সখ করে দাদু নাম রেখেছিলেন সম্বুদ্ধ। বেড়ে ওঠাটা দেখেননি, নাতির আড়াই বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন, নাতি বড়ো হয়ে ডাক্তার হবে। ক্যান্সার স্পেশালিস্ট। অনেক দিন আগে মরে যাওয়া দিদার মতো অনেক রোগির জীবন বাঁচাবে। মা বাবাও সেই ইচ্ছা চরিতার্থ করার চেষ্টায় সম্বুদ্ধকে ভর্তি করেছিলেন নামী স্কুলে।
প্রথম থেকেই সম্বুদ্ধর অক্ষরজ্ঞানে সমস্যা, নামতা মুখস্থ হয় না, হাতের লেখাও অপাঠ্য। মা বাবা অনেক ধস্তাধস্তি করলেন, অনেক বাবা-বাছা, বকাঝকা, চড়-থাপ্পড়ের পরে বোঝা গেল, মাস্টার বেটে খাওয়ালেও সম্বুদ্ধর পড়াশোনার গতি রয়ে যাবে শম্বুকসম।
নামী স্কুল বললো, নিয়ে যান। আর ওকে নিচু ক্লাসে রাখা যাবে না। ছোটো ছোটো বাচ্চারা ওর সাইজ দেখে ভয় পায়। স্থান হলো পাড়ার এমন একটা স্কুলে যেখানে পাশ ফেলের বালাই নেই, অন্তত ক্লাস এইট অবধি রোজ ইউনিফর্ম পরে যাওয়া আসা করতে পারবে।
সম্বুদ্ধ আমার কাছে প্রথম এসেছিল তখন ওর বয়স চোদ্দো। পড়তো ক্লাস সেভেনে। আজকালকার হিসেব অনুযায়ী ক্লাস নাইনে পড়ার কথা। আসার কারণ ক্রমবর্ধমান রাগ আর মারধর। কোনও কারণ ছাড়াই মা বাবার ওপর চড়াও হয়ে অকথ্য কিল চড় লাথি ঘুঁষি মারত। এ-ডাক্তার ও-ডাক্তার করে ফল পাওয়া যাচ্ছে না, তাই উৎকণ্ঠিত মা বাবা এসেছেন, ডাক্তার দেব কি কিছু করতে পারবেন?
বুঝিয়ে বললাম, সম্বুদ্ধর ইন্টেলিজেন্স, বা বুদ্ধি কম। ওষুধ দিয়ে ঠিক করা যাবে না। চারপাশে কী ঘটছে, তার অর্থ ও আর পাঁচজনের মতো করবে না। ওর বুদ্ধি যেমন বলে ও তেমনই রিঅ্যাক্ট করবে। ওর ধারণা ও যা পাচ্ছে না, তা মারধর করলেই পাওয়া যাবে। তাই ও মারধর করে।
ওর মা বাবা বললেন, ও কিছু চাইলে মারধর করলে বুঝতাম, কিন্তু ও তো কোনও কারণ ছাড়াই আমাদের মারে…
বললাম, চাওয়া শুধু খাবার, বা লজেন্স-চকলেট ভাববেন না। ওর হয়ত গরম লাগছে, ঠাণ্ডা চাই। হয়ত পেট ব্যথা করছে, কষ্ট থেকে মুক্তি চাই। এগুলোও চাওয়া। কিন্তু ও যা বলতে জানে না, তা কী করে চাইবে? ফলে মারধর করে। সাধারণত বাচ্চারা মারধর করে কিছু চায় যখন ওদের কাছ থেকেও মারধর করে কিছু চাওয়া হয়, বা হয়েছে।
বাবা মিনমিন করে বললেন, ঠিক – ও যখন পড়াশোনা পেরে উঠত না, তখন ওকে খুবই মারধর করেছি আমরা।
আমি বুঝিয়ে বললাম, কী হয় জানেন, ছোটোদের আমরা যখন মারধর করি, ওরা শেখে যে মা বাবা বা শিক্ষক শিক্ষিকারা আমাদের ম্যানেজ না করতে পারলে মারে। যে সিচুয়েশন ম্যানেজ করতে পারছি না, সেই সিচুয়েশনে যদি গা জোয়ারি করি, সেটা অনেকটা অ্যামেরিকার মতো হয়। আমার কথা শুনতে চাও না? দেব বোমা মেরে উড়িয়ে। তার ফল কী হয়? টেররিজম। সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রেও একই কথা। আমরা যদি সন্তানকে গা জোয়ারি শেখাই, সে-ও গা জোয়ারি শিখবে। তার শরীরে যখন শক্তি আসবে, সে আমার চেয়ে বলীয়ান হয়ে উঠবে, তখন সে-ও আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না।
