শাসকদলের মন্ত্রী-সান্ত্রীদের ঘর থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হতে দেখেছি – এমনকি তাঁদের বান্ধবী বা দেহরক্ষীদের ঘর থেকেও – আর এবারে দেখছি শাসকদলের চিকিৎসকদের হাতে গোছা গোছা ব্যালট।
তবে এটুকু স্বীকার করতেই হয়, মন্ত্রী-সান্ত্রীদের চক্ষুলজ্জা এই চিকিৎসকদের তুলনায় ঢের বেশি, কেননা নেতা-মন্ত্রীরা কেউই বলেননি, আমজনতা নিজেদের সঞ্চয়ের টাকা ভালোবেসে নেতাদের হেফাজতে জমা রেখে গিয়েছিলেন, যাতে টাকাটা নিরাপদে থাকে। কিন্তু চিকিৎসক নেতারা বলছেন, এই শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে ব্যালট নাকি চিকিৎসকরা স্রেফ বিশ্বাস করে আর ভালোবেসে তাঁদের হাতে দিয়ে গিয়েছেন। যাক গে, সব দেখেশুনে আমার মনের মধ্যে থাকা আলতো সন্দেহটা উত্তরোত্তর বদ্ধমূল বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে – শিক্ষিত লোকেরা যখন দুর্নীতিবাজ রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠেন, তখন তাঁরা অতি বিপজ্জনক গোত্রের তিলেখচ্চরে পরিণত হন।
এদিকে এত এত চিকিৎসক ‘ভালোবেসে’ ‘বিশ্বাস করে’ যাঁদের হাতে ব্যালট তুলে দিলেন, সেই সংগঠনের তেজ এমনই যে ব্যালট জমা করার সময় চিকিৎসক জুটল না। জমা দিতে এলেন মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী, যিনি কিনা এর আগেও চিকিৎসকদের নির্বাচনে ছাপ্পা ভোট দিতে গিয়েছিলেন। কার হয়ে? ডা সুদীপ্ত রায়ের হয়ে। কে জানিয়েছেন এই কথা? শাসকদলের সাংসদ ডা শান্তনু সেন স্বয়ং। জমা দিতে এলেন আর কে? শাসকদলের ছুটকো এক কর্মী। চিকিৎসা পেশার ধারেকাছেও নেই তিনি। বিজয়া দশমীর দিন তিনি মাননীয় সুদীপ্ত রায়কে ‘গুরু প্রণাম’ জানিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিসহ সেই আন্তরিক প্রণাম। অতএব…
এমন সব মহাপ্রাণের দোসর সঙ্গী ছিলেন আরজিকর মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষানবিশ চিকিৎসকও। তাঁর অভিজ্ঞতা কম। উপরিউক্ত দুজন পিছলে বেরিয়ে গেলেও পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন তিনিই। এই ঘটনা থেকে তিনি শিক্ষা নিতে পারেন। ঝানু তোলাবাজ চিটিংবাজদের সঙ্গে মিশে তড়পাতে ভালো লাগলেও কাজটা ঝুঁকির, তদুপরি সে লাইনেও অভিজ্ঞতা লাগে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পথটিও তেমন মসৃণ নয়। তার চাইতে ঢের কম ঝুঁকি নিয়ে তিনি ডাক্তারিটা শিখে নিতে পারেন। মোটর-মিস্ত্রি মুন্না বা তারা-মায়ের সামনে ভাব-বিহ্বল বেকার যুবক শুভময়ের মতো গ্ল্যামারাস জীবন হয়ত ডাক্তারিতে নেই, কিন্তু অল্পবিস্তর সম্মান ইত্যাদি রয়েছে। দুটো পথ দুরকম। বেছে নেওয়ার সময় এখনও রয়েছে।
