করোনা মহামারী গোটা বিশ্বে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে ভয়ংকর ভাবে, আমরা গত বছর থেকে দেখেছি বেশ কয়েকবার লকডাউন, আমরা হারিয়েছি অনেক সহনাগরিকদের কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি; আমরা লড়াই করেছি এবং এখনো লড়ছি এই মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা সর্বাগ্রে দাড়িয়ে রয়েছেন, তাঁরা ক্লান্তিহীনভাবে নিজেদের কর্তব্য পালন করে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আত্মবলিদান দিয়েছেন এই যুদ্ধে; তাঁদের স্মৃতিতে গতবছর জাতীয় চিকিৎসক দিবস কোভিড শহীদ চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। এই লড়াইতে ডেন্টাল সার্জনরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাঁদের পরিস্থিতি শোচনীয়।
রাজ্যের ডেন্টাল সার্জনদের সার্ভিস ক্যাডার, “ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল সার্ভিসে” আজ প্রায় ৫ বছর হতে চললো কোনো নিয়োগ হয়নি।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল সার্ভিস ক্যাডারের জন্যে ২০১৫-এর ডিসেম্বর মাসে শেষ নোটিফিকেশন করেছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড, তারপরে আর নিয়োগ হয়নি এই ক্যাডারে। West Bengal Dental Education Service পরীক্ষা ২০১৯ এ নেওয়া হয়েছিলো ৫২ টি পোস্টে মাত্র, BDS সেখানে অ্যাপ্লাই করতে পারলেও সেটা Dental Surgeon Cum Clinical Tutor Demonstrator পোস্ট ছিলো, সুতরাং বিশেষজ্ঞ দন্ত শল্যচিকিৎসক পোস্ট, মেডিক্যাল কলেজ এবং ডেন্টাল কলেজে পোস্টিংয়ের জন্যে।
National Health Mission-এর বা DEIC ডেন্টাল সার্জন (RBSK) পোস্টগুলো একে চুক্তিভিত্তিক পোস্ট তার ওপরে রাজ্য সরকারের পোষ্ট নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রজেক্টের পোষ্ট এবং সেই সংখ্যাটাও প্রয়োজনের অনুপাতে অনেক কম।
বর্তমানে গোটা রাজ্যে ইন সার্ভিস ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা সরকারী হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৭০০ একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী (সংবাদ প্রতিদিন, তাং: ৩রা মে, ২০২০) এবং STATE BUREAU OF HEALTH INTELLIGENCE, DIRECTORATE OF HEALTH SERVICES, WEST BENGAL কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-২০১৮ সালের কম্বাইন্ড রিপোর্টে ৩১/১২/২০১৬ পর্যন্ত ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল সার্ভিসে (WBDS) গোটা রাজ্যে চিকিৎসক সংখ্যা মাত্র 518 জন, ডেন্টাল এডুকেশন সার্ভিসে (WBDES) প্রায় 50 জন তাছাড়া কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, স্টেট আর্বান ডেভলপমেন্ট অথরিটি, পঞ্চায়েত এবং রুরাল ডেভলপমেন্টে 53 জন; সব মিলিয়ে 621 জন চিকিৎসক মাত্র গোটা রাজ্যে! এদিকে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল সার্ভিস ক্যাডারের বয়স ৩২ বছর UR ক্যাটাগরি অনুযায়ী। তাইলে এই ৬ বছর নিয়োগ বন্ধ রাখার জন্যে কতজন ছেলে মেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন যাঁদের বয়স ৩২ পেরিয়ে গেছে বা ১.১.২০২২ এ বয়স শেষ হয়ে যাবে?? তাঁদের অধিকার ছিলোনা সার্ভিস করার? তাঁদের অধিকার ছিলোনা পরীক্ষাতে অন্তত বসার সুযোগ পাওয়ার? এর জবাব কে দেবে????