সম্বুদ্ধর ওষুধ বন্ধ করা গেল না। ওষুধ কমলেই মারামারি শুরু হত। মা বাবা ছুটে আসতেন। আবার বাড়াতে হতো ওষুধ। শেষে সিদ্ধান্ত নিতে হলো যে, কোনও ভাবেই ওষুধ ছাড়া রাখা যাবে না ওকে। ওষুধ দিলে রাগ আর বিদ্বেষ কমত। মাথা ঠাণ্ডা থাকত বলতে পারবো না, অনেক সময়ে ওষুধ চলাকালীনও রাগ বাড়ত। বার বার নার্সিং হোমে ভর্তি করে বাড়ি থেকে আলাদা করে রাখতে হত।
মা বাবা ব্যাঙ্ক এমপ্লয়ি ছিলেন। একমাত্র সন্তান সম্বুদ্ধ। আমার স্বভাব অনুযায়ী প্রথম দিন থেকেই বোঝাতাম, যতোটা সম্ভব সঞ্চয় করুন, যাতে আপনাদের পরে সম্বুদ্ধর স্বচ্ছ্বলতার অভাব না হয়। রোজগার খারাপ নয়, দুজনেই ব্যাঙ্কিং বোঝেন, সুতরাং সে কাজটা ভালো ভাবেই করতেন বলে আমার ধারণা।
বছর কয়েক কাটলো। সম্বুদ্ধ তখন আঠেরো। বলতে শুরু করলাম, ছেলের লিগ্যাল গার্জেন হবার অ্যাপ্লিকেশন করুন।
প্রথমে ওঁরা বুঝতেই পারছিলেন না। যতটা আইন জানি বুঝিয়ে বললাম। দেশের আইন অনুযায়ী, আঠেরো পূর্ণ হলে কেউ কারোর লিগ্যাল গার্জেন থাকে না। তখন শব্দটা হয়ে যায় ‘নেক্সট অফ কিন’ অর্থাৎ নিকটতম আত্মীয়। শারীরিক বা মানসিক, যে কারণেই হোক, কেউ যদি নিজের দেখাশোনায় অক্ষম হয়, তার দেখভালের জন্য কেউ লিগ্যাল গার্জেনশিপ চাইতে পারেন আইনি মাধ্যমে।
বললাম, আপনারা ওর জন্য যে টাকাকড়ি রেখে যাবেন, সে টাকাকড়ির কার হাতে থাকবে? ওর রোজকার দেখাশোনা কে করবে? আপনি যাঁকে বা যাঁদের দায়িত্ব দিয়ে যাবেন, তাঁদের কী অধিকার থাকবে সে টাকাকড়ির ওপর? আপনারা না থাকলে অন্য কেউ যদি লিগ্যাল গার্জেনশিপ চান, তবে অতো সহজ না-ও হতে পারে। একজন ভালো ল’ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
তার পর থেকে, প্রতি ভিজিটে আমার ঘ্যানঘ্যান শুরু হল। লিগ্যাল গার্জেন হলেন? অ্যাপ্লাই করেছেন? ওঃ, উকিল খুঁজেছেন অন্তত? শুনুন, দেরি করবেন না। সম্বুদ্ধর অবস্থার উন্নতি হবে না। হয় আত্মীয় বন্ধুর মধ্যে কেউ ওর দেখাশোনা করবে, নয়তো কোনও হোম-এর ব্যবস্থা করতে হবে। লিগ্যাল গার্জেনশিপ না হলে…
ওর বাবা বললেন, আত্মীয় বন্ধুর মধ্যে কাউকে বলা যাবে না, ডাক্তারবাবু। আমি নিজে একমাত্র সন্তান। সম্বুদ্ধর কোনও কাকা-জ্যাঠা-পিসি নেই। অন্য আত্মীয়রা দূর সম্পর্কের, যোগাযোগও সামান্য। সম্বুদ্ধর তিন মামা আছে, কাছেই থাকে, খুব ভালো, দেখাশোনা করতে আপত্তি করবে না, তবে সমস্যা সম্বুদ্ধই। মামাদের ওপর ভয়ানক রাগ। ওরা চাইলেও রাখতে পারবে না। হোমই খুঁজতে হবে।
বললাম, সে-ও আপনাদের ছুটোছুটি দৌড়োদৌড়ির বয়স থাকতে থাকতে। হোম বললেই পাওয়া যায় না আমাদের দেশে। অ্যামেরিকার মতো আমরাও ভারতে অ্যাসাইলাম তুলে দিয়েছি। সুতরাং সরকারি কোনও হাসপাতালে সম্বুদ্ধ সারা জীবন থাকবে, ওর খাওয়া দাওয়ার অভাব হবে না, এমন হবে না। প্রাইভেট হোম-এ দিয়ে নিশ্চিন্ত না-ও হতে পারেন। দ্বিতীয়বার খুঁজতে বেরোতে হতে পারে। সুতরাং…
