লিভার নিয়ে অধিকাংশ মানুষের আতংকের শেষ নেই। অর্ধেক বাঙালিই গ্যাস অম্বলে ভোগেন। এবং তাঁদের ধারণা, লিভারের অবস্থা খারাপ বলেই তাঁদের পেটের এতো সমস্যা। এমনকি কারো মুখে দুর্গন্ধ হলেও তিনি ধরে নেন লিভারের সমস্যার জন্যই তাঁর মুখে গন্ধ হচ্ছে। যদিও আমার মাথায় কিছুতেই ঢোকেনা লিভার পচে মুখ দিয়ে বিশ্রী গন্ধ কী করে বেরোনো সম্ভব।
রোগীদের আরেকটি ভয় হচ্ছে চোরা জন্ডিসের। চোরাবালিতে যেমন মানুষ ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়, তেমনই তাঁরাও ভাবেন চোরা জন্ডিসে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবেন।
এসমস্ত রোগীরা একগুচ্ছ রিপোর্ট নিয়ে দেখাতে আসেন। তাঁদের সাধারণ প্রশ্ন হলোঃ
ডাক্তারবাবু, আমি প্রায় দেড় দুবছর ধরে যতবারই পরীক্ষা করছি আমার বিলিরুবিন বেশি আসছে। আমার কি তাহলে চোরা জন্ডিস হয়েছে? আস্তে আস্তে আমার লিভার কি খারাপ হয়ে যাবে? কী করলে আমার বিলিরুবিন কমবে?
উত্তরঃ চোরা জন্ডিস বলে কিছু হয়না। বেশ কিছুদিন ধরে কারো বিলিরুবিন বেশি থাকলে দেখা উচিৎ বিলিরুবিনের কোন অংশটি রক্তে বেড়েছে। যে সমস্ত সুস্থ সবল মানুষের বিলিরুবিন দীর্ঘদিন ধরে বেড়ে রয়েছে, তাঁদের বেশিরবাগেরই কোনো রোগ থাকে না। এঁদের যেটা থাকে তার নাম গিলবার্ট সিনড্রোম।
বিলিরুবিনের রিপোর্টে দেখবেন তলায় দুইটি ভাগ দেওয়া আছে। আনকনজুগেটেড বিলিরুবিন ও কনজুগেটেড বিলিরুবিন।
শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর রক্ত কণিকার হিমোগ্লোবিন থেকে বিলিরুবিন তৈরি হয়। এই বিলিরুবিন রক্তের মাধ্যমে লিভারে পৌঁছায়। এখন লিভারে পৌঁছানোর পর বিলিরুবিন উৎসেচকের মাধ্যমে গ্লুকোনিউরিক অ্যাসিডের সাথে যুক্ত হয়। তারপর পিত্তের মাধ্যমে সেটি পরিপাক নালীতে নির্গত হয়। গ্লুকোনিউরিক অ্যাসিডের সাথে যুক্ত এই বিলিরুবিনকে বলে কনজুগেটেড বিলিরুবিন। আর তার আগের বিলিরুবিনকে বলে আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন।
যে কোনও লিভারের অসুখে সাধারণত বিলিরুবিনের কনজুগেশনের প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক থাকে। তাই সেক্ষেত্রে কনজুগেটেড বিলিরুবিন বাড়ে। যেমন হেপাটাইটিস, সিরোসিস, অবস্ট্রাক্টেড জন্ডিস ইত্যাদি। তাছাড়া সেক্ষেত্রে লিভার ফাংশান টেস্টের অন্যান্য জিনিসেরও মানের পরিবর্তন হয়। যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি ইত্যদি লিভার এনজাইম বাড়ে। অ্যালবুমিন কমে।
গিলবার্ট সিন্ড্রোমে বিলিরুবিন কনজুগেশনের জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচকটির অভাব থাকে। যার ফলে কনজুগেটেড বিলিরুবিন ঠিক বা কম থাকলেও আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন পরিমানে অনেকটাই বাড়ে। এটা একধরণের জিন ঘটিত অসুখ। ফলে সারাজীবন ধরেই গিলবার্ট সিন্ড্রোমে আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন বেড়ে থাকে। কারুর যদি বেশ কয়েক বছর আগের লিভার ফাংশান টেস্টের রিপোর্ট থাকে, তাতেও দেখা যাবে বিলিরুবিন ২ থেকে ৪ মিগ্রা/ডেসিলির মধ্যে। এবং তার মধ্যে আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন ৮০% এর বেশি।
আন কনজুগেটেড বিলিরুবিন আরও কিছু রোগে বাড়তে পারে। যেমন হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া। কিন্তু সেক্ষেত্রে রোগের অন্যান্য লক্ষণ থাকবে। যেমন রক্তাল্পতা হবে। পিলে আকারে বড়ো হয়ে যাবে। গিলবার্ট সিনড্রোমের ক্ষেত্রে রোগীর অন্য কোনো লক্ষণ থাকবে না। শুধু রক্তে আনকজুগেটেড বিলিরুবিন বেশি থাকবে।
অনেকেই এই বিলিরুবিন বাড়াকে কোনো জটিল সমস্যা ভেবে নিজেরাই ওষুধের দোকানদার বা আত্মীয়দের কথা মতো “আরসো-ডিঅক্সি-কোলিকঅ্যাসিড” বলে একটা অত্যন্ত দামী ওষুধ কিনে মাসের পর মাস খান। যেটির গিলবার্ট সিনড্রোমে কোনো ভূমিকা নেই। বস্তুত প্রাইমারি বিলিয়ারি সিরোসিস বলে একটি জটিল ও বিরল রোগ ছাড়া অন্য কোনও অসুখে ঐ দামি ওষুধটির তেমন কোনো ভূমিকা নেই। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ৫% এর বেশি সুস্থ মানুষের গিলবার্ট সিন্ড্রোম থাকে। বেশিরভাগ মানুষই না জেনে সারাজীবন দিব্যি কাটিয়ে দেন। গিলবার্ট সিনড্রোমে কোনো চিকিৎসার দরকার নেই। শুধু দরকার মাথা থেকে এই রোগের ভূত তাড়ানো।