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল সার্ভিস ক্যাডারে মূলত চিকিৎসকদের নিয়োগ করা হয় Block Primary Health Centre/RH লেভেলে, যেখানে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি এবং সাধারণ মানুষের মৌখিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো। ডেন্টাল সার্জনদের নিয়োগ বন্ধ থাকলে এই রুরাল হাসপাতালগুলোতে জনসাধারণের মধ্যে ওরাল ক্যান্সার স্ক্রিনিং এবং ওরাল ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতার প্রসারের বিভিন্ন বিষয়গুলো মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিটি PHC, BPHC/ Rural Hospital, SD Hospital এবং District Hospital-গুলিতে রাজ্য সরকারের হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড (WBHRB) কর্তৃক স্থায়ী ডেন্টাল সার্জন (Dental Surgeon) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ওরাল হেল্থ কেয়ার প্রোভাইডারদের (Oral Health Care Provider) সমবন্টনের (Equal distribution) মাধ্যমে জনসাধারণের মৌখিক স্বাস্থ্যের অধিকার রক্ষা, মুখের ক্যান্সার (Oral Carcinoma) সম্পর্কিত স্ক্রিনিং, প্রারম্ভিক চিকিৎসা এবং অন্যান্য মুখ গহ্বরের রোগ সম্পর্কে সচেতনতার প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে।
একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট পড়ে রীতিমত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে, স্রেফ তিনমাসে মুখের এবং গলার ক্যানসার রোগীর সংখ্যা IPGMER & SSKM হাসপাতালে ২৪০০! ভয়ানক!
আরো বেশী ভয়ানক বিষয় এই বিপুল সংখ্যক মুখের এবং গলার ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশেরই প্রথম দিকেই উপসর্গ ধরা পড়ছেনা, বিলম্ব হওয়াতে চিকিৎসা আরো জটিল হয়ে পড়ছে। এই অবস্থার কারণ কি? কেন এমন হচ্ছে? কারণ জানতে হলে আমাদের একটু চোখ নিয়ে আনতে হবে শহরতলী এবং গ্রামগুলোর দিকে। আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি ভাবে নির্ভর করে গ্রামের সাব সেন্টার, প্রাইমারী হেলথ সেন্টার এবং ব্লক লেভেলের রুরাল হাসপাতালগুলোর পরিষেবার ওপরে। এই বিপুল সংখ্যক মুখের এবং গলার ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের একটা সিংহভাগ শহরের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আসে গ্রামের থেকে। আপনারা যদি একটু পরিসংখ্যান দেখেন চিকিৎসক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাহলে দেখবেন শেষ ৬ বছরে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে, যেই দন্ত চিকিৎসক বা ডেন্টাল সার্জনরা গ্রামীণ এলাকার হাসপাতালগুলোতে মুখের এবং গলার ক্যানসারের প্রারম্ভিক উপসর্গগুলো দেখে বুঝতে পারতেন যার ফলে প্রথম দিকেই রোগ ধরা পড়ে যেত এবং রোগীর এবং রোগীর পরিবারের হয়রানি অনেকটাই কম হত, মুখের এবং গলার ক্যানসার প্রতিরোধে এবং সচেতনতার প্রসারে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা নিতে পারতেন তাদেরকেই আর নিয়োগ করা হয়না। তার মাশুল দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ এবং তার প্রতিফলন এই ৩ মাসে ২৪০০ ক্যানসার রোগীর পরিসংখ্যান।
আশা রাখবো রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এই পরিসংখ্যানগুলো দেখে এই অচলাবস্থা নিরসন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। নতুন করে ডেন্টাল সার্জনদের নিয়োগ দরকার কারণ একেকটা ব্লক মাত্র একজন চিকিৎসকের পক্ষে সামলানো খুব কঠিন। সরকার গ্রামীণ এলাকার মানুষদের জন্য সরকারী হাসপাতালে হাতুড়েদের নিয়োগ করলে আখেরে ক্ষতি জনস্বাস্থ্যের, তার জায়গায় মডার্ণ মেডিসিনের গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ করে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব, সে বিষয়ে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত।