বিদায় সহযোদ্ধা
_________________
আলগা পাথর পাহাড়, পাশে পাতাল ছোঁয়া খাদ
ডাকবে হঠাৎ, ছেলে আমার রাখেনি সংবাদ।
অথচ এই ছেলেটা তার মেধাবী দুই হাতে,
চারপাশকে আগলে রাখত; বিপদে সংঘাতে!
মধ্যবিত্ত এই জীবনে আঘাত দিতে দিতে,
স্বপ্ন দিত; পৌঁছে দেবে নতুন পৃথিবীতে।
পাহাড় ঠেলে চলতো ছেলে।
জল রাখিনি চোখে…
পাহাড় তুমি ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও ওকে…
___________________________________________________
তাপস ছিল আমাদের সহযোদ্ধা। কেউ প্রশ্ন করতেই পারে, সেকি? তবে যে শুনেছিলাম, সেনাপতি? ঠিকই, সেনাপতিও। কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা সেনাপতি। সে তো সহযোদ্ধাই! শেষ দেখা হয়েছিল আয়লা বিধ্বস্ত সুন্দরবনে। স্বাস্থ্যভবন থেকে যাওয়া তাপস ছিল, যেমনটি হওয়া উচিত; পরিকল্পনার সাথে দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজন। সেই যথেষ্ট কঠিন কাজটা ভোরবেলার মধ্যে সেরে নিয়ে, তাপস আমাদের সাথে বেরিয়ে পড়ত ক্যাম্পে, রোজই। আর যে কদিন ছিল গোসাবায়, ক্যাম্প থেকে ফেরার পর আবার তার প্রশাসনিক কাজ সেরে, হতক্লান্ত ছেলেটা, না আলাদা থাকার যে ব্যবস্থা ছিল, সেখানে যেত না। ও এসে ঢুকত আমাদের পঁচিশজনের জন্য বিরাট মশারি টাঙানো ঢালাও বিছানায়।
কি ভুল, কি ভুল! শেষ দেখার কথা দিয়ে শুরু করলাম। কথাতো শুরু হওয়ার কথা প্রথম দেখার কথা দিয়ে। আজ থেকে প্রায় তিন যুগ আগে, কলেজে আলাপ হল। ও আর শম্ভু তখন সতের আঠার। আমি কুড়ি। জানলাম, সামান্য তোতলা এই ছেলে, অসাধারণ গান করে। সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, পিট সিগার, পল রোবসন, গণনাট্যের গণসঙ্গীতের আরও কতজন অনায়াসে নেমে আসেন ওর গলায়। আবার নাটক করে, লেখেও। তখনও জানিনি, এসব ছিল ছদ্মবেশ। মানুষজনের কাছে গিয়ে মিশে যাবার, তাদের আপন করে নেবার আর নতুন দুনিয়ায় পৌঁছোনোর এক অবাক যুদ্ধের নিয়মকানুন শেখানোর জন্য এই ছদ্মবেশ সে নিয়েছিল। আমাদের সময়কে ঘিরে তখন দ্রুত নেমে আসছে অন্ধকার। খুব সঠিকভাবে তাপসদের লিটল ম্যাগাজিনের নাম ছিল “সংশপ্তক”। চারপাশে গর্জমান কুরুক্ষেত্র।
