ধর্মঘট আন্দোলন সেখানে সবচেয়ে বেশি ব্যাপকতা লাভ করে। তাছাড়াও অন্যান্য শহর, যেমন- নিউইয়র্ক, বালটিমোর, ওয়াশিংটন, মিলওয়াকি, সেন্টলুই, পিটার্সবার্গ, ডেট্রয়েট- ও ১ তারিখের সংগ্রামে সামিল হয়। থমকে যায় কারখানার চাকা, থমকে যায় উৎপাদন।
ওদিকে মালিকপক্ষ ও সরকার চুপচাপ বসে ছিল না। ৩রা মে শিকাগোতে এক কারখানার ধর্মঘটী শ্রেণিরদের সভায় পুলিশ হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছ’জন শ্রমিককে হত্যা করে এবং বহু শ্রমিক আহত হয়। এর প্রতিবাদে ৪ঠা মে হে মার্কেট স্কোয়ারে একটি সভা হয়। সভা শান্তিপূর্ণ ভাবে চলছিল এবং সেদিনকার মতো শেষও হতে যাচ্ছিল। এমন সময় বিনা প্ররোচনায় শ্রমিকদের পুলিশ আবার আক্রমণ করে। চারজন শ্রমিক মারা যায়। পার্সনস, স্পাইজ, ফিসার প্রমুখ নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয় এবং অনেক সংগ্রামী নেতাকে জেলে পোরা হয়। তাঁদের এই আত্মবলিদান ব্যর্থ হয়নি। তিন বছরের মধ্যেই মে দিবস পরিণত হয় একটি আন্তর্জাতিক দিবসে।
১৮৮৯ সালে বাস্তিল দূর্গ পতনের শতবার্ষিকী উপলক্ষে নানা দেশ থেকে সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের নেতারা প্যারিসে জড় হন। তাঁদের লক্ষ ছিল প্রথম আন্তর্জাতিকের ছাঁচে নতুন একটি সংগঠন তৈরি করা। পরবর্তী কালে যার নাম হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক। এই সম্মেলনেই দেশ বিদেশের প্রতিনিধিরা আমেরিকার প্রতিনিধিদের কাছে শুনতে পেলেন মে দিবসের আট ঘণ্টার কাজের দাবিতে আন্দোলনের কাহিনী। আমেরিকান শ্রমিকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১লা মে আন্তর্জাতিক বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ফলশ্রুতি হিসাবে পরের বছরই ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা সহ বহু দেশে শ্রমিকেরা ১লা মে ধর্মঘট করে।
সমাজতন্ত্রীদের স্বর্গ রাজ্য রাশিয়াতে কিন্তু প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯শে এপ্রিল তারিখে। কারণ সেসময় পশ্চিম ইউরোপের ক্যালেন্ডার থেকে রাশিয়ার ক্যালেন্ডার ১৩ দিন পিছিয়ে ছিল।
মে দিবস আন্দোলনে আট ঘণ্টার কাজের দাবির সাথে আরও সব তাৎপর্যপূর্ণ দাবি যুক্ত হয়। যেমন- সার্বজনীন ভোটের অধিকার, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক অত্যাচারের বিরোধিতা, মিছিল ও ধর্মঘটের অধিকার, রাজবন্দীদের মুক্তি, শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন গড়ার অধিকার ইত্যাদি। মালিকপক্ষের সমস্ত দমন ও পীড়নকে অগ্রাহ্য করে মে দিবস শ্রমিকদেত মধ্যে ধীরে ধীরে আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করে। লাগাতার আন্দোলনের ফলে তারা অনেক দাবি আদায় করতে সমর্থ হয়।
বিভিন্ন সংস্কার পন্থী দলের নেতারা বারবার চেষ্টা করেছে মে দিবসের গুরুত্ব খর্ব করতে। সংগ্রামের দিনের পরিবর্তে বিশ্রাম ও আমোদ প্রমোদের দিনে পরিণত করতে। এর জন্য তারা চেষ্টা করত মে দিবস মে মাসের প্রথম রবিবার পালন করতে। কারণ রবিবার শ্রমিকদের ধর্মঘট করার প্রয়োজন হবে না। রবিবার এমনিতেই কারখানা বন্ধ থাকে। ১৯২৮ সালে আমেরিকাতে ১লা মে কে শিশু স্বাস্থ্য দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। লক্ষ যেন তেন প্রকারেণ ১লা মে’র মে দিবস বা কমিউনিস্ট দিবস হিসাবে পরিচিতি নষ্ট করা।
তবু একশো চল্লিশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আজও লক্ষ লক্ষ শ্রমিক একই রকম উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে মে দিবস পালন করে। মে দিবস আজও মানুষকে স্বপ্ন দেখায় শোষণ পীড়নমুক্ত সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পথ প্রস্তুত করার।
১লা মে, ২০২৪