বইমেলায় যতবার যাই ততবার দেখি মেলার মাঠের সবুজ ঘাসে চুঁইয়ে পরছে কিছু সুখ কিছু দুঃখের সব অতি চেনা পরিচিত সব ছবি। কেউ দু হাতে নতুন কেনা বইটা খুলে নাক ডুবিয়ে ধরে সুঘ্রাণ নিচ্ছে যে গন্ধ নবান্নের শালিধানের চেয়েও তীব্র, নতুন বউ এর চেয়েও মাদকতাময়। কেউ বা আবার ঘাসের ওপর বসে পাখির ঘরে ফেরার পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় পড়ে চলেছে নতুন বই এর নতুন অক্ষর মালা। স্টলে বাবার হাত ধরে ঝুলে পড়েছে আবদারে কাতর বাচ্ছা আর তার মা প্রথম মলাটের পেছনে মুদ্রিত দামটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেখে দিচ্ছে তাকে।
একগাদা বই আর ক্যাসমেমোর সামনে উদ্যত পেন্সিল দোকান কাকুর সামনে থমকে থেমে থাকা কলেজ পড়ুয়া তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত ললাটে ভ্রূকুঞ্চন জন্মেছে, বইগুলো কিনে বাড়ি ফেরার বাস ভাড়াটা বেঁচে থাকবে তো।
অনেকদিন ধরে জমানো টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করা বই হাতে প্রসাধনহীন তরুণীর মুখ ঝকঝকে খুশিতে ভরে যাচ্ছে প্রিয় কবির সই শিকারের পরে।
এর পাশাপাশি অশ্লীলতা দায়ে অভিযুক্ত পেটমোটা পার্স বের করে ফ্রান্সিস সমগ্রের দাম মেটানোর সময় ধরা পরে যাই মিটিমিটি হাসি নিয়ে পাশে হাজির জীবনসঙ্গিনীর কাছে। আমতা আমতা করে একটা সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করি আরে এতো জোজোর জন্য কিনলাম যদিও জানি আমার কুইজ চ্যাম্পিয়ন কিশোর পুত্র একশ পাতার ওই বইতে ভাইকিং নিয়ে দুশোটা ভুল ধরে দেবে, পাতা উল্টিয়ে রেখে দেবে, ছেলের নাম করে বাবার বই কেনা ছাড়া কিছুই নয়।
বাড়ি ফিরে রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে বসার ঘরে বইয়ের প্যাকেটগুলো খুলে হাঁটকে বের করে আনি মতি নন্দীর কিশোর রচনা সমগ্র। চল্লিশটা বছর পেরিয়ে গেছে তবুও কিছুতেই মনে মানতে পারেনি শিবার হেরে যাওয়া। শিবার ফিরে আসা পড়তে শুরু করি। বাইরে রাতের গভীর অন্ধকার ক্রমশ পাতলা হতে শুরু করে। কাক ডাকা ভোরে শেষ হয় শিবাজী আইচের জিতে ফিরে আসার উপাখ্যান। ভরপুর মন নিয়ে চোদ্দ বছরের কিশোর হয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দেখি বিছানায় ঘুমিয়ে আছে কে। তার বুকের ওপর ভাঁজ খোলা বই। মলাটে লেখা লীলা মজুমদারের হলদে পাখির পালক। বই এর দোকানের সেই মিটমিটে হাসিটা এবার আমার মুখে ফিরে আসে। সন্তর্পণে চোদ্দ বছরের কিশোরীর চোখ থেকে বাইফোকাল চশমাটা খুলে তুলে রাখি। একটা বইমেলা কত কি ফিরিয়ে দেয়।
একটিবার যেতেই হবে। দুশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসছি কলকাতা। তৈরি থেকো।