তারপরের পঁয়তিরিশ বছর, সেই কুরুক্ষেত্রেই কেটে গেল আমাদের। না কি এই রণাঙ্গনের কোনও শেষ নেই! আমরা কেউ থেকেছি তার পাশে, কেউ কেউ থাকিনি। ক্লান্ত রণত্যাগী বন্ধুদের লড়াইয়ে ফেরানোর কি আপ্রাণ চেষ্টা তার। আমরা সাক্ষী। চারদিক থেকে এগিয়ে এসেছে মধ্যবিত্ত লোভের তীব্র সপ্তরথী। বন্ধুরা অনেকেই ভুলেছি সেই অস্ত্র প্রতিরোধের, সেই উপঢৌকন ফেরানোর নিয়ম কানুন। আমরা সবাই জানতামও না। শুধু একা সেনাপতি জানত, যুদ্ধশেষ হবার আগে রণক্ষেত্র ছাড়তে নেই। আর যেহেতু এই যুদ্ধ শেষ হয়না কোনওদিন, তার লড়াই সে জারি রাখে, প্রকাশ্যে ও গোপনে। গৌতমের অসুস্থতার সময়, একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে হাসপাতালের বাইরে বসে, তবুও সমকালের হিসেব বুঝিয়ে দেয় পিছিয়ে পড়া কাউকে। জিজ্ঞেস করে জনে জনে, পুরুলিয়ার শুখা গ্রাম দিয়ে কাজ শুরু করলে কেমন হয়? কানের কাছে ফিসফিস করে তার নতুন হয়ে ফিরে আসা পুরোনো ইচ্ছে, সুন্দরবনের জল, অনাহার, রোগব্যাধির মধ্যে ঝাঁপাব এবার, রাঙ্গাবেলিয়া, চরঘেড়ি আর কুমিরমারিতে। আসবে নাকি, সাথে?
আর এভাবে একলা এগোনোর সুদীর্ঘ অভ্যেসই বোধহয় ওকে একটা বিপজ্জনক স্বভাব তৈরি করে দিয়েছিল। অন্তত কিছুটাতো বটেই। মানে, ওই মানসিকতা। আর কেউ না পারুক, আমি পারবই, আমাকে পারতেই হবে। আর সেটা সঞ্চারিত হয়েছিল ওর প্রাত্যহিক চলাফেরায়ও। চব্বিশ পরগনায় এএইচএসডির বার্ষিক সম্মেলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত। ঘাবড়ে না গিয়ে কে আবার সাজিয়ে তুলবে সাথীদের নিয়ে, সমস্ত মণ্ডপ আর স্টল? তাপস সেন। সুন্দরবনে সন্দেশখালির ব্যাঘ্রপ্রকল্পের পাশে রাত এগারোটায় নৌকোর প্রপেলারে খড় আটকেছে। নৌকো নিথর। মেরামতে ব্যস্ত মাঝিরা হুকুম দিয়েছে ওপরে দাঁড়িয়ে বাঘ আসছে কি না পাহারা দিতে। কে দেবে? ম্লাণ চাঁদের আলোয় গলুইএ দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে আছে তাপস। পাহাড়ে পাকদন্ডীতে, যেখানে পঞ্চাশ পেরুনো মানুষজনের হামাগুড়ি দিয়ে পেরোনোর কথা, হয়তো বা যাওয়াই বারণ, কে যায় সেই পথ দিয়ে? কেন, তাপস! দীপঙ্কর বারবার সাবধান করেছে, হার্টের অসুখ। তবু অকুতোভয়। কে? তাপস!
আমার মত ভীতু কেউ কেউ হয়তো মনে মনে চাইতাম, তাপস সেন একটু পাল্টাক। পাল্টে যাক আমাদের ঘরের মানানসই উচ্চতায় আর আয়তনে। পুরোপুরি “পাপোশ সেন” না হোক, অন্তত আমাদের মাপমতন “আপস সেন”। হয় নি। হওয়া সম্ভবও ছিলনা। জীবনে কখনও পা পিছলোয়নি। পদস্খলনের অভ্যেসই তৈরি হয়নি ওর। তাই প্রথম পদস্খলনেই, সম্পূর্ণ অন্য প্রেক্ষাপটে যদিও, আমাদের বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠল বহুপঠিত পঙ্ক্তি …… হৃদি ভেসে গেছে অলকানন্দা জলে …
A real life hero who made many things possible and never regretted much flowing against the tide, so very sorry to have lost him .