সম্বুদ্ধর বাবা কয়েক মাস পর থেকে বলতে শুরু করলেন, ডাক্তারবাবু, চিন্তা নেই। আমরা এখনও অত বুড়ো হইনি। কালই তো মরে যাবো না, সময় আছে হাতে।
এ কথার পরে যে উত্তরটা আসে, তা হল, মশাই,অত সময় না-ও পেতে পারেন। কালই মরে যেতে পারেন, যে কেউ, আপনি, আমি – সক্কলেই। কিন্তু মুখের ওপর সেটা বলা অশালীন। তাই বলতাম না।
কাটল আরও বছর খানেক। ওষুধ খাওয়া, ডাক্তার দেখানোর রুটিন চললো, কিন্তু আর হলো না কিছুই।
একদিন সম্বুদ্ধর বাবা ফোন করলেন। সম্বুদ্ধর মায়ের চোখে একটা সমস্যা হয়েছে, চিকিৎসার জন্য যেতে হবে চেন্নাই শহরে। সেই সময়টা সম্বুদ্ধ থাকবে নার্সিং হোমে ভর্তি।
শঙ্কর নেত্রালয়ে জানা গেল, এ অসুখের চিকিৎসা নেই, মুক্তি নেই, আবশ্যম্ভাবী পরিণতি – অন্ধত্ব। তবু, কিছু প্রচেষ্টা চালাতে হবে বইকি। একেবারে ওষুধ দেওয়া হবে না তা নয়।
মায়ের চিকিৎসা শুরু হলো, নার্সিং হোমে সম্বুদ্ধকে রেখে কয়েক মাস পরে পরে চেন্নাই যাত্রা। জানতে পারি, তার ফাঁকে ফাঁকে, লাভ কিছুই হচ্ছে না। বরং দৃষ্টি আরও আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে।
শেষ অবধি, সম্পূর্ণ অন্ধ স্ত্রী-কে নিয়ে সম্বুদ্ধর বাবা শেষবারের মতো চেন্নাই গেলেন। আর ফেরার সুযোগ পেলেন না, দেশে আসার সময়ে ট্রেনেই হার্ট অ্যাটাকে বাবার মৃত্যু হলো। অন্ধ মা, বাবার মরদেহ নিয়ে ঘরে ফিরলেন।
সম্বুদ্ধ তখন নার্সিং হোমে ভর্তি। প্রতিবারের মতোই তাকে রেখে গিয়েছিলেন মা বাবা। ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন বড়ো মামা। সম্বুদ্ধ বলল, বাবা কই? মা? তোমার সঙ্গে যাবো না।
অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো হলো। বাড়ি গিয়েই জানতে চাইলো, বাবা?
এবং তারপরে, কোনও দিন বুঝল না, বাবার কী হয়েছে। শুধু বুঝল বাবাকে মা নিয়ে আসেনি। বাড়ল মায়ের ওপর অত্যাচার। অন্ধ মা দেখতেও পান না, বুঝতেও পারেন না, কখন, কোন দিক থেকে আক্রমণ আসবে – শুধু মার খেয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করেন। অনেক সময় পাড়ার লোকে এসে বাঁচান, কখনও মামারা কেউ এসে থাকেন, কিন্তু সারা দিন কে পাহারা দিয়ে থাকবে? কিছুদিন মামাবাড়িতে থাকার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো সম্বুদ্ধর জন্য।
এই সময়ের দৈনন্দিন খবর আর আমার কাছে পৌঁছত না। শহর পেরিয়ে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে আসা আর সম্ভব ছিলো না, ফলে ভর্তি করতে হলেই জানতে পারতাম যে পরিস্থিতি পাল্টায়নি। বরং সমস্যা আরও বেড়েইছে।
মাকে জিজ্ঞেস করতাম, লিগ্যাল গার্জেনশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেছেন?
মা বলতেন, ও সব আর কে করবে, ডাক্তারবাবু?