তাছাড়া, বর্তমান শাসক দলের হাল যেরকম, অদূর ভবিষ্যতে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছাকাছি থাকতে হলে জেলে থাকার পরিকল্পনা কষা ভালো। ডা সুদীপ্ত রায় ধনী মানুষ। নিজস্ব নার্সিংহোম আছে, সমাজের অভিজাত স্তরে ওঠাবসা আছে, অভিজাত ক্লাবে কলকাঠি নাড়তে পারার লেভেলে সামাজিক প্রতিষ্ঠা আছে। সরকার উল্টে গেলে তাঁর করেকম্মে খেতে সমস্যা হবে না, আগের সরকারের সময়ও হয়নি। কিন্তু বাপ-মায়ের কষ্টার্জিত পয়সায় নিট টপকে যাঁরা ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছেন – বাপ-মায়ের অনেক স্বপ্ন তাঁদের নিয়ে, দাদাগিরির সাময়িক তৃপ্তি বাদেও অল্পবিস্তর স্বপ্ন, সম্ভবত, তাঁদের নিজেদেরও রয়েছে – শাসকদলের হয়ে দাপাদাপি করতে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎটি খোয়ালে ডা সুদীপ্ত রায়ের মতো তাঁদের ‘ফলব্যাক অপশন’ নেই। একটু ভেবে দেখবেন, প্লিজ। তদুপরি মনে রাখবেন, গত এক দশক যাবৎ, ডাক্তারদের বিপদে-আপদে পাশে ছিলাম আমরাই, অর্থাৎ এই জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা দৌড়ে গিয়েছি নিগৃহীত বিপদগ্রস্ত ডাক্তারদের পাশে দাঁড়াতে। এমনকি মেডিকেল ছাত্রছাত্রীরা বিপদে পড়লে সেখানেও পাশে দাঁড়িয়েছি। শাসক-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক সংগঠনের টিকির ডগাটুকুও দেখা যায়নি।
সেটা অবশ্য শাসক-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকদের দোষ নয়। শাসকের নিয়মই এই। প্রয়োজনে ব্যবহার এবং তার পর ছেঁড়া পাপোশের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। হ্যাঁ, যতদিন শাসকের রমরমা থাকে, ততদিন সেই ক্ষমতার সঙ্গে মাখামাখি করতে পারার একটা আরাম রয়েছে, ক্ষমতার আলো অল্পবিস্তর প্রতিফলিত হয়ে নিজের মুখে পড়লে নিজেকে বেশ একটু হনু ভাবতে পারার পরিতৃপ্তিও রয়েছে – তারই মধ্যে যাঁরা ধনুর্ধর, তাঁরা চুরি-চিটিংবাজি-ধান্দাবাজির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি আখেরও গুছিয়ে নিতে পারেন – কিন্তু সে আর ক’জনই বা!!
ডা সুদীপ্ত রায় এবারের “সরকারপন্থী” চিকিৎসক প্যানেলের নেতা। কথাটা তাঁরাই বলছেন। “ডা সুদীপ্ত রায়ের নেতৃত্বে সরকারপন্থী চিকিৎসক প্যানেল”।
নিজেকেই প্রশ্ন করুন, গত এক দশকে রাজ্য জুড়ে যে কয়েকশো চিকিৎসক নিগৃহীত হয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক, সুদীপ্তবাবু সামান্য একখানা প্রতিবাদের বিবৃতি অবধি দিয়েছেন কি?
যাঁর ট্র্যাক রেকর্ড এমন নিরবিচ্ছিন্ন নিস্পৃহতার, নির্বাচিত হলে তিনি আপনার পাশে থাকবেন?
যিনি ব্যালট জমা দেওয়াচ্ছেন চিহ্নিত সমাজবিরোধীদের হাত দিয়ে, সমাজবিরোধীদের হাতে আপনি নিগৃহীত হলে তিনি আপনার পাশে থাকবেন?
আরও বেসিক একটা প্রশ্ন। গতকাল তাঁর হয়ে ছাপ্পা ব্যালট জমা দিতে গিয়ে আরজিকর মেডিকেল কলেজের যে ইন্টার্ন পুলিশের হাতে ধরা পড়ল, সুদীপ্তবাবু এমনকি তার পাশেও সেভাবে দাঁড়ালেন কি??
আর আপনি ভাবছেন, “ডা সুদীপ্ত রায়ের নেতৃত্বে সরকারপন্থী চিকিৎসকদের প্যানেল” আপনার জন্য লড়বে!!!!
বলিহারি আশা কিন্তু আপনার।