হবিট মানুষ
“একদিন হয়েছে কি, হবুচন্দ্রের দেশের জেলেরা একটা এঁধো পুকুরে জাল ফেলতে গিয়েছে। সেই পুকুরে কোত্থেকে একটা শূয়র এসে ঝাঁঝি পাটার ভিতরে গা ঢাকা দিয়েছিল; জেলেরা জাল ফেলতেই সে গিয়েছে তার মধ্যে আটকে, তারপর জাল টেনে তুলে সেই শুয়র দেখতে পেয়েই ত জেলেরা ভারি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে। তাদের দেশে আর কেউ কখনো এমন জানোয়ার দেখে নি। তারা কিছুতেই ভেবে ঠিক করতে পারল না, এটা কি জানোয়ার। … সেই শূয়রটাকে খুব করে জাল দিয়ে জড়িয়ে তারা রাজার সভায় নিয়ে এল। … যে-সব পণ্ডিত সেখানে ছিল তারা দু দল হয়ে গেল। কয়েকজন বললে, ‘গজক্ষয়’, অর্থাৎ, হাতি ছোট হয়ে গিয়ে এমনি হয়েছে। কেউ বলে, মূষা বৃদ্ধি, অর্থাৎ ইদুর বড় হয়ে এমনি হয়েছে।”
.
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা।
(চিত্র ২)।
আজকের দিনে উপেন্দ্রকিশোরকে চেনাতে গেলে বোধহয় বলতে হবে তিনি সুকুমার রায়ের বাবা আর সত্যজিতের ঠাকুর্দা ছিলেন। সুকুমারের মত উদ্ভট কাহিনি লেখার জন্য উপেন্দ্রকিশোর বিখ্যাত ছিলেন না বটে, কিন্তু শিশুকাহিনির আড়ালে দিব্যি অ্যাবসার্ডিটির চর্চা করে গেছেন। হাতি ছোট হয়ে বা ইঁদুর মোটা হয়ে শুয়োর—এমন অ্যাবসার্ড ভাবনা তাঁর মাথাতে খাসা খেলত।
.
তবে কিনা, হাতি ছোট হয়ে শুয়োরের সাইজ পেতে পারে, এটা মিথ্যা নয়।
(চিত্র ৩)
গজক্ষয় হয়। এমনকি মূষা বৃদ্ধি, ইঁদুর মোটা হয়ে প্রায় শুয়োর-সাইজ—এমনও হয়।
(চিত্র ৪)
উপেন্দ্রকিশোর এসব দেখে যাননি। এই সেদিন, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ২০০৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপে এক মানুষের আংশিক জীবাশ্ম খুঁজে পেলেন।
(চিত্র ৫)
এরা আজ থেকে ৯৫ হাজার বছর আগে থেকে ১৭ হাজার বছর আগে ফ্লোরেস দ্বীপে থাকত। তিন ফুট লম্বা, ২৫-৩০ কেজি ওজনের এই মানুষদের সঙ্গ দিত হয়তো কোমোডো ড্রাগন, যা আসলে এক বিরাট গিরগিটি।
(চিত্র ৬)
এখন সেখানে এইরকম ড্রাগনের পাশাপাশি থাকে বিরাট ইঁদুর। এই ছোট্টখাট্টো মানুষদের নাম রাখা হয়েছে হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস, তবে এরা ‘হবিট’ নামে বেশি পরিচিত। ইংরেজ লেখক জন রোনাল্ড টলকিয়েন-এর লেখা ‘দ্য হবিট’ আর ‘দ্য লর্ড অফ দ্য রিংস’-এর ছোট কিউট মানুষের নাম হল হবিট।
(চিত্র ৭)
এরা আমাদের স্বগণ, হোমো, অর্থাৎ মানুষ। প্রশ্ন হল, ইঁদুর আর গিরগিটি বড় হল, আর মানুষ ছোট হয়ে গেল কেন? আজ্ঞে না, মানুষ একা ছোট হয়নি। বড় জন্তুরা ছোট হয়েছে আর ছোট জন্তুরা হয়েছে বড়। এটা হল বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অভিযোজনের একটা সাধারণ চিত্র।
মাদাগাস্কার, মরিশাস, সার্ডিনিয়া—সর্বত্র দ্বীপে একই জিনিস দেখা গেছে। হাতি, হিপো, এমনকি ছাগল ছোট হয়েছে, আর গিরগিটি, ইঁদুর বড় হয়েছে। হয়তো মহাদেশ থেকে ভূতাত্ত্বিক কারণে দ্বীপ গেছে বিচ্ছিন্ন হয়ে। সেখানে বড় জন্তুরা ছোট জায়গার মধ্যে কম খাবার পেয়েছে, তারা বামনাবতার হয়েছে। আর ছোট জন্তুরা কম প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনে পড়েছে, হয়তো তাদের শিকার করা জন্তুরা কমে গেছে—তারা হয়েছে দৈত্যাকার।
.
হবিট মানুষ সম্ভবত হোমো ইরেক্টাস-দের একটি শাখা থেকে উদ্ভূত। ইরেক্টাস-দের আকার ছিল প্রায় আমাদেরই মত।
.
কেমন হত আজকে যদি কোনও দ্বীপে হঠাৎ পাওয়া যায় এমন কোনও বামন মানব? যারা আমাদের মত হোমো সেপিয়েন্স নয়, কিন্তু হোমো গণের একজন, আমাদের তুতো ভাই!
চিত্র পরিচিতি
১) হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী
২) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
৩) ইটালির সিসিলি দ্বীপের বামন হাতি (বর্তমানে বিলুপ্ত)
৪) ফ্লোরেস দ্বীপের দৈত্য-ইঁদুর
৫) ফ্লোরেস মানুষের জীবাশ্ম
৬) কুমির নয়, ফ্লোরেস দ্বীপের দৈত্য গিরগিটি, হরিণ শিকারের তালে আছে
৭) হবিট মানুষের কল্পিত চিত্র। সে দৈত্যাকার ইঁদুর শিকার করেছে।
৮) ইন্দোনেশিয়ার মানচিত্রে ফ্লোরেস দ্বীপ
.
তথ্যসূত্র
Daniel Liebermann. The story of the human body. Penguin, 2014