যোগাযোগ রাখতেন এক মামা, প্রধানত টেলিফোনের মাধ্যমে। জানতে পারতাম, ক্রমে মামাদের প্রতিও রাগ আর বিদ্বেষ বাড়ছে সম্বুদ্ধর। মামাবাড়ি যাবার নামেই মাকে মারধর করত বলে এখন দুপক্ষেরই যাতায়াত কমে গিয়েছে, অনেক।
মাস কাটে, বছর যায়। একদিন মামা ফোন করলেন এক ভয়াবহ খবর নিয়ে।
সম্বুদ্ধদের বাড়ি বড়ো রাস্তার ওপরেই। একফালি জমি, ছ-কামরার বাড়ি, সামনে পেছনে দুদিকেই সম্বুদ্ধর দাদু এমনভাবে জমি ছেড়ে রেখেছিলেন, যাতে পরে বাড়ি বাড়ানো যায়। সে আর প্রয়োজন হয়নি।
সে দিন কী হয়েছিল ঠিক ঠিক কেউ জানে না। সকাল বেলায় পাড়ার লোকেরা দেখেছে সম্বুদ্ধ মাকে মারছে, আর বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে। ধাক্কা দিয়ে গেট দিয়ে বের করে দিয়ে সম্বুদ্ধ বোধহয় ফিরেছিল বাড়ির দিকে। দৃষ্টিহীন মা দিক ঠিক করতে না পেরে, খোকা! বলে ডাক দিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। হয়তো আবার গেটের দিকেই যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দিক স্থির না করতে পেরে গিয়েছিলেন উলটো দিকে – যেখানে বড়ো রাস্তায় গাড়ির চলাচল কম ছিল বলে তীরবেগে ধেয়ে আসছিল একটা বাস…
আবার সম্বুদ্ধর ঠাঁই হয়েছিল কিছুদিন আমাদের নার্সিং হোমে, কিন্তু মায়ের শ্রাদ্ধের জন্য ওকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মামারা। সেই আমার সঙ্গে শেষ দেখা। শেষ দিন অবধি সম্বুদ্ধ মা বাবার মৃত্যু ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি। তাঁরা যে আর ফিরে আসবেন না, সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। বরং রাগ করেছে, মা, এবং বিশেষত বাবা আর আসেন না বলে।
মামাদেরও বলেছিলাম, লিগ্যাল গার্জেনশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করুন। ওঁরা বোনের শোকে মুহ্যমান, সময়ও নেই। ইচ্ছেও, বলা বাহুল্য, সামান্য।
কিন্তু মামলা একটা হলো। অবাক মামা ফোন করে জানালেন, ডাক্তারবাবু, সম্বুদ্ধ আমাদের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করেছে, ১৪৪ ধারা জারি করিয়েছে।
আমিও অবাক। সম্বুদ্ধর পক্ষে উকিল ধরে মামলা করা অসম্ভব। কোর্ট শব্দটা হয়ত জানেই না সে। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কী জানেন?
বুঝলাম মামা খুব শিওর নন। একটা উকিলের চিঠি এসেছিল বটে, কিন্তু সেটা খুব মন দিয়ে পড়েনওনি। তার পরে কোর্টের ডাক আসে এক দিন, তখন মামারা মিলে এক উকিল ঠিক করেন। প্রধান উদ্দেশ্য – ওঁদের যেন কোর্ট কাছারি না করতে হয়। উকিলই একদিন জানায়, কোর্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে অসদুদ্দেশ্যে মামাদের আনাগোনা বন্ধ করতে ১৪৪ ধারা জারি করা হল।
বললাম, আপনারা কী অসদুদ্দেশ্য প্রকাশ করেছিলেন?
বললেন, খাবার দাবার নিয়ে যেতাম, কাজের লোকের তদারকি করতাম, ওর সঙ্গে তো কথাবার্তা বলা যায় না, তবু জিজ্ঞেস করতাম, কী খবর ইত্যাদি… তার মধ্যে অসদুদ্দেশ্য কি থাকতে পারে ডাক্তারবাবু?
বললাম, কী করবেন এখন?
জবাব এল, জানি না। গিয়েছিলাম লোক্যাল থানায়। ওসি সব শুনে বলেছেন, এ সব কথা আপনারা আদালতে গিয়ে বলেননি কেন? এখন আমাকে বলে আর লাভ নেই। এখন আমার কাজ আপনারা যাতে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন না করেন, সে দিকে নজর রাখা।
তবে হ্যাঁ, ওসি বলেছেন, বাড়ির কাজের লোক যদি খাবার দাবার নিয়ে যায়, তাহলে কোর্টের আদেশ অমান্য হয়েছে এমন মনে করা হবে না।
বললাম, আপনারা মামলা করবেন না?
উনি কিন্তু কিন্তু হয়ে বললেন, মামলা কি করা যায়?
বললাম, উকিল কী বলেন? কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অ্যাপিল তো করা যায় বলেই জানি।
বুঝলাম, কেউ সেটা ভেবে দেখেনি। সে অ্যাপিলটাও আর হয়ে ওঠেনি। কয়েক মাস পরেই আবার মামার ফোন।
ডাক্তারবাবু, সম্বুদ্ধর কোনও খবর কি আপনার কাছে আছে?
আমি বললাম, ওর বাবা যাবার পর থেকে তো আপনিই সম্বুদ্ধর খবর আমাকে দেন। আমি তো আর কোনও সোর্স থেকে পাই না।
উনি বললেন, গত পাঁচ-সাতদিন বাড়ি নেই। ঘরদোর খোলা, ধুলোয় হাওয়ায় ঘরের মধ্যে একাকার, জিনিসপত্র ছত্রাকার। কাজের লোক প্রথম ক’দিন খাবার রেখেই এসেছে, ঘরে কুকুর বেড়াল ঢুকে সে খাবার খেয়ে, ছড়িয়ে, সে এক কাণ্ড। আমরাও গিয়েছিলাম, ও যে নেই সে বিষয়ে সন্দেহ নেই – কোথায় গেল ডাক্তারবাবু? ওর তো যাবার কোনও জায়গা নেই।
বললাম, পুলিশে জানিয়েছেন?
মামা বললেন, ওরে বাবা! সে তো আর এক কাণ্ড! এখন ওসির সুর আরও বদলেছে। বলছেন, আপনাদের কে বলেছে ওখানে যেতে? আপনাদের না ১৪৪ ধারাতে মানা করা আছে! আপনাদেরই কোমরে দড়ি দেবো। মিথ্যে করেই বললাম, আমরা যাইনি। কাজের লোক খাবার নিয়ে গিয়েছিল।
তখন নাকি পুলিশ অফিসার বলেছেন, কে বলেছে কাজের লোককে দিয়ে খাবার পাঠাতে? সম্বুদ্ধ বলেছে? না বললে কাজের লোকেরও যাওয়া বারণ।
মামা মিনমিন করে বলতে গেছিলেন, তাহলে, খাবার পাবে কোত্থেকে ছেলেটা?
অফিসার বললেন, এই যে বললেন, সে বাড়িতেই নেই? তাহলে কাকে খাওয়াচ্ছেন? আপনার ধান্দাটা কী বলুন তো মশাই?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী করবেন এখন?
উনি বললেন, কিছু তো আর করারও নেই। বোনের কথা ভেবেই ছেলেটার দেখাশোনা করতাম, কিন্তু বুঝছি আর কিছু করে কাজ নেই। করবই বা কী? আপনি কিছু আন্দাজ দিতে পারেন?
পারি না।
সম্বুদ্ধর মামা আবার ফোন করলেন মাস দেড়েক যেতে না যেতেই। এবার আরও ইন্টারেস্টিং খবর। ডাক্তারবাবু, এবার বুঝেছি কী হয়েছে। বাড়িটার চার দিকে এখন টিনের বেড়া। তাতে আমাদের পাড়ার সবচেয়ে প্রতাপশালী প্রোমোটারের নোটিস।
কী বুঝলেন? জানতে চাইলাম।
কী আবার? ওই প্রোমোটারই মামলা করে আমাদের ১৪৪ ধারায় ফেলেছে, ওর জন্যই আজ সম্বুদ্ধ নেই…
কোথায় গেল, জানতে চেষ্টা করবেন না?
মামার গলায় ফাইনালিটির সুর, না, ডাক্তারবাবু, সে আর সম্ভব না। কোন নদীতে ভেসে গেছে, কোন জলার পাঁকের নিচে, সে জেনে আর লাভই বা কী, আর জানার চেষ্টায় নিজের বিপদ ডেকে আনার প্রয়োজনই বা কী?
সম্বুদ্ধ আজ কোন নদীতে, কোন জলার পাঁকে, বা সেই নাম-না-জানা রাস্তায় নতুন তৈরি মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাটবাড়ির ভিতে… কেই বা জানে, বা জানতে চায়?
ডাক্তারের দৃষ্টিতে দেখা একজন রোগীর সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অশিক্ষা ও চেতনার অভাব রোগীকে কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার বিবরণ।
পড়ে মনটা খারাপ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। অল্পবয়সী পাঠকদের অনুরোধ তাঁরা যেন সামাজিক চেতনা জাগানোর জন্য চেষ্টা করেন কিছু মূল্যবান সময় দিয